‘ডেনভারের মৃত্যুহীন গান’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

‘ টের পাবো শুয়ে শুয়ে
মরণের ঘোরে । ‘

সত্যিই কি টের পাওয়া যায় ? মরণের ঘোরের মধ্যে কিছুই কি টের পাওয়া সম্ভব ? তখন তো চেতনা স্থবির হয়ে যায় , টের পাওয়ার সমস্ত ক্ষমতা লোপ পায় । ট্রামের ধাক্কায় পিষ্ট জীবনানন্দ দাশের ক্ষতবিক্ষত দোমড়ানো মোচড়ানো শরীরটা যখন হাসপাতালের বিছানায় মৃত্যুর ঘোরে আচ্ছন্ন , তখন কি জাগতিক কিছু টের পাওয়া সম্ভব ?

তাঁর গাড়িটি ভয়াবহ দুর্ঘটনার কবলে পড়ার সঙ্গেসঙ্গেই সঙ্গীতশিল্পী আমির খানের মাথার ঘিলু বেরিয়ে পড়েছিল । মরণের ঘোর আসার সময়টুকুও পান নি তিনি । কিংবা , হ্যানসি ক্রোনিয়ে ? দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট দলের অধিনায়ক হ্যানসির বিমান ঝোড়ো হাওয়ায় মাটিতে আছড়ে পড়ার মুহূর্তে কিছু কি টের পেয়েছিলেন তিনি ?

বিখ্যাত গায়ক জন ডেনভারের কী হয়েছিল ১৯৯৭-এর ১২ অক্টোবর ? একা একটি বিমানে উড়ছিলেন তিনি । এমন কান্ড তিনি হামেশাই করতেন । সেদিন বিমানে পর্যাপ্ত পরিমাণ জ্বালানি ছিল না । বিমানের হাতলেও কিছু সমস্যা ছিল । যে বিমানটি উড়ানের জন্য বেছে নিলেন সেই ধরনের বিমানের দুর্ঘটনার রেকর্ড হাড়হিম করার মতো । সবাই বারণ করা সত্ত্বেও কারোর কথায় কর্ণপাত না করে ঘন্টাখানেকের মধ্যেই ফেরার প্রতিশ্রুতি দিয়ে একাই ডানামেলা পাখির মতো উড়ে গেলেন জন ডেনভার । কিছুক্ষণের মধ্যেই গোত্তা খেয়ে উত্তাল সমুদ্রের বুকে আছড়ে পড়লেন ছোট্ট প্রিয় জেট বিমানটি নিয়ে । তলিয়ে গেলেন । সম্পন্ন হলো সলিল সমাধি । টের পেয়েছিলেন কিছু ? মৃত্যুতন্দ্রায় আচ্ছন্ন হওয়ার সময় পেলেন কোথায় ?

মাত্র ৫৩ বছরের জীবন অসামান্য বর্ণময় । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকোতে জন্ম । ক্যালিফোর্নিয়ার অন্তর্গত মন্টারে উপসাগরে মৃত্যু । টেক মি হোম কান্ট্রি রোডস ,সানশাইন অন মাই শোল্ডার , ব্যাক হোম এগেইন , রকি মাউন্টেন হাই , অ্যানিস সং , সুইট সারেন্ডার , ক্যালিপসো , মাই সুইট লেডি , লিভিং অন এ জেট প্লেন ইত্যাদি অবিস্মরণীয় গানগুলি কে না শুনেছেন ? থ্যাঙ্ক গড আই এম এ কান্ট্রি বয় , লুকিং ফর স্পেস , ফ্লাই এওয়ে , হাও ক্যান আই লিভ ইউ এগেইন , ওয়াইল্ড মনটানা স্কাইজ , ইজ ইট লাভ , দিস ওল্ড গিটার , গ্র্যান্ড মাজ ফেদার বেড শুনেছে সারা বিশ্ব । জনের মায়াবী কন্ঠস্বর আর গিটারের অপূর্ব মূর্ছনায় ভেসে যান নি এমন শ্রোতা খুঁজে পাওয়া যাবে না ।

হেনরি জন ডয়েটশেল্ডার্ফ জুনিয়র , যাঁর পেশাগত নাম জন ডেনভার, ১৯৪৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন । তিনি একজন আমেরিকান গায়ক , গীতিকার ও সুরকার , অভিনেতা , সক্রিয় মানবতাবাদী , যিনি ১৯৭০ সাল থেকে একক গায়ক হিসেবে সর্বশ্রেষ্ঠ বানিজ্যিক সাফল্য অর্জন করেন । তাঁর বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তার কারণ তিনি লোক , লোক রক , পশ্চিমা ও দেশাত্মবোধক সঙ্গীতের ধারাগুলিকে সারা পৃথিবীর প্রতিটি কোনে পৌঁছে দিয়েছেন । একাডেমি , এমি পুরষ্কার , আমেরিকান সঙ্গীত পুরষ্কার ও গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড-সহ এত পুরষ্কার পেয়েছেন তিনি সারাজীবনে যে , তার তালিকা ক্রমেই দীর্ঘ হবে । লিখেছেন ‘ দি চিল্ডরেন এন্ড দ্য ফ্লাওয়ারস’ , ‘ আলফি দ্য ক্রিসমাস ট্রি ‘ , ‘ টেক মি হোম এন অটোবায়োগ্রাফি ‘ ,
‘ পয়েমস , প্রায়োরস্ এন্ড প্রমিসেস ‘ , ‘ দ্য আর্ট এন্ড সোল অফ জন ডেনভার ‘ ইত্যাদি বই ।
ডেনভারের গানে বারবার উঠে এসেছে বিশ্বপ্রকৃতি । ব্যক্তিগত প্রেম , বিরহ , দুঃখ বিষাদ অতিক্রম করে বারবার তাঁর গানে জায়গা করে নিয়েছে খনি শ্রমিকদের হাড়ভাঙা খাটুনির পর তাঁদের
হাসিকান্নার গল্পগুলি , যেখানে মিলেমিশে একাকার ঘাম , অশ্রু , রক্ত আর আশ্চর্য জীবন সংগ্রাম ।
দ্য ওল্ড গিটার গানটি তিনি তৈরি করেন তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া একটি চমৎকার ঘটনা অবলম্বনে । ঠাকুমার কাছে উপহার পাওয়া একটি গিটার হারিয়ে গিয়েছিল তাঁর । তাতে তিনি খুব ভেঙে পড়েন । তারপর দীর্ঘ কয়েক বছরে যখন তিনি গিটার হারানোর শোক অনেকটা কাটিয়ে উঠেছেন তখন হঠাৎই একদিন এক টেলিভিশন শো-এ তিনি তাঁর সেই হারানো গিটারটি ফেরত পান । তৈরি হয় কালজয়ী গান : দ্য ওল্ড গিটার ।
১২ অক্টোবর , ১৯৯৭ । সেদিন বিকেল ৫ টা বেজে ২৮ মিনিটে মন্টারি পেনিনসুলা অঞ্চলের কিছু মানুষ অবাক হয়ে দেখেন , একটি বিমান মাথা নিচু করে ঝুঁকে আসছে সমুদ্রের দিকে । বিমানটি চালাচ্ছিলেন ডেনভার স্বয়ং এবং বিমানটি ছিল তাঁর নিজেরই আদ্রিয়ান ডেভিস লং ইজেড । নিজে বেশ নামকরা বিমান চালক ছিলেন জন । ছিলেন একাধিক বিমানের মালিক । সময় পেলেই তিনি বেরিয়ে পড়তেন কোনো একটা সাধের বিমান সঙ্গী ক’রে । পুরোনো ভিন্টেজ বিমান সংগ্রহের শখ ছিল তাঁর । উপরে উঠতে উঠতেই তিনি হয়তো বুঝতে চেয়েছিলেন প্রিয়জনের থেকে দূরে চলে যাওয়ার যন্ত্রণা : ও বেব আই হেট টু গো …
তাঁর ভালোবাসা , তাঁর প্রতিবাদ সুরে সুরে এসেছে একাকী সন্ধ্যার মনখারাপের মতো মৃদু ছন্দে । বাতাসের সঙ্গে নাচতে নাচতে উড়ে যাওয়া , আবার ফিরে আসা দোদুল্যমান বাতাসের হাত ধরে , এই ছিল যাঁর প্রিয় অভ্যাস , তিনিই এক মনোরম বিকেলে এক্ষুনি ফিরে আসছি ব’লে উড়ে গেলেন সুনীল আকাশে । আর ফিরে এলেন না । তিনিই তো লিখেছিলেন : লাভ ইজ নাউ দ্য রিজন আই মাস্ট গো ।

মাত্র ৫৩ বছর বয়সে সমুদ্রের অতলে তলিয়ে যাওয়া জন কমপক্ষে ৬৪ বছর বাঁচতে চেয়েছিলেন কি ? নাহলে লিখবেন কেন : উইল ইউ স্টিল নিড মি , উইল ইউ স্টিল ফিড মি , হোয়েন আই অ্যাম সিক্সটি ফোর? গান , গিটার আর উড়োজাহাজে ঘেরা এক আশ্চর্য জীবনের মালিক ছিলেন মানবদরদী পরিবেশবিদ জন ডেনভার । সবসময় ‘ একা ‘ আকাশে ওড়ার কারণ হিসেবে বলতেন ‘একা’ না হলে নাকি আকাশের সঙ্গে কমিউনিকেট করতে অসুবিধা হয় । ডেনভারের বিমান সাগরে তলিয়ে যাওয়ার অনেক ঘন্টা পরে অনুসন্ধানকারীরা সাগরের ২৫ ফিট তলা থেকে খুঁজে পান ডেনভারের মাথাসহ শরীরের অন্যান্য বিচ্ছিন্ন অংশ , সেই জন ডেনভার যিনি গেয়ে গেছেন :
লাইফ ইজ নাথিং বাট এ
ফানি রিডল ।

আরও পড়ুন- শহরের রাজপথে বামেদের মিছিলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার ডাক

Previous articleবাংলার সঙ্গে ত্রিপুরার ফা*রাক বোঝালেন মানিক
Next articleBreakfast Sports: ব্রেকফাস্ট স্পোর্টস