‘দ্য মিথ অফ সিসিফাস’, উৎপল সিনহার কলম

0
1
উৎপল সিনহা

” যে লেখে সে কিছুই
বোঝে না
যে বোঝে সে কিছুই
লেখে না
দুজনের দেখা হয়
মাঝেমাঝে ছাদের কিনারে
ঝাঁপ দেবে কিনা ভাবে
অর্থহীনতার পরপারে !
( বোধ , শঙ্খ ঘোষ )

লোকটা মৃত্যুকে ধোঁকা দিয়েছিল । একবার নয় , দু’দুবার । মৃত্যুকে বারবার বোকা বানানো যায় ? তৃতীয়বার ধরা পড়লো সে । মৃত্যুর সঙ্গে প্রতারণা করার শাস্তি পেলো সে । কঠোর সে দণ্ড । ফাঁসি নয় , যাবজ্জীবন কারাবাস নয় , অনন্ত ব্যর্থতাভোগের দণ্ড । সেটা কেমন ?

বিশাল এক পাথর তাকে ঠেলে নিয়ে যেতে হবে পাহাড়ের চূড়ায় । কিন্তু লোকটা যখনই পাথর ঠেলে চূড়ার কাছে পৌছায় , পাথর নিচে গড়িয়ে পড়ে । লোকটা আবার নিচে নেমে পাথর ঠেলে ঠেলে চূড়ায় তোলে , আবার সেটা নিচে গড়িয়ে পড়ে । এভাবেই অনন্তকাল ধরে চলতে থাকে শাস্তি । অতি চালাকের গলায় দড়ি ! অর্থাৎ অভিশপ্ত জীবন । লোকটা কিন্তু যেমন তেমন সাধারণ নয় । সে রাজা । তার নাম সিসিফাস । ‘

সিসিফাস ‘ হোমারের ‘ ইলিয়াড’ -এ বর্ণিত গ্রীক পুরাণের একটি চরিত্র , প্রাচীন এফিরিয়া বা কোরিন্থের রাজা । এই রাজার ঔদ্ধত্য ও কয়েকটি খারাপ কাজের জন্য দেবতারা তার ওপর ক্ষিপ্ত ছিলেন । তার ওপর দু’দুবার মৃত্যুর সঙ্গে প্রতারণা করায় দেবতারা তাকে অনন্তকালের শাস্তি দিতে বাধ্য হন । সিসিফাসের এই শাস্তির এক অভিনব ব্যাখ্যা দিয়ে গেছেন নোবেল বিজয়ী ফরাসি লেখক ও দার্শনিক আলবের কামু । তিনি তাঁর ‘ দ্য মিথ অফ সিসিফাস ‘ গ্রন্থে মানুষের জীবনের অর্থহীনতার সঙ্গে এই অভিনব কঠোর শাস্তির তুলনা করেছেন ।

কামু বলেছেন , সিসিফাস যখন পাথর ঠেলে তোলে , তখন সে হাসিমুখে সেই কাজটা করে , একটু আগে কী ঘটেছে , একটু পরে কী ঘটবে , এসব তার ভাবনাতে থাকে না । কামু মূলত তাঁর অ্যাবসার্ড বিষয়ক দর্শনকে ব্যাখ্যা করেছেন সিসিফাসের এই কাজের মাধ্যমে । মানুষের নিরর্থক অর্থ খুঁজে বেড়ানোর প্রচেষ্টা , ঈশ্বরহীন দুর্বোধ্য পৃথিবীর একতা , স্বচ্ছতা , সত্য ও মূল্যবাধসমূহ তাঁর আলোচনার বিষয় ।‌ কামু বলেছেন , আত্মহত্যা নয় , সত্যিকারের অ্যাবসার্ডের উপলব্ধির জন্য দরকার ‘ বিদ্রোহ ‘ । শেষপর্যন্ত সিসিফাসকে নাকি ‘ সুখী ‘ কল্পনা করাই ভালো । কারণ তার অন্তহীন প্রয়াস ছিল উচ্চতার শীর্ষে পৌঁছানোর । পরিণাম যাই হোক না কেন , উপরে ওঠার সংগ্রামটাই আসল ।

জ্ঞানী ব্যক্তিরা যুগে যুগে সিসিফাসের এই কাজের ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন নানাভাবে । এ ক্ষেত্রেও নানা মুনির নানা মত । কিন্তু সবগুলোই দারুণ আকর্ষণীয়। মনে হয় যেন প্রতিটিই অব্যর্থ। কেউ বলেছেন এটা প্রতিদিনের সূর্য ওঠা ও অস্ত যাওয়ার সঙ্গে তুলনীয় । কেউ বা বলেছেন এটা সমুদ্রের জোয়ার-ভাটা । চলতেই থাকে অনন্তকাল ।

দার্শনিক লুকরেটিয়াস বলেছেন , সিসিফাস হলো সেই রাজনীতিক , যে ক্ষমতা পাওয়ার জন্য চিরকাল চেষ্টা করে গেছে , কিন্তু বারবার ব্যর্থ হয়েছে । দার্শনিক সলোমন রিনাকের মতে , মানুষের সাধনা ও সিদ্ধিলাভের মধ্যবর্তী অবস্থা পাথর ঠেলে তোলা । চেষ্টা আর উৎকর্ষের মধ্যে যে চিরকালীন পার্থক্য , তা লাঘব করার ব্যর্থ প্রয়াসই হলো সিসিফাসের নিয়তি । এ প্রসঙ্গে মজার ব্যাখ্যাও পাওয়া যায় । স্যানসোসিস বলেছেন , শ্বাস গ্রহণ ও বর্জন হলো সিসিফাসের কাজটি । আমরা সিসি শব্দে শ্বাস নিই , আর ফাস শব্দ করে শ্বাস ছাড়ি ।
আসলে আমরা কোথাও পৌঁছোই না । পথ চেয়ে থাকার মতোই আমাদের শুধু পথ চলাতেই আনন্দ । কেন চলেছি তা আমরা জানি না ।

কোথায় চলেছি , কোথায় আমাদের গন্তব্য , অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাও আমাদের অজানা । তবুও মানুষ শেষপর্যন্ত আশাবাদী । কখনও আশা ছেড়ে নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকতে পারে না । হোক না আশা কুহকিনী ও ছলনাময়ী , তবুও আশা অন্তহীন । আজ হোক অথবা কাল , কিছু একটা ঘটবে , যা ভালো ও মঙ্গলজনক , এই সদর্থক ভাবনা থেকেই মানুষের আন্তরিক প্রয়াস জারি থাকে ।

সত্যি কথা হলো , বিশ্বব্যাপী জনগণের একটা বিশাল অংশের জীবন সিসিফাসের মতোই অভিশপ্ত । তারা সারাজীবন ধরে একই কাজ একইভাবে প্রতিদিন করে চলেছে । একঘেয়ে কাজ , ফলহীন , উদ্দেশ্যহীন , বিরামহীন । সিসিফাসের নিয়তি করুণ । সে ভাগ্যহীন । করুণাই হয় তার জন্য । কিন্তু আমাদের জন্য করুণা করবে কে ? আমাদের জীবন কি তাহলে ওই পাথরটার মতো , যেটাকে চূড়ায় তুলে দিলেও পরমুহূর্তেই গড়িয়ে পড়ে নিচে ? কে জানে !

জীবনের অর্থহীনতা ও অসামঞ্জস্যতা নিয়ে কোনো সন্দেহই থাকতে পারে না । কামু আরও বলেছেন , জীবনের কোনো মানে নেই , অথচ একে অর্থবহ করে তোলার জন্য আমরাই নানা মূল্যবোধ চাপিয়ে দিই । যদিও তাতে কিছুই বদলায় না । ড্যানিস দার্শনিক সোরেন কিয়েরগার্ড , যাঁকে অনেকেই অস্তিত্ববাদী দর্শনের জনক হিসেবে গণ্য করেন , তিনি জীবনকে অর্থবহ করে তুলতে আমরা যে সমস্ত লক্ষ্য নির্ধারণ করি এবং যেভাবে সেগুলোকে নিয়েই সারাজীবন কাটিয়ে দিই , তা নিয়ে উপহাস করেছিলেন । সোশ্যাল স্টেটাস , ধর্ম, দেশপ্রেম ইত্যাদির ‘ বাবল ‘ বানিয়ে, সেই বাবলের মধ্যে আমরা বসবাস করি । আমাদের জীবন মানেই ভালো ডিগ্রি , ভালো চাকরি , ভালো উপার্জন , চমৎকার একটি বিয়ে এবং পরকালের পথ সুগম করার জন্য ঈশ্বরের উপাসনা করা ।

কিয়েরগার্ডের প্রশ্ন , সত্তর আশি বছর ধরে উভয়সঙ্কটে দীর্ণ এই অর্থহীন জীবন বয়ে বেড়ানোর কী প্রয়োজন , তাৎক্ষণিক সাঙ্গ হলে ক্ষতি কি ? কামু বলেছেন , প্রাণধারণ ও চেতনা মূল্যবান। কিন্তু সেটার জন্য এই বিশাল, নিরুত্তর মহাবিশ্বে জীবনের অর্থ খোঁজা বা নানাভাবে অর্থ আরোপ করাটা নেহাতই ‘ মিনিংলেস ‘ ।
নাসার জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ মহাবিশ্বের যে ছবি আমাদের দেখিয়েছে তাতে কোটি কোটি গ্রহ নক্ষত্রের মাঝে পৃথিবী একটা ক্ষুদ্র বিন্দুর মতো । সেই ক্ষুদ্র বিন্দুর মতো পৃথিবীতে মানুষ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অনুকণা মাত্র ।
সেই মানুষের আবার এত বড়াই !

আরও পড়ুন- মৃ.তদে.হ সৎকার করে ফেরার পথে ভ.য়াবহ পথ দুর্ঘ.টনা রঘুনাথগঞ্জে! মৃ.ত ৩, আহ.ত ৩৬