‘জোনাকির রঙে ঝিলমিল’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

ও জোনাকি , কী সুখে ওই
ডানা দুটি মেলেছো ।
আঁধার সাঁঝে বনের মাঝে
উল্লাসে প্রাণ ঢেলেছো ।।

তারাভরা আকাশ আমরা দেখি রাতে । রাতের আকাশে অজস্র তারা মিটমিট করে জ্বলতে থাকে । আর প্রতি রাত্রে আমাদের পৃথিবীর বুকে মিটিমিটি জ্বলতে থাকে অসংখ্য জোনাকি পোকা । যে কোনো সন্ধ্যায় পুরুলিয়া বা বাঁকুড়া জেলার যে কোনো পাহাড়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে যে অপরূপ আলোর মালা দেখা যায় তা সমবেত লক্ষ লক্ষ জোনাকির আলো । সন্ধ্যায় গ্রামাঞ্চলে গেলে মনে হয় তারাভরা আকাশটা বোধহয় মাটিতে নেমে এসেছে। আহা , কী অপূর্ব যে প্রকৃতির লীলা !

তুমি নও তো সূর্য , নও তো চন্দ্র , তোমার তাই ব’লে কি
কম আনন্দ ।
তুমি আপন জীবন পূর্ণ ক’রে
আপন আলো জ্বেলেছো ।।

ইংরেজিতে এই পোকাগুলিকে বলা হয় ‘ ফায়ার ফ্লাই ‘ । এরা খুব বেশি বাঁচে না । এই স্বল্প আয়ুষ্কালেই পৃথিবীকে আলোয় ভরিয়ে দিয়ে যায় । বন্য অঞ্চলে এদের গড় আয়ু প্রায় এক বছর । এরা সাধারণত প্রাপ্তবয়স্ক হিসাবে প্রায় দু’মাস বাঁচে । কিছু প্রজাতি লার্ভা পর্যায়ে প্রায় বছর দুয়েক বেঁচে থাকতে পারে । গড় জোনাকি পোকার জীবনচক্র লক্ষ্য করলে দেখা যায় এরা মেটামরফসিসের চারটি ধাপ অতিক্রম করে , সেগুলো হলো যথাক্রমে ডিম , লার্ভা , পিউপা এবং প্রাপ্তবয়স্ক ।

তোমার যা আছে তা তোমার আছে , তুমি নও গো ঋণী কারো কাছে ,
তোমার অন্তরে যে শক্তি আছে
তারি আদেশ পেলেছ ।।

বাংলায় এদের নামটি বড়ো সুন্দর , তমোমণি । ল্যামপিরিডি পতঙ্গ পরিবারের মূলত পাখাওয়ালা গুবরে পোকাদের একটি বর্গ হলো ( কলিওপ্টেরা বর্গ ) জোনাকি। এরা জৈব রাসায়নিক ব্যবস্থায় নিজেদের শরীর থেকে আলো উৎপন্ন করে । এদের এই আলো উৎপাদনের কারণ হিসেবে যৌন মিলন ও শিকার ধরার সময়কে ধরা হয় । এরা কোল্ড লাইট বা নীলাভ আলো উৎপন্ন করে কোনো আল্ট্রাভায়োলেট বা ইনফ্রারেড তরঙ্গ ছাড়া । এই আলোর রং হলুদ , সবুজ বা ফিকে লাল হতে পারে ।

প্রায় ২০০০ জোনাকির প্রজাতি পাওয়া গেছে গ্রীষ্ম এবং নাতিশীতোষ্ণ এলাকায় । ডোবা , ভেজা এলাকা এবং কাঠ আছে এমন অঞ্চলে এরা বসবাস করে , কারণ এই স্থানগুলোতে তাদের লার্ভা বেঁচে থাকার জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য পায় । তাদের ছানা বা কীটগুলো থেকেও আলো নির্গত হয় , এদের গ্লোওয়ার্ম বলা হয় । লাল ও সবুজ আলোর জোনাকি বেশি দেখা যায় । এদের তলপেটে স্বয়ংপ্রভ নীলাভ-সবুজ দ্যুতি থাকে । এরা সমবেতভাবে এক ছন্দে মিটমিট করতে পারে । এই দ্যুতি আসে লুসিফারিন অক্সিজেন ও এটিপি-র সংমিশ্রণের লুসিফারেজ দ্বারা অনুঘটিত জারণ থেকে ।

পুরুষ জোনাকির ডানা থাকে , সে উড়তে পারে । স্ত্রী জোনাকির ডানা নেই , তাই উড়তে পারে না । একবার জ্বলে , একবার নেভে , এইভাবে আলো দেয় পুরুষ জোনাকি । পুরুষ জোনাকির উদরাংশ কতগুলো ছোট ছোট ভাগে ভাগ করা । এই ভাগগুলোর ষষ্ঠ ও সপ্তম ভাগের মাঝখানে পুরুষ জোনাকির আলোর যন্ত্রটি থাকে । এটা তলার দিকে । যে অংশ থেকে আলো বেরোয় তার ঠিক উপরেই আছে আরেকটি স্তর । এই স্তর আলোর প্রতিফলনে সাহায্য করে । আলোক যন্ত্রের কোষগুলো রাসায়নিক বিক্রিয়ায় যে আলো তৈরি করে তাতে কোনো উত্তাপ তৈরি হয় না । তাই এই ধরনের আলোকে ঠাণ্ডা আলো বলে । স্নায়ুর মাধ্যমে সংকেত পেয়ে আলোর যন্ত্রের কোষে অবস্থিত লুসিফেরিন অক্সিজেনের সাথে যুক্ত হয়ে জারিত লুসিফেরিন তৈরি হয় । জারিত লুসিফেরিন থেকেই আলো নির্গত হয় । লুসিফেরিন একধরনের এনজাইম । জোনাকির শরীরে সংকেত পাঠানোর জন্য তেমন কোনো ব্যবস্থা না থাকায় রাতে আলো জ্বালিয়ে পুরুষ জোনাকি স্ত্রী জোনাকির সন্ধানে ঘুরে বেড়ায় । এই আলোর সংকেত দেখে স্ত্রী জোনাকি এসে ধরা দেয় । প্রসঙ্গত , প্রত্যেক জোনাকির আলো জ্বলা-নেভার ভিন্ন ভিন্ন সময় রয়েছে । আর এই জ্বলা-নেভার ভিন্নতা সৃষ্টি হয় তাদের প্রজাতিগত ভিন্নতা থেকে ।

তুমি আঁধার বাঁধন ছাড়িয়ে ওঠো , তুমি ছোটো হয়ে নও গো ছোটো ,
জগতে যেথায় যত আলো সবায় আপন ক’রে ফেলেছ ।।

জোনাকির দেহের পিছন দিকে বক্স লাইটের মতো একটা জায়গা থাকে , যার ভেতরে থাকে দুই ধরনের রাসায়নিক পদার্থ লুসিফেরেজ ও লুসিফেরিন । আলো উৎপাদনের প্রধান বস্তু লুসিফেরেজ । এই ধরনের আলো উৎপাদনের পদ্ধতিকে বলা হয় ‘ বায়োলুমিনেসেন্স ‘ । লুসিফেরেজের কাজ হচ্ছে জোনাকি পোকার খাদ্যশক্তিকে কাজে লাগিয়ে আলো উৎপন্ন করা । অক্সিজেন , ক্যালশিয়াম , এডোনোসিন ট্রাইফসফেট ও লুসিফেরিন মিলে এই আলো সৃষ্টি করে । আলো জ্বলে থাকার পিছনে নাইট্রিক অক্সাইডের ভূমিকাও রয়েছে । এই আলোতরঙ্গের দৈর্ঘ্য ৫১০ থেকে ৬৭০ ন্যানোমিটার । সাগরের তলদেশে অনেক প্রাণী থাকে যারা আলো জ্বালাতে পারে । কিন্তু স্থলভাগে জোনাকি ছাড়া আর কোনো প্রাণীর আলো জ্বালার ক্ষমতা নেই । তাই জোনাকি মানুষের কাছে রহস্যময় ও আকর্ষণীয় । রাতের আঁধারে অজস্র মিটমিটে আলোয় এক অত্যাশ্চর্য মায়াবী পরিবেশ সৃষ্টি করে এই জোনাকির দল । মানুষ এই আলোর খেলা দেখে যে শুধু মুগ্ধই হয় তা নয় , প্রেরণাও পায় । জোনাকি যদি এতো অল্প আয়ু নিয়ে এতো অল্প রসদের সাহায্যে সারা পৃথিবীকে আলোয় আলোয় ভরিয়ে দিয়ে যেতে পারে, তাহলে মানুষ পর্যাপ্ত আয়ু ও রসদ নিয়েও কৃপণের মতো ঘরের কোনে বসে থাকবে কেন ?

আরও পড়ুন- শ্রীনিবাসন সম্পদ কুমারের বই প্রকাশ “হিমায়িত তরঙ্গ” ও “ইমো”

Previous articleশ্রীনিবাসন সম্পদ কুমারের বই প্রকাশ “হিমায়িত তরঙ্গ” ও “ইমো”
Next articleমার্কিন মুলুকে শপিংমলের ভেতরে এলোপাথাড়ি গু.লি! শিশু সহ নি.হত কমপক্ষে ৯