Thursday, December 25, 2025

‘ডেনভারের মৃত্যুহীন গান’, উৎপল সিনহার কলম

Date:

Share post:

উৎপল সিনহা

‘ টের পাবো শুয়ে শুয়ে
মরণের ঘোরে । ‘

সত্যিই কি টের পাওয়া যায় ? মরণের ঘোরের মধ্যে কিছুই কি টের পাওয়া সম্ভব ? তখন তো চেতনা স্থবির হয়ে যায় , টের পাওয়ার সমস্ত ক্ষমতা লোপ পায় । ট্রামের ধাক্কায় পিষ্ট জীবনানন্দ দাশের ক্ষতবিক্ষত দোমড়ানো মোচড়ানো শরীরটা যখন হাসপাতালের বিছানায় মৃত্যুর ঘোরে আচ্ছন্ন , তখন কি জাগতিক কিছু টের পাওয়া সম্ভব ?

তাঁর গাড়িটি ভয়াবহ দুর্ঘটনার কবলে পড়ার সঙ্গেসঙ্গেই সঙ্গীতশিল্পী আমির খানের মাথার ঘিলু বেরিয়ে পড়েছিল । মরণের ঘোর আসার সময়টুকুও পান নি তিনি । কিংবা , হ্যানসি ক্রোনিয়ে ? দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট দলের অধিনায়ক হ্যানসির বিমান ঝোড়ো হাওয়ায় মাটিতে আছড়ে পড়ার মুহূর্তে কিছু কি টের পেয়েছিলেন তিনি ?

বিখ্যাত গায়ক জন ডেনভারের কী হয়েছিল ১৯৯৭-এর ১২ অক্টোবর ? একা একটি বিমানে উড়ছিলেন তিনি । এমন কান্ড তিনি হামেশাই করতেন । সেদিন বিমানে পর্যাপ্ত পরিমাণ জ্বালানি ছিল না । বিমানের হাতলেও কিছু সমস্যা ছিল । যে বিমানটি উড়ানের জন্য বেছে নিলেন সেই ধরনের বিমানের দুর্ঘটনার রেকর্ড হাড়হিম করার মতো । সবাই বারণ করা সত্ত্বেও কারোর কথায় কর্ণপাত না করে ঘন্টাখানেকের মধ্যেই ফেরার প্রতিশ্রুতি দিয়ে একাই ডানামেলা পাখির মতো উড়ে গেলেন জন ডেনভার । কিছুক্ষণের মধ্যেই গোত্তা খেয়ে উত্তাল সমুদ্রের বুকে আছড়ে পড়লেন ছোট্ট প্রিয় জেট বিমানটি নিয়ে । তলিয়ে গেলেন । সম্পন্ন হলো সলিল সমাধি । টের পেয়েছিলেন কিছু ? মৃত্যুতন্দ্রায় আচ্ছন্ন হওয়ার সময় পেলেন কোথায় ?

মাত্র ৫৩ বছরের জীবন অসামান্য বর্ণময় । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকোতে জন্ম । ক্যালিফোর্নিয়ার অন্তর্গত মন্টারে উপসাগরে মৃত্যু । টেক মি হোম কান্ট্রি রোডস ,সানশাইন অন মাই শোল্ডার , ব্যাক হোম এগেইন , রকি মাউন্টেন হাই , অ্যানিস সং , সুইট সারেন্ডার , ক্যালিপসো , মাই সুইট লেডি , লিভিং অন এ জেট প্লেন ইত্যাদি অবিস্মরণীয় গানগুলি কে না শুনেছেন ? থ্যাঙ্ক গড আই এম এ কান্ট্রি বয় , লুকিং ফর স্পেস , ফ্লাই এওয়ে , হাও ক্যান আই লিভ ইউ এগেইন , ওয়াইল্ড মনটানা স্কাইজ , ইজ ইট লাভ , দিস ওল্ড গিটার , গ্র্যান্ড মাজ ফেদার বেড শুনেছে সারা বিশ্ব । জনের মায়াবী কন্ঠস্বর আর গিটারের অপূর্ব মূর্ছনায় ভেসে যান নি এমন শ্রোতা খুঁজে পাওয়া যাবে না ।

হেনরি জন ডয়েটশেল্ডার্ফ জুনিয়র , যাঁর পেশাগত নাম জন ডেনভার, ১৯৪৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন । তিনি একজন আমেরিকান গায়ক , গীতিকার ও সুরকার , অভিনেতা , সক্রিয় মানবতাবাদী , যিনি ১৯৭০ সাল থেকে একক গায়ক হিসেবে সর্বশ্রেষ্ঠ বানিজ্যিক সাফল্য অর্জন করেন । তাঁর বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তার কারণ তিনি লোক , লোক রক , পশ্চিমা ও দেশাত্মবোধক সঙ্গীতের ধারাগুলিকে সারা পৃথিবীর প্রতিটি কোনে পৌঁছে দিয়েছেন । একাডেমি , এমি পুরষ্কার , আমেরিকান সঙ্গীত পুরষ্কার ও গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড-সহ এত পুরষ্কার পেয়েছেন তিনি সারাজীবনে যে , তার তালিকা ক্রমেই দীর্ঘ হবে । লিখেছেন ‘ দি চিল্ডরেন এন্ড দ্য ফ্লাওয়ারস’ , ‘ আলফি দ্য ক্রিসমাস ট্রি ‘ , ‘ টেক মি হোম এন অটোবায়োগ্রাফি ‘ ,
‘ পয়েমস , প্রায়োরস্ এন্ড প্রমিসেস ‘ , ‘ দ্য আর্ট এন্ড সোল অফ জন ডেনভার ‘ ইত্যাদি বই ।
ডেনভারের গানে বারবার উঠে এসেছে বিশ্বপ্রকৃতি । ব্যক্তিগত প্রেম , বিরহ , দুঃখ বিষাদ অতিক্রম করে বারবার তাঁর গানে জায়গা করে নিয়েছে খনি শ্রমিকদের হাড়ভাঙা খাটুনির পর তাঁদের
হাসিকান্নার গল্পগুলি , যেখানে মিলেমিশে একাকার ঘাম , অশ্রু , রক্ত আর আশ্চর্য জীবন সংগ্রাম ।
দ্য ওল্ড গিটার গানটি তিনি তৈরি করেন তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া একটি চমৎকার ঘটনা অবলম্বনে । ঠাকুমার কাছে উপহার পাওয়া একটি গিটার হারিয়ে গিয়েছিল তাঁর । তাতে তিনি খুব ভেঙে পড়েন । তারপর দীর্ঘ কয়েক বছরে যখন তিনি গিটার হারানোর শোক অনেকটা কাটিয়ে উঠেছেন তখন হঠাৎই একদিন এক টেলিভিশন শো-এ তিনি তাঁর সেই হারানো গিটারটি ফেরত পান । তৈরি হয় কালজয়ী গান : দ্য ওল্ড গিটার ।
১২ অক্টোবর , ১৯৯৭ । সেদিন বিকেল ৫ টা বেজে ২৮ মিনিটে মন্টারি পেনিনসুলা অঞ্চলের কিছু মানুষ অবাক হয়ে দেখেন , একটি বিমান মাথা নিচু করে ঝুঁকে আসছে সমুদ্রের দিকে । বিমানটি চালাচ্ছিলেন ডেনভার স্বয়ং এবং বিমানটি ছিল তাঁর নিজেরই আদ্রিয়ান ডেভিস লং ইজেড । নিজে বেশ নামকরা বিমান চালক ছিলেন জন । ছিলেন একাধিক বিমানের মালিক । সময় পেলেই তিনি বেরিয়ে পড়তেন কোনো একটা সাধের বিমান সঙ্গী ক’রে । পুরোনো ভিন্টেজ বিমান সংগ্রহের শখ ছিল তাঁর । উপরে উঠতে উঠতেই তিনি হয়তো বুঝতে চেয়েছিলেন প্রিয়জনের থেকে দূরে চলে যাওয়ার যন্ত্রণা : ও বেব আই হেট টু গো …
তাঁর ভালোবাসা , তাঁর প্রতিবাদ সুরে সুরে এসেছে একাকী সন্ধ্যার মনখারাপের মতো মৃদু ছন্দে । বাতাসের সঙ্গে নাচতে নাচতে উড়ে যাওয়া , আবার ফিরে আসা দোদুল্যমান বাতাসের হাত ধরে , এই ছিল যাঁর প্রিয় অভ্যাস , তিনিই এক মনোরম বিকেলে এক্ষুনি ফিরে আসছি ব’লে উড়ে গেলেন সুনীল আকাশে । আর ফিরে এলেন না । তিনিই তো লিখেছিলেন : লাভ ইজ নাউ দ্য রিজন আই মাস্ট গো ।

মাত্র ৫৩ বছর বয়সে সমুদ্রের অতলে তলিয়ে যাওয়া জন কমপক্ষে ৬৪ বছর বাঁচতে চেয়েছিলেন কি ? নাহলে লিখবেন কেন : উইল ইউ স্টিল নিড মি , উইল ইউ স্টিল ফিড মি , হোয়েন আই অ্যাম সিক্সটি ফোর? গান , গিটার আর উড়োজাহাজে ঘেরা এক আশ্চর্য জীবনের মালিক ছিলেন মানবদরদী পরিবেশবিদ জন ডেনভার । সবসময় ‘ একা ‘ আকাশে ওড়ার কারণ হিসেবে বলতেন ‘একা’ না হলে নাকি আকাশের সঙ্গে কমিউনিকেট করতে অসুবিধা হয় । ডেনভারের বিমান সাগরে তলিয়ে যাওয়ার অনেক ঘন্টা পরে অনুসন্ধানকারীরা সাগরের ২৫ ফিট তলা থেকে খুঁজে পান ডেনভারের মাথাসহ শরীরের অন্যান্য বিচ্ছিন্ন অংশ , সেই জন ডেনভার যিনি গেয়ে গেছেন :
লাইফ ইজ নাথিং বাট এ
ফানি রিডল ।

আরও পড়ুন- শহরের রাজপথে বামেদের মিছিলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার ডাক

spot_img

Related articles

ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর জন্মবার্ষিকীতে মুখ্যমন্ত্রীর শ্রদ্ধাজ্ঞাপন

২৫শে ডিসেম্বর ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর (Atal Bihari Bajpeyee) জন্মবার্ষিকী আর সেই উপলক্ষে নিজের সোশ্যাল হ্যান্ডেলে...

১৭ বছর পর বাংলাদেশে ফিরলেন খালেদাপুত্র, তারেককে ঘিরে উচ্ছ্বাস-বিএনপি সমর্থকদের

বাংলাদেশের ফিরলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমান (Tarique Rahman returns in Bangladesh)। বৃহস্পতি সকালেই তিনি সিলেট...

এক দশক পর শীতলতম বড়দিন পেল বাংলা!

যিশু জন্মদিনের সকালে (Christmas morning) কলকাতার তাপমাত্রা (Kolkata temperature) নামলো ১৩.৭ ডিগ্রিতে। শীতের আমেজে জমজমাট বড়দিনের আবহাওয়া। দক্ষিণবঙ্গে...

মধ্যরাতে কর্নাটকের ট্রাক-বাসের ভয়াবহ সংঘর্ষে ঝলসে মৃত্যু অন্তত ১০ জনের

বড়দিনে ভয়াবহ দুর্ঘটনা কর্নাটকে। বেসরকারি একটি বাসের সঙ্গে ট্রাকের সংঘর্ষের (bus truck accident) ফলে বাসে আগুন ধরে যাওয়ায়...