Saturday, May 3, 2025

‘সায়োনারা বেলাফন্টে স্যার’, উৎপল সিনহার কলম

Date:

Share post:

উৎপল সিনহা

হ্যারি বেলাফন্টে সমুদ্র গলায় ধ’রে রাখা একটি লোক আমার কাছে ,
আর আশ্চর্য এক
গল্প বলা কণ্ঠ ।
আমাদের গাঁ-গঞ্জের সেই
কথক ঠাকুরের মতন ,
শুনলে মনে হয় , এই তো ,
কথকতা শেষ হলেই
ঘরে পিদিম জ্বলবে ,
ডেকে উঠবে কমলি গাই ,
চিঁড়ে মুড়ি আর
হরির লুটের বাতাসা গুছিয়ে ঠাকুর রওনা দেবে ছেলেপুলের পাল নিয়ে ঘরপানে ।
ঘরপানে পাড়ি দিলেন
কথক হ্যারি , বা অন্য কোনো
গঞ্জে গেলেন হয়তো
গল্প-গানের ঝুলি নিয়ে ;
যাওন নাই , ফেয়ার ওয়েল
পেলাম না যে আমরা …
( কবিতা : চলে যেতে নেই ,
দেবযানী দত্ত )

যারা ‘ চিরকাল টানে দাঁড় ,
ধরে থাকে হাল ‘ , যারা
‘ কাজ করে নগরে বন্দরে ‘ ,
গ্রাম গ্রামান্তরে , তারা সবাই বেলাফন্টের গানের চরিত্র ।
বেলাফন্টের গানে যে তাদেরই সুখ-দুঃখ সুরে সুরে গাঁথা । বেলাফন্টে এক রূপকথা , এক প্রবাদ । গলা মিলিয়ে কতবার যে গেয়েছি জামাইকা ফেয়ার ওয়েল । সেই যে , ছোট্ট মেয়েটিকে ছেড়ে রুজিরুটির সন্ধানে দূরদেশে পাড়ি দেওয়া নিঃসঙ্গ বাবা গাইছেন বিষাদগাথা :
‘ ডাউন দ্য ওয়ে হোয়্যার দ্য নাইটস আর গে এন্ড দ্য সানশাইনস ডেইলি অন দ্য মাউন্টেন টপ … ‘
এই গানেই তো অমর হয়ে আছে স্মৃতিমেদুর
‘ কিংস্টন টাউন ‘ । আর হ্যাঁ , এই গানের স্থায়ীর শেষ অংশটুকুই তো চিরস্থায়ী বিষাদশলাকার মতো গেঁথে আছে বিশ্বময় শ্রোতাদের হৃদয়ে ।
‘ … বাট আই’ম স্যাড টু সে
আই অ্যাম অন মাই ওয়ে
ওন্ট বি ব্যাক ফর মেনি এ ডে
মাই হার্ট ইজ ডাউন
মাই হেড ইজ টার্নিং অ্যারাউন্ড
আই হ্যাড টু লিভ এ লিটল গার্ল ইন কিংস্টন টাউন ‘ ।

হ্যারি চলে গেলেন ২৫ এপ্রিল ২০২৩ , চিরদিনের মতো । কয়েকটা প্রজন্মের রঙিন ছোটবেলা , রৌদ্রদগ্ধ যৌবন , মন খারাপ করা বিকেল আর আলোআঁধারির জীবনসন্ধ্যাগুলো বেলাফন্টের প্রাণখোলা কথা ও সুরের মায়াজালে আচ্ছন্ন । দীর্ঘ জীবন , কত দুঃখতাপ , তবুও আনন্দও কিছু কম নয় । কাজের খোঁজে ভিনদেশে যাওয়া বাবা , ডকে রাতভর কাজ করা শ্রমিক , মজদুর প্রেমিকের অস্থির মন , প্রেম , প্রতিবাদ , বিক্ষোভ -বিদ্রোহ আর প্রথা ভাঙার স্পর্ধা , এইসব নিয়েই তো হ্যারির গান । বেলাফন্টে মানে আমেরিকায় ব’সে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে গান । গান যেন স্লোগান । বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা , ধিক্কার । বেলাফন্টে মানে নিষ্ঠুর শ্বেতাঙ্গদের দিকে নিজের সুদর্শন কালো শরীরটা ছুঁড়ে মারা । ক্লান্তিহীন মানুষের জীবনসমুদ্রে নিরবচ্ছিন্ন ভেসে চলা , আর দেশকালের সীমানা ছাড়িয়ে মহাজীবনের চিরন্তন সুর জড়িয়ে থাকে হ্যারি বেলার গানে ।

বেলাফন্টে একজন আমেরিকান গায়ক , গীতিকার ও সুরকার । পুরো নাম হ্যারল্ড জর্জ বেলাফন্টে জুনিয়র । আমেরিকার নিউইয়র্ক সিটিতে জন্ম ১৯২৭ সালের ১ মার্চ । মৃত্যুও সেখানেই ৯৬ বছর বয়সে । তিনি একাধারে অভিনেতা ও মূর্ত প্রতিবাদ । ক্যালিপসো সঙ্গীতকে আমেরিকা সহ গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়ায় তাঁর বিশাল ভূমিকা । আমাদের প্রিয় কবি নজরুলের মতোই হ্যারিও কখনো পরোয়া করেন নি নিজের বাঁচা না বাঁচা ( অর্থাৎ শাশ্বত হওয়ার বাসনা ) নিয়ে । বারবার সাড়া দিয়েছেন যুগের হুজুগে , সময়ের অমোঘ ডাকে , ইতিহাসের অনিবার্য আহ্বানে । তাঁকে নিয়ে বিতর্কও কম হয় নি । কিন্তু কোনোভাবেই তাঁকে থামানো যায় নি । কেড়ে নেওয়া যায় নি তাঁর মুখের অনাবিল হাসি , আর বুকের অফুরান গান । মানুষকে ভালোবেসে তাঁর এই দীর্ঘ সফর লড়াই সংগ্রামের ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায় । বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনে মার্টিন লুথার কিংয়ের ঘনিষ্ঠ সহযোগী বেলাফন্টে ক্যারিবিয়াল লোকগীতির সুরে বুঁদ করে দেন গোটা বিশ্বকে । তাঁর বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তার মূলে এই গান । সর্বহারার মনের কথা বারবার উঠে এসেছে হ্যারির গানে । আমেরিকায় বসবাস করেও বেলাফন্টে আজীবন বামপন্থী রাজনীতিকে সমর্থন করেছেন । ‘ দ্য বানানা বোট সং ‘ , ‘ জাম্প ইন দ্য লাইন ‘ ,

‘ কারমেল জোন্স ‘ ,
‘ আইল্যান্ড ইন দ্য সান ‘ ,
‘ অডস এগেইনস্ট টুমরো ‘ ইত্যাদি গান সারা পৃথিবীকে বারবার আলোড়িত করেছে । সমাজকর্মী ও মানবদরদী বেলাফন্টে প্রকৃত অর্থেই হয়ে উঠেছিলেন ‘ লার্জার দ্যান লাইফ’ ।

জাতিবিভেদের আগল ভেঙে দিয়েছিলেন হ্যারি । নাগরিক আন্দোলন অন্য মাত্রা পেয়েছিল তাঁর সুরময় সৃষ্টিতে । এক জামাইকান পরিবারে জন্ম নেওয়া এই শিল্পীর শৈশব জুড়ে দারিদ্র ছিল নিত্যসঙ্গী । তাই বোধহয় তিনি হয়ে উঠেছিলেন দীনবন্ধু । সঙ্গীতে সাদা-কালোর বিভাজন তিনি ধুয়েমুছে সাফ করে দিয়েছিলেন । ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন বর্ণবৈষম্যের বেড়া । তাঁর কনসার্টে উপচে পড়তো জনসমুদ্র ।
‘ শেক শেক সেনোরা ‘ ,

আরও পড়ুন- বাগদান সম্পন্ন, হাতে হাত রেখে পথ চলার প্রমিস পরিনীতি-রাঘবের!

‘ মাটিল্ডা ‘ , ‘ লিড ম্যানহোলার ‘ বেলাফন্টের ঐতিহাসিক সৃষ্টি । জামাইকান মেন্টো লোকগানের সঙ্গে ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগো ক্যালিপসোর স্টাইল মিলিয়ে মিশিয়ে একাকার করে দেন হ্যারি । আনেন এক অসামান্য মিশ্রণ শৈলী । সারাজীবনে অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান পরিবারের এই কৃতি সন্তান । সারা বিশ্বময় শ্রোতাদের বিশ্বমানবতার পাঠদান করে গেছেন গানের মাধ্যমে । মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্টের ক্ষেত্রে সবসময়েই পরীক্ষা নিরীক্ষা করতেন তিনি , পুরোনোকে ভেঙে নতুন ক’রে গড়ায় বিশ্বাসী এই শিল্পীর উপস্থাপনাও ছিল নজরকাড়া । তাঁর কোকোনাট উয়োম্যান ও কটন ফিল্ডস শুনে মুগ্ধ হন নি এমন শ্রোতা পাওয়া যাবে না ।

‘ দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি ,
আমি চললাম , অনেকদিন আর ফিরবো না ‘ ।
ও সমুদ্রকণ্ঠী কথক ঠাকুর , খুব বেশিদিন দূরে থেকো না তুমি । তোমার ছোট্ট মেয়েটি যে বসে আছে তোমার পথ চেয়ে । আর শুধু তো তোমার নয় , সারা পৃথিবীর সমস্ত মানুষের মন প’ড়ে আছে তোমার সাধের কিংস্টন টাউনে । ফিরে এসো , যেভাবেই হোক ফিরে এসো
হ্যারি স্যার ।

 

 

 

spot_img

Related articles

রাজনৈতিক একনায়কতন্ত্র! গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় ভারতকে টপকালো বাংলাদেশও

বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচারে সরব হয়েছিল ভারত। অথচ দেখা যাচ্ছে ক্ষমতা হস্তান্তর হওয়া বাংলাদেশেও গণমাধ্যমের (mass media) স্বাধীনতা...

বিবাহ বিচ্ছেদের পথে যিশু! সারা-নীলাঞ্জনাকে সোশ্যাল মিডিয়ায় আনফলো অভিনেতার

দীর্ঘ একুশ বছরের দাম্পত্যে কি তাহলে পাকাপাকিভাবে বিচ্ছেদের সিলমোহর পড়তে চলেছে? যীশু সেনগুপ্ত (Jishu Sengupta)ও নীলাঞ্জনা সম্পর্ক নিয়ে...

পাকিস্তান থেকে পণ্য আমদানিতে না ভারতের, ঢুকবে না পাক পতাকার জাহাজ

জলে মারার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়েছে। অপেক্ষা ছিল পাকিস্তানি পণ্যের উপর নিষেধাজ্ঞারও। এবার স্থলপথ ও জলপথে পাকিস্তান থেকে কোনও...

উইকেন্ডে সামান্য কমলো হলমার্ক সোনার দাম! 

শনিবারে সোনার দামে (Gold Price today) বড়সড় পরিবর্তন না হলেও হলমার্ক সোনার দাম ৯০ হাজারের নীচে পৌঁছেছে বলে...