Sunday, August 24, 2025

‘অদ্বৈত কচ্ছপ’, উৎপল সিনহার কলম

Date:

Share post:

উৎপল সিনহা

অদ্বৈত কচ্ছপের কথা মনে পড়ে ? যার মৃত্যুর পরে এক মর্মস্পর্শী শোকগাথায় অদ্বৈতকে ‘ প্রপিতামহ ‘ বলেছিলেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় , মনে নেই ? কলকাতার আলিপুর চিড়িয়াখানার সেই অতি দীর্ঘায়ু কচ্ছপ ! অদ্বৈত।

ধীর , স্থির , প্রাজ্ঞ এবং জগতসংসার সম্পর্কে যেন নির্লিপ্ত । আশ্চর্য সেই প্রাচীন প্রাণীটি । অসংখ্য দর্শনার্থী রোজ ভিড় করে অদ্বৈতকে দেখার জন্য । তারা অবাক হয় , মজা করে , কেউ কেউ অতি উৎসাহে ঢিলও ছোঁড়ে প্রপিতামহের লোলচর্মের ওপরে প্রকৃতিদত্ত বর্মের গায়ে । আঘাত লাগে , ব্যথা পায় । তবু অদ্বৈত নির্বিকার , ভ্রুক্ষেপহীন । ইতিহাসের কত যে উত্থানপতনের সাক্ষী সে ! স্বচক্ষে দেখেছে কত ভূমিকম্প , বন্যা , মারি ও মড়ক , দেখেছে মন্বন্তরের গ্রাম নগর , দেখেছে কত যে যুগসন্ধিক্ষণ !

অদ্বৈত শব্দের অর্থ এক বা একমাত্র , যার কোনো দ্বিতীয় নেই । সিসিলি থেকে আনা আরও চার কচ্ছপের সঙ্গে ‘ অ্যালডাবরা জায়ান্ট টরটয়েজ ‘ ( পুরুষ আলদাবরা দৈত্য কচ্ছপ ) প্রজাতির কচ্ছপটি প্রথমে ছিল ব্যারাকপুরে , রবার্ট ক্লাইভের বাগানবাড়িতে । ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধ জেতার পরে ক্লাইভকে উপহার দেওয়া হয় কচ্ছপগুলি । অদ্বৈতকে আলিপুর চিড়িয়াখানায় আনা হয় ১৮৭৫-৭৬ সালে । সেখানে ২৩১ বছর কাটিয়ে ২০০৬ সালের ২২ মার্চ মারা যায় অদ্বৈত । বয়স হয়েছিল ২৫৫ বছর ৩ মাস । ( ১৭৫০ — ২০০৬ সাল ) । ২৫০ কেজি ( ৫৫১ পাউন্ড ) ওজনের অদ্বৈত ছিল এক একাকী প্রাণী , যার বংশের কোনো রেকর্ড নেই । এর খাদ্য ছিল গমের ভুসি , গাজর , লেটুস , ভেজানো ছোলা , রুটি , ঘাস ও লবন । ২০০৫ সালের শেষের দিকে এই অতি প্রাচীন কচ্ছপের খোলা বা খোসা ফেটে যায় এবং ফাটলের নিচে মাংসে একটি ক্ষত তৈরি হয় ।

প্রসঙ্গত , অদ্বৈতের অন্যতম মালিক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন প্রভাবশালী সদস্য রবার্ট ক্লাইভ , যিনি আফিমে আসক্ত হয়েছিলেন এবং ১৭৭৪ সালে আত্মহত্যা করেন । তারপর থেকে কচ্ছপটির মালিকানা বদল হয় একাধিকবার । কিন্তু অদ্বৈত এরপরেও বহাল তবিয়তে আরও দু’শো বছরের বেশি বেঁচেছিল । শতাব্দীপ্রাচীন অদ্বৈত কচ্ছপ কিন্তু সন্তানের জন্ম দিতে পারে নি । তার কোনো উত্তরাধিকার রইলো না পৃথিবীতে ।

সবচেয়ে দীর্ঘজীবী প্রাণীদের অন্যতম কচ্ছপ । আলডাব্রা কচ্ছপগুলি পৃথকভাবে এবং পালের মধ্যে পাওয়া যায় , যাদের বেশিরভাগ খোলা তৃণভূমিতে জড়ো হয় । এরা সকালে বেশি সক্রিয় থাকে , যখন তারা চারণে থাকে এবং ব্রাউজিং করে । এরা মাটি খুঁড়তে পারে এবং ছায়াঘেরা গাছের নিচে বা ছোট গুহায় লুকিয়ে থাকে অথবা দিনের গরমে ঠাণ্ডা থাকার জন্য পুকুরে বা অন্য জলাশয়ে ডুবে থাকে । এদের প্রজননের সময় ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত । স্ত্রী কচ্ছপ ৩০ সেন্টিমিটার গভীর গর্তে ৯ থেকে ২৫ টি শক্ত খোসাযুক্ত ডিম পাড়ে জুলাই- সেপ্টেম্বর নাগাদ ।‌

অদ্বৈত কচ্ছপের মৃত্যুর সময় তার দেহে পুরোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায় । পরিখার মধ্যে থাকলেও বিরল প্রজাতির এই অতিকায় প্রাণীটি কোনোভাবে আঘাত পেয়ে জখম হয়েছিল মনে করা হয় । দর্শকদের ছোঁড়া নুড়ি পাথরের আঘাতেই সম্ভবত আহত ও বিক্ষত হয়েছিল অদ্বৈত । সেই ক্ষত আর সারে নি । যদিও নিজের জিন পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে সঞ্চারিত করে যেতে পারে নি বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন এই স্থলজ প্রাণীটি , তবুও সুদীর্ঘকাল পৃথিবীর নানা পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করে এক বিশাল ইতিহাসের অংশ হয়ে রয়ে গেছে অদ্বৈত । সরীসৃপ প্রজাতির প্রাণী কচ্ছপেরাও তো আজ বিপন্ন । দূষণ , খাদ্যাভাব , জলাশয়ের অভাব , মানুষের আক্রমণ , অরণ্যনিধন ইত্যাদি কচ্ছপদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে দুর্বিষহ করে তুলেছে ।
শঙ্খ ঘোষ লিখেছেন ,
” এত যদি ব্যূহচক্র
তীর তীরন্দাজ , তবে কেন
শরীর দিয়েছ শুধু ,
বর্মখানি ভুলে গেছ দিতে ! ”

প্রকৃতি কচ্ছপকে কিন্তু বর্ম দিয়েছে । আত্মরক্ষার প্রধান অবলম্বন কচ্ছপদের শরীরের উপরিভাগের শক্ত খোসা বা খোল । আর দিয়েছে সুদীর্ঘ আয়ুষ্কাল । অদ্বৈতকে দিয়েছে একাধিক শতাব্দীকে একসাথে দেখার সৌভাগ্য । ইতিহাসকে স্বচক্ষে দেখার বিরল সুযোগ । তবুও আমাদের আক্ষেপ আরও বেশ কয়েকটি বছর অনায়াসে বাচঁতে পারতো অদ্বৈত । চিড়িয়াখানার দর্শকেরা মজা করতে গিয়ে ভুলে গেলো ২৫০ বছরের প্রাচীন বর্ম বা খোসা হাড় ও চামড়ার মতোই বয়সের সঙ্গে সঙ্গে জীর্ণ থেকে জীর্ণতর হয় , তখন তুচ্ছ ইটের আঘাত বোমার আঘাতের মতো বিদীর্ণ করে বর্ম , ঠেলে দেয় মৃত্যুর দিকে ।
ক্ষমা করো ‘প্রপিতামহ’ অদ্বৈত ।

আরও পড়ুন- কবজ সিস্টেম ছিল না কেন? রেলমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করে তো.প দাগলেন অভিষেক

spot_img

Related articles

দরিদ্রতম মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, দেশে সবচেয়ে ধনী মুখ্যমন্ত্রী কে? রইল তালিকা

দেশে কোটিপতি মুখ্যমন্ত্রীদের ভিড়ে ব্যতিক্রম শুধু একজন। তিনি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়(Mamata Banerjee)। বর্তমানে দেশে সবথেকে গরিব মুখ্যমন্ত্রী তিনি।...

ধর্ষিত মূক- বধির-বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন কিশোরীর পাশে নেই যোগী সরকার!

যোগীরাজ্যে(Yogi Adityanath) মূক ও বধির বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন কিশোরীর(Disabled Girl) নৃশংস ধর্ষণ (Brutal Rape)। পাশে দাঁড়ায়নি সরকার। ফলে মেয়েকে...

পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য ‘শ্রমশ্রী’ প্রকল্পে নাম নথিভুক্তি শুরু

পরিযায়ী শ্রমিকদের সুবিধার্থে এবার আরও এক পদক্ষেপ রাজ্য সরকারের। ‘আমাদের পাড়া আমাদের সমাধান’ কর্মসূচির আওতায় দুয়ারে সরকার শিবিরেও...

‘নিখুঁত ভুলগুলি’, উৎপল সিনহার কলম

একটা দুঃখের কথা পথে ও বিপথে ঘুরে প্রত্যাখ্যাত হতে হতে গান হয়ে ওঠে ...একটি দুঃখের কথা পথে ও বিপথে ঘুরে প্রত্যাখ্যাত হতে হতে গান...