‘রহস্যময় রূপান্তর’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

” এক সকালে ঘুম থেকে উঠে গ্রেগর সামসা দেখল— সে পোকা হয়ে গেছে ! ”
‘ দ্য মেটামরফসিস ‘ উপন্যাসের প্রথম লাইন এটি ।

জার্মান ভাষায় লেখা ।‌ বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাসের অন্যতম সেরা বাক্যবন্ধ হিসেবে এই লাইনটিকে গণ্য করা হয় । নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক বিশ্ববরেণ্য গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ পর্যন্ত আলোড়িত হয়েছিলেন এই বাক্যবন্ধের স্পর্শে ।

এই বাক্যের স্রষ্টা ফ্রানৎস কাফকা । ১৯৮৩ সালের ৩রা জুলাই তৎকালীন অস্ট্রিয়া- হাঙ্গেরি সাম্রাজ্যের প্রাহা ( প্রাগ ) শহরে ( বর্তমানে চেক প্রজাতন্ত্রের রাজধানী ) এক মধ্যবিত্ত জার্মান-ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি । যক্ষায় আক্রান্ত হয়ে ১৯২৪ সালে মাত্র ৪১ বছর বয়সে মারা যান তিনি । বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রভাবশালী লেখক হিসেবে অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন কাফকা । তাঁর মাতৃভাষা ছিল চেক , তিনি লেখালিখি করতেন জার্মান ভাষায় ।

Metamorphosis শব্দটি গ্রীক শব্দ Metamorfosi থেকে এসেছে , যার অর্থ রূপান্তর । এটা এক ফর্ম থেকে অন্য ফর্মে পরিবর্তিত হওয়ার অবস্থা । আকৃতির পরিবর্তন , রূপান্তরিত আকৃতি , চরিত্রের পরিবর্তন ।

কে গ্রেগর সামসা ? কী হয়েছিল তাঁর ?

গ্রেগর একজন ভ্রাম্যমান বিক্রেতা । এককথায় ফেরিওয়ালা । একদিন সকালে ঘুম ভাঙলে তিনি এক কিম্ভূতকিমাকার বিশাল পোকার রূপে নিজেকে আবিষ্কার করেন । তারপর থেকেই শুরু হয় এক অসহনীয় পরিস্থিতি । তিনি তাঁর চাকরি হারান । ধীরে ধীরে নিজের পরিবারের সকলের সহানুভূতিও হারান ।
হয়ে ওঠেন অবাঞ্ছিত । তাঁর অসুস্থতা বাড়তে থাকে । একসময় মারা যান । ঘরের পরিচারিকারা ময়লা আবর্জনার সাথে বাইরে ফেলে দিয়ে আসেন তাঁকেও ।

সাহিত্যে অন্ধকারাচ্ছন্ন অদ্ভুত সব ঘটনা যাঁর ভাষার সৌন্দর্যে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে , যিনি বিশ্বসাহিত্যকে বারবার দিয়েছেন বাঁক বদলের খোরাক , সেই ফানৎস কাফকার অসামান্য সৃষ্টি ‘ মেটামরফসিস ‘ হলো সামগ্রিক শরীরের প্যাটার্নের পরিবর্তন , যা কিছু প্রাণীর জন্মের পরে বা হ্যাচিং – এর পরে ঘটে থাকে । এর দুটি সুপরিচিত উদাহরণ হলো শুঁয়োপোকার প্রজাপতিতে এবং ট্যাডপোল থেকে ব্যাঙে রূপান্তর ।

মেটামরফসিস বিকাশের একটি পরোক্ষ রূপ , যেখানে একটি রূপান্তরিত প্রাণী প্রাপ্তবয়স্ক আকারে পৌঁছানোর আগে রূপগতভাবে স্বতন্ত্র পর্যায় অতিক্রম করে । এর বিপরীতে , মানুষ এবং অন্যান্য অনেক প্রাণী সরাসরি বিকাশের মধ্যে দিয়ে যায় , যার মধ্যে শিশু এবং বৃদ্ধ একে অপরের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ , আকার এবং যৌন পরিপক্কতা ছাড়া । জেলিফিশ , স্পঞ্জ , কিছু প্রজাতির কৃমি এবং কিছু পতঙ্গ সহ প্রাণীজগতের
অন্তত ১৭ টি ফাইলে মেটামরফসিস ঘটে । পরিবেশগত সংকেত প্রায়ই একটি প্রাণীর মধ্যে হরমোনের পরিবর্তন ঘটায় যা রূপান্তরের মূল অনুঘটক ।

কাফকার ‘ দ্য মেটামরফসিস ‘ উপন্যাসের মূল চরিত্র গ্রেগর সামসা অতিকায় পতঙ্গে পরিণত হয়েছিল , কিন্তু তাঁর স্মৃতি যুক্ত হয়েছিল অতীতে । গ্রেগর কেন চেয়েছিলেন তাঁর রূপান্তর ? তিনি কি আদৌ চেয়েছিলেন ? যা ঘটেছিল তা কি তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে ? নাকি সবই ঘটেছে তাঁর মনের মতো ক’রে ? যে জীবন ফড়িঙের দোয়েলের , সেই পাখি অথবা পতঙ্গের জীবন তিনি কি দেখতে চেয়েছিলেন তাঁর শরীরের রূপান্তর ঘটিয়ে ?
কেন ঘটে স্বত্বার এই সঙ্কট ? একি ক্রমাগত দণ্ডিত আধুনিক মানুষের এক ধরনের প্রতিবাদ নয় ? এক স্বত্বা যেন প্রাণপনে খুঁজে চলেছে প্রতিদিনের যাপিত জীবনের সঙ্গে তার গূঢ় সংযোগটিকে । বারবার সে ব্যর্থ হচ্ছে , ফলাফল শূন্য থাকছে , অর্থাৎ ভয়াবহ এক শূন্যতা ঘিরে ফেলছে তাকে । আর এই শূন্যতার মাঝেই যেন লুকিয়ে রয়েছে জীবনের অনন্ত সৌন্দর্য । ভ্যানগগের চিত্রকলায় যে রহস্য লুকানো , কাফকার রচনাতেও যেন লুকিয়ে রয়েছে সেই একই রহস্য ।

এক অলীক দুনিয়া থেকে নিরেট বাস্তবে পাঠকদের নামিয়ে আনা বড় সহজ কাজ নয় । কাফকার লেখা আপাত দুর্বোধ্য , কিন্তু অসম্ভব প্রতীকী এবং তেমনই মননশীল । পাঠকের হৃদয়ের অতলে পৌঁছে যাওয়া যে কোনো লেখকের একমাত্র বাসনা । কাফকা এই ক্ষেত্রে বারবার সফল হয়েছেন । তিনি সমস্যা চিহ্নিত করেন এবং সেই সমস্যার পথে এগিয়ে চলাও শেখান । এরপর পাঠক তথা মানুষের একটাই কাজ বাকি থাকে । তা হলো চূড়ান্ত সমাধান বা অন্তিম গন্তব্যে পৌঁছোবার পথ খুঁজে নেওয়া।

তাঁর দুঃস্বপ্নতাড়িত লেখার সবচেয়ে বড় উদাহরণ ‘ দ্য মেটামরফসিস ‘ । এখানে শুরুতেই বোঝা যায় , নিয়মের শেকলে বাঁধা এই জীবন সহজে নিস্তার দেবে না তোমাকে ।‌ সবসময় তাড়া করে বেড়াবে এবং নিশ্চিত হতে চাইবে যে তুমি এই আরোপিত সিস্টেমের একজন অনুগত ভৃত্যমাত্র ।

পোকায় পরিণত হবার আগে গ্রেগরের যে জীবন ছিল তা অত্যন্ত ক্লান্তিকর ও একঘেয়ে। এই দীর্ঘ ক্লান্তির ভয়াবহ বিপন্নতা থেকে পরিত্রাণ পেতেই যেন পোকায় রূপান্তর । এক অস্তিত্বের সঙ্কট থেকে পরিত্রাণ পেতে আরেক অস্তিত্বে গমণ । সেখানেও সঙ্কট কম নয় ।

গ্রেগর সামসা এখন পোকা হয়েছে । এখন সে পোকার মতোই বাঁচবে । তবু কোথাও যেন আমাদের এই ভয়ঙ্কর উদ্ভট বেঁচে থাকার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের গান গাইতে থাকে গ্রেগররূপী পোকাটি । গাইতে থাকে নবজীবনের গান । পালাবদলের গান । রূপান্তরের গান ।

জীবনকে কিছুটা সহনীয় করে তোলার জন্য মানুষ কী না করতে পারে ? সিস্টেমের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে তো একেবারে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লো পোকা-গ্রেগর । এমনকি পরিবারের সদস্যরাও তার সঙ্গী হলো না । গ্রেগরের রূপান্তরিত স্বত্বার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টাই করলো না কেউ । তার প্রতিবাদের ধরনটাও বুঝলো না কেউ।
হতে পারে এটি রূপক , প্রতীকী , জীবনের ক্লান্তির অবসানের চূড়ান্ত রূপ । কিন্তু আমরা সবাই কি এক অর্থে গ্রেগরের মতোই বন্দী নই ? আমরাও কি রূপান্তরের অনেকটা কাছাকাছি অথবা রূপান্তরের প্রক্রিয়ার মধ্যে নেই ?

এসব ভাবার দায়িত্ব কি শুধুমাত্র গ্রেগর সামসার ?
হায় গ্রেগর ! হায় আমরা !

আরও পড়ুন- পারস্পরিক বৃদ্ধির দিশা দেখাল ইন্ডাস্ট্রি অ্যাকাডেমিয়া সম্মেলন

Previous articleপারস্পরিক বৃদ্ধির দিশা দেখাল ইন্ডাস্ট্রি অ্যাকাডেমিয়া সম্মেলন
Next articleনজিরবিহীন পদক্ষেপ কমিশনের, ভোট ঘোষণার আগেই রাজ্যে আসছে কেন্দ্রীয় বাহিনী