‘মহীনের ঘোড়াগুলি’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

” আমরা যাইনি ম’রে আজো— তবু কেবলি দৃশ্যের জন্ম হয় ;

মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে ;
প্রস্তর যুগের সব ঘোড়া যেন — এখানে ঘাসের লোভে চরে
পৃথিবীর কিমাকার ডায়নামোর প’রে । “

ঘোড়া কি সময়ের প্রতীক ? মহীন নামে কোনো সহিসের ঘোড়া কি ? মহীনের ঘোড়াগুলো মানে সুপ্রাচীন মহেঞ্জোদড়ো নগরের ঘোড়া নয় তো ? ” প্রস্তর যুগের সব ঘোড়া যেন — এখানে ঘাসের লোভে চরে … ” , জীবনানন্দের কবিতায় ইতিহাস চেতনা থাকবে না , তা কি হয় ? আর মহীনের’ ঘোড়াগুলি ‘ ? ঘোড়াগুলো কীভাবে হয়ে গেল ‘ ঘোড়াগুলি ‘ ? কেনই বা হলো ? সে এক বিরাট বৃত্তান্ত।

১৯৭৫ সালে কলকাতার কয়েকজন তরুণ সঙ্গীতশিল্পীর উদ্যোগে গড়ে ওঠে একটি বাংলা ব্যান্ড । নাম রাখা হয় ‘ মহীনের ঘোড়াগুলি ‘ । ঘটনাটি অনেকটাই আকস্মিক । হয়তো খানিকটা অ্যাবসার্ডও । কেননা তখনকার কলকাতার সারস্বত মহলে
‘ সুররিয়ালিজম ‘ ,
‘ যাদুবাস্তবতা ‘ , কিংবা
‘ অ্যাবসার্ডবাদ ‘ ইত্যাদি শব্দগুলো ভীষণভাবে চর্চিত ছিল । তারই মধ্যে জায়গা করে নিতে চাইলো ‘ মহীনের ঘোড়াগুলি ‘ ।
গৌতম চট্টোপাধ্যায় , বিশ্বনাথ চট্টোপাধ্যায় , প্রদীপ চট্টোপাধ্যায় , রঞ্জন ঘোষাল , আব্রাহাম মজুমদার , তাপস দাস ও তপেশ চট্টোপাধ্যায় , এই সাতজন শিল্পী মিলে তৈরি করেন মহীনের ঘোড়াগুলি , যা শুধু বাংলা নয় , ভারতের প্রথম রক ব্যান্ড । যাদের যাত্রা শুরু কলকাতায় । আমেরিকান , লাতিন , রক , জ্যাজ , লোক ও বাউল , বিভিন্ন সঙ্গীত ধারায় নিরীক্ষা মূলক কাজ এবং এসবের মিশ্রণ থাকায় এই ব্যান্ডটিকে নির্দিষ্ট কোনো সঙ্গীত শৈলীর শ্রেণীভুক্ত করা যায় না । বাউল গান ও বাংলা রক ধারায় লোক ঐতিহ্যের স্বাধীন চর্চার পাশাপাশি প্রায়ই নব নব উদ্ভাবনী উপায়ে শাস্ত্রীয় উপাদান একত্রিত করার কারণে মহীনের ঘোড়াগুলিকে লোক রক সঙ্গীত ব্যান্ড বলা যেতে পারে ।

সত্তর দশকে দলটি গড়ে উঠলেও প্রাথমিকভাবে জনপ্রিয়তা অর্জনে ব্যর্থ হয় । সেই সময়ে গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের গানে আমূল নতুনত্ব থাকলেও মানুষ প্রথমে তা গ্রহণ করে নি । সেই সময় চলচ্চিত্রের গান বানিজ্যিকভাবে প্রভাব বিস্তার করায় বাংলা গানের জগতে একধরনের স্থবিরতা দেখা যাচ্ছিল । সমকালে তেমন জনপ্রিয়তা না পেলেও পরবর্তীকালে তাঁদের কাজকর্ম মান্যতা পায় এবং বর্তমানে বাংলা গানের বাঁক বদলের দিশারী রূপে দেখা হয় মহীনের ঘোড়াগুলির রূপকারদের । প্রগতিশীল তথা জীবনমুখী গান , সমাজ বাস্তবতা ও নৈতিক সঙ্গীত দর্শনের কারণে বর্তমানের মূল্যায়ণে নতুন ধারার বাংলা গানের পথিকৃৎ রূপে মান্যতা পায় মহীনের ঘোড়াগুলি । ইতিহাসের বিচার বোধহয় এমনই নির্মম । সমকালে যাঁরা বিতর্কিত , ধিকৃত , তীব্র সমালোচিত ও চরম নিন্দিত হন , তাঁরাই পরবর্তীকালে হন বন্দিত ও পূজিত । আজ বেশ বোঝা যায় সময়ের থেকে অনেকটাই এগিয়ে ছিলেন মহীনের ঘোড়াগুলি । ইতিহাস আজ তাঁদের কুর্নিশ করে ।

” আমি ডান দিকে রই না
আমি বাম দিকে রই না
আমি দুই দিকেতেই রই
পরাণ জলাঞ্জলি দিয়া রে । ”
অথবা ,
” কত কি করার আছে বাকি
বেলা বয়ে যায়
কি ক’রে এভাবে আমি থাকি ।
ভেবে ভেবে সারাদিন কাটে
বলো কি উপায় ,
তোমারও কি এরকম ঘটে ? ”
কিংবা ,
” কাঁপে কাঁপে , আমার হিয়া কাঁপে
এ কি যে কাণ্ড ,
একি কাণ্ড , সব পন্ড , এ ব্রক্ষ্মাণ্ড শূন্য লাগে ,
তুমি ছাড়া শূন্য লাগে । “

এই সবই মহীনের ঘোড়াগুলির গান । এছাড়াও এঁদের বিখ্যাত গান :
” পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে
স্যাটেলাইট আর কেবলের হাতে ড্রয়িংরুমে রাখা বোকা বাক্সতে বন্দী … ”
এই গানেই রয়েছে সমসময়ের সেই অমোঘ সত্য , যা সমগ্র মানবজাতির পক্ষেই যথেষ্ট উদ্বেগের । তা হলো , মানুষ ভয়াবহ যান্ত্রিকতায় আজ আক্রান্ত । উবে যাচ্ছে আবেগ ও ভালোবাসা । ঠুনকো হয়ে আসছে মানবিক সম্পর্কগুলো । সব থাকতেও আজ বড়ো একা , বড়োই নিঃসঙ্গ মানুষ ।
” ভেবে দেখেছো কি
তারারাও যত আলোকবর্ষ দূরে
তারও দূরে
তুমি আর আমি
যাই ক্রমে সরে সরে । ”
আরবান রক ঘরানায় আধুনিক বাংলা গানের স্রষ্টা মহীনের দল । পৃথিবীব্যাপী যখন গানের ইতিহাস বদলে যাচ্ছে , যখন বব ডিলান , জর্জ হ্যারিসন , জিম মরিসন প্রমুখেরা ক্লাসিক সঙ্গীতকে ভেঙে দাঁড় করিয়ে ফেলেছেন নতুন ফর্ম , ঠিক তখনই বাংলা গানের চাঁদ-ফুল-জোছনার নাগপাশ থেকে ছিটকে বেরিয়ে মহীনের ঘোড়াগুলি বাংলা গানকে মুক্তি দিয়েছিল এক পশলা ভালোবাসা , স্বাধীনতা , একাকীত্ব , রাজনীতি,বিপ্লব , দারিদ্র ,অন্যায় , নিপীড়ন , যৌনপেশা আর নাগরিক জীবন যাপনের মিশেলে । তথাকথিত গতানুগতিকতার নিকুচি করাই ছিল মহীনের ঘোড়াগুলির প্রধান কাজ ।

মহীনের ঘোড়াগুলি ছিল একটা কমিউনিটি , যারা তথাকথিত অনিয়মগুলোকেই নিয়ম ব’লে বিশ্বাস করতো । নিয়ম অনিয়ম নিয়ে প্রশ্ন তুলতো ক্ষণে ক্ষণে । মেজরে মাইনরে , ফিশনে ফিউশনে মিলিয়ে মিশিয়ে ভাঙতে ভাঙতে নতুন এক মোহনায় , নতুন এক গানসীমানায় তারা নিয়ে যেতে চেয়েছিল বাংলা গানের শ্রোতাদের । তারা সমকালে বাহবা পায় নি । কিন্তু আজ এমন শ্রোতারাও আছেন , যাঁরা সিনেমা হলে জাতীয় সঙ্গীত বাজলে বসেই থাকেন , কিন্তু রাস্তাঘাটে মহীন শুনলে দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে যান । অথচ মহীনের কনসার্টের পর তৎকালীন জনপ্রিয় ও প্রতিষ্ঠিত খবরের কাগজে লেখা হয়েছিল , ‘ বখে যাওয়া যুবকের দল ‘ ।

আরও পড়ুন- সওকতের সঙ্গেই ভাঙড়ের দায়িত্বে সব্যসাচী, আদিবাসী সেলের দায়িত্বে বীরবাহা

মহীনের ঘোড়াগুলি না থাকলেও অন্ধকারে আলো হ’য়ে জেগে আছে আজও তাঁদের গানগুলি , যা অবিস্মরণীয়।

১৯৯৯ সালের ২০ জুন মহীনের অন্যতম পুরোধা গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের অকাল মৃত্যু এবং ব্যান্ডটির বন্ধ হয়ে যাওয়া যেন কোনো এক প্রাচীন সভ্যতার উবে যাওয়ার দীর্ঘশ্বাস ।

 

Previous articleসওকতের সঙ্গেই ভাঙড়ের দায়িত্বে সব্যসাচী, আদিবাসী সেলের দায়িত্বে বীরবাহা
Next articleBreakfast news : ব্রেকফাস্ট নিউজ