‘প্রমিথিউসের আগুন’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

‘ ওরা প্রমিথিউস , ওরা অগ্নিযুগের গান ‘ , লিখেছেন গীতিকার সাধন দাশগুপ্ত। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় ‘ আগুনের ঠিকঠাক ব্যবহার ‘ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সঙ্কেত রয়েছে। আবার জয় গোস্বামীর কবিতায় বেণীমাধবকে ‘ আগুন জ্বলে কই ‘ প্রশ্নে বিদ্ধ করেছেন সেলাই দিদিমণি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিভিন্ন লেখায় আগুনের জয়গান গেয়েছেন ।

এতগুলো শতাব্দী পেরিয়ে যাবার পরেও মানবজাতি কেন আগুনের যথাযথ ব্যবহার শিখতে পারলো না , তা নিয়ে চিন্তাশীল মানুষের আক্ষেপ আজও রয়ে গেছে। এ কথা কিন্তু কিছুতেই অস্বীকার করা যাবে না যে আগুন হলো আধুনিক সভ্যতার প্রাণবায়ু । আগুন ছাড়া মানুষ প্রকৃতপক্ষেই অনাধুনিক , এও চরম সত্য । আগুন এক ধাক্কায় সভ্যতাকে এগিয়ে দিয়েছে লক্ষ মাইল । আগুনের পরশমণির স্পর্শে সফল ও সার্থক হয়ে উঠেছে মানবজনম ।

গ্রীক পুরাণে আছে , দেবতাদের কাছ থেকে আগুন চুরি করে মানবজাতিকে উপহার দেওয়ার জন্য কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হয়েছিল প্রমিথিউসকে । আগুনের চেয়ে মূল্যবান উপহার আর কি-ই বা হতে পারে ! আহা , অসামান্য আগুন । ফুলকে দিয়ে মানুষ বড়ো বেশি মিথ্যা বলায় ব’লে পদাতিক কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কখনোই ফুলের প্রতি কোনো মোহ ছিল না । তিনি পছন্দ করতেন আগুনের ফুলকি , যা দিয়ে কখনও মুখোশ তৈরি করা সম্ভব নয় ।

প্রমিথিউস নামের অর্থ পূর্বচিন্তা , তাই তিনি চিন্তা- ভাবনা , পরিকল্পনা , পদক্ষেপ গ্রহণ ও রূপায়ণের প্রতীক । যদিও তিনি আগুনের সাথে যুক্ত একমাত্র দেবতা ছিলেন না , তিনি প্রায়শই প্রাচীন শিল্পকর্ম ও চারুকলার সঙ্গে চিত্রিত হন। মানবজাতির সৃষ্টি এবং তাদের আগুন-আবিষ্কার ও বিকাশের প্রতীক প্রমিথিউস । গ্রীক ভাষায় ‘ মিথিউস ‘ মানে চিন্তা , তাই ‘ প্রমিথিউস ‘ মানে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণের আগে তার পরিণতি সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করা ।

গ্রীক পুরাণে টাইটান ধ্বংস প্রবণতার দেবতা। প্রমিথিউস ছিলেন দ্বিতীয় প্রজন্মের টাইটান , গ্রীক দেবতাদের একজন , যিনি মানবজাতিকে সাহায্যের জন্য তাঁর জ্ঞাতিভাই জিউসকে প্রতারণা করেছিলেন । গ্রীক পুরাণ অনুসারে প্রমিথিউস মানবজাতির প্রতি সহানুভূতিশীল এক আগুন চোর ‘ ,যিনি মানুষকে শিখিয়েছিলেন কীভাবে আগুনকে লালন-পালন ও ব্যবহার করতে হয়। ধাতুর ব্যবহার থেকে শুরু করে কাঁচা মাংস খাওয়া ছেড়ে মাংস রেঁধে খাওয়ার শিক্ষাও নাকি মানুষকে দিয়েছিলেন এই প্রমিথিউস । প্রমিথিউস এবং এপিমিথিউসকে জীবন্ত সৃষ্টি দিয়ে পৃথিবীকে পূর্ণ করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন জিউস । তিনি চেয়েছিলেন যে , তারা তাদের সৃষ্টিকে বুদ্ধি ও প্রতিভা দান করে নতুন বাসভূমিতে বেঁচে থাকা নিশ্চিত করবে । এপিমিথিউস গ্রহের সমস্ত প্রাণী সৃষ্টি করেছিলেন এবং উড়ে যাওয়া ও শিকার ধরার অনন্য ক্ষমতা ও প্রতিভায় তাদের উন্নিত করেছিলেন । প্রমিথিউস মানুষকে তৈরি করেন শ্রম দিয়ে । কাদামাটি ও জলের সাহায্যে ঢালাই করেন তাদের এবং তখনই মানুষকে আগুনের ব্যবহার শেখানোর ভাবনা তাঁর মাথায় আসে ।‌ তাই বিজ্ঞানের দেবতাও ভাবা হয় তাঁকে । আগুনের হাত ধরেই তো দাঁড়িয়ে আছে বিজ্ঞান ।

প্রমিথিউস মাউন্ট অলিম্পাসের দেব-দেবীদের কাছ থেকে আগুন চুরি করায় জিউস ভীষণ বিরক্ত হন । প্রমিথিউস মৃৎশিল্প এবং ধাতব কাজের গ্রীক দেবতা হেফেস্টাসের কর্মশালায় লুকিয়ে থাকার জন্য একটি কৌশল অবলম্বন করলেন। তিনি উঠোনে একটি সোনার নাশপাতি ছুঁড়ে দিলেন যাতে লেখা ছিল , ‘ সকলের সবচেয়ে সুন্দরী দেবীর জন্য ‘ । এতে বিভ্রান্ত হয়ে দেবতাদের দৃষ্টি সেদিকেই ঘুরে যায় । সেই বিশৃঙ্খলার সুযোগে প্রমিথিউস হেফেস্টাসের কর্মশালার চুল্লি থেকে আগুন চুরি করেন । এই চুরির কথা জানতে পেরে জিউস সিদ্ধান্ত নেন যে , প্রমিথিউসকে চরম শাস্তি দেওয়া হবে।

এরপর প্রমিথিউসকে ককেশাস পর্বতে একটি পাথরের স্তম্ভে বেঁধে ফেলা হয় অনন্তকালের জন্যে । সেখানে প্রতিদিন একটি ঈগল এসে প্রমিথিউসের লিভারটি ( কলিজা ) ঠুকরে খেয়ে যেতো । কিন্তু প্রমিথিউসের অমরত্বের কারণে পরদিন আবার লিভারটি পুনঃস্থাপিত হতো । এইভাবে অনন্ত যন্ত্রণা ভোগ করে দিন কাটাতে হতো তাঁকে । এমনভাবে হাজার হাজার বছর শাস্তিভোগের পর একসময় প্রমিথিউস মুক্তিলাভ করেন । জ্ঞান , বুদ্ধি , বিজ্ঞান , প্রযুক্তি এবং সৃজনশীলতার প্রতীক হিসেবে পৌরাণিক প্রমিথিউস মানবসভ্যতার ইতিহাসে এক সশ্রদ্ধ নাম । প্রমিথিউসের মাহাত্ম্য ও ত্যাগের উদাহরণ পাশ্চাত্য সাহিত্য , সঙ্গীত ও সংস্কৃতিতে বিরল ও বিশিষ্ট স্বাতন্ত্রে বিরাজমান । প্রখ্যাত ইংরেজ কবি শেলি প্রমিথিউসের গল্প থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ‘ মুক্ত প্রমিথিউস ‘ নামে একটি গীতিনাট্য লেখেন । সেখানে তিনি প্রমিথিউসকে একজন রোমান্টিক নায়ক হিসেবে কল্পনা করেন , যিনি শৃঙ্খল ভেঙে ‌মানুষের কাছে মুক্তির বার্তা নিয়ে আসেন। আবার মেরি শেলির উপন্যাস ‘ ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’-এর সাবটাইটেল-এ পাওয়া যায়’ দ্য মডার্ন প্রমিথিউস ‘। আর বিশ্ববিশ্রুত এস্কাইলাসের প্রাচীন গ্রীক মহান ট্র্যাজেডি আধারিত সৃষ্টি ‘প্রমিথিউস বাউন্ড’।

‘সবই , যা আমি আগে জানতাম, যা হওয়া উচিত ‘ , মানবতা রক্ষা করতে হলে ‘ যা করার , তা করতে হবে , তার পরিণতি যা-ই হোক না কেন ‘ ,এই ছিল দুঃসাহসী প্রমিথিউসের স্থির প্রজ্ঞা । স্থুল অচলায়তন নৈতিকতার বেড়া ভেঙে ছলে-বলে-কৌশলে যে ভাবেই হোক মানুষকে বাঁচাতে হবে । নিতে হবে প্রাণের ঝুঁকি । উপেক্ষা করতে হবে সঙ্কটের সমস্ত কল্পনাকে । শুকনো গাঙে জীবনের বন্যার উদ্দাম কৌতুক আনতে হলে সবার আগে ত্যাগ করতে হবে প্রাণ হারানোর ভয়। ভাঙনের জয়গান না গাইতে পারলে নতুন তরঙ্গ আসবে কীভাবে ?

আরও পড়ুন- Bangladesh Election: ভোট দিলেন তারকাপ্রার্থী শাকিব আল হাসান ও অভিনেতা ফিরদৌস

 

Previous articleWeather Update: সকালে কুয়াশা, বেলা বাড়তে ঘামছে শহর!
Next articleহাওড়া স্টেশনে সংস্কারের কাজ, বাতিল একগুচ্ছ ট্রেন!