‘মুনলাইট সোনাটা’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

” সবুজ ঘাসে রোদের পাশে
আলোর কেরামতি ,
রঙিন বেশে রঙিন ফুলে
রঙিন প্রজাপতি !
অন্ধ মেয়ে দেখছে না তা —
নাইবা যদি দেখে —
শীতল মিঠা বাদল হাওয়া
যায় যে তারে ডেকে ! ”
……………………..

” দুঃখ-সুখের ছন্দে ভরা
জগৎ তারও আছে ,
তারও আঁধার জগৎখানি
মধুর তারি কাছে ” ।।
( সুকুমার রায় )

” প্রাজ্ঞের মতো নয় , অন্ধের
ছুঁয়ে দেখার মতো ক’রে বলো… ” ।
( অরুণ মিত্র )

জন্মান্ধ এক মেয়ের বায়নার অন্ত নেই । সে জিদ ধরেছে চাঁদের আলো দেখবেই । মেয়ের আবদার মেটাতে জেরবার বাবা কী করবে এখন ? সেই অপরূপ চন্দ্রালোক , যাতে প্লাবিত হয় অনন্ত চরাচর , দেখতে চেয়েছে মেয়ে ।‌ কীভাবে সম্ভব ? এখন কোথায় কার কাছে যাবে বাবা ?

তারপর এফোঁড় ওফোঁড় ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করেই মিলে যায় এক মুশকিল আসান । এক বন্ধু আছে মেয়ের বাবার , প্রখ্যাত সঙ্গীতকার , পিয়ানোয় সুর তোলে আলো-আঁধার । সেই বন্ধু আশ্বাস দেন একটু সময় দিলে চেষ্টা করা যায় । তারপর এক সুন্দর সন্ধ্যায় মেয়েটিকে পিয়ানোয় এক আশ্চর্য সুর শোনায় তার বাবার সেই বন্ধু । সেই অপূর্ব সিম্ফনি , সেই একটুকরো সুরখণ্ড স্তব্ধ হয়ে শোনে মেয়েটি । তারপর হঠাৎ যেন ফেটে পড়ে হৃদয়খোলা উচ্ছাসে । দেখলাম , আমি এইমাত্র দেখলাম বাবা , জীবনে এই প্রথম দেখলাম চাঁদের আলো , আমার কানে সুর প্রাণে আলো , আহা কী অপরূপ , কী অপূর্ব জ্যোৎস্না , কী আশ্চর্য পৃথিবীর রূপ !

কিন্তু হায় , এটা নাকি একটা গল্পমাত্র ! সত্যি সত্যিই এমন নাকি কখনও ঘটে নি !
মনে পড়ে রসিক সম্প্রদায়ের অমর গান , ‘ মায়ায় মায়ায় যাক না জন্ম , যদি আরেক জন্মে সত্যি হয় ‘ !

এ নিয়ে আরেকটি গল্প । এক বন্ধুর সঙ্গে ভিয়েনার রাস্তায় বেড়াতে বেরিয়েছেন বেটোফেন । হাঁটতে হাঁটতে একটি বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়েন দুজনেই । বাড়ির জানলা খোলা । দোতলার ঘর থেকে ভেসে আসছে পিয়ানোর মিঠে সুর । বেটোফেন সেই বাড়ির এক ভদ্রমহিলার কাছে জানতে চান কে এত সুন্দর সুর বাজাচ্ছেন । ভদ্রমহিলা বেটোফেন ও তাঁর বন্ধুকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেলে তাঁরা দেখেন একটি মেয়ে পিয়ানো বাজাচ্ছে । সেই মেয়েটির সঙ্গে কথায় কথায় বেটোফেন জানতে পারেন যে মেয়েটি অন্ধ এবং তার চাঁদের আলো দেখার ভীষণ ইচ্ছে । একথা শুনেই পিয়ানোয় আঙুল বোলাতে শুরু করেন বেটোফেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই সৃষ্টি করেন এক অবিস্মরণীয় সিম্ফনি এবং নাম রাখেন মুনলাইট সোনাটা।
কিন্তু বিধি বাম ! এও নাকি গল্প । এমন ঘটনাও নাকি কোনোদিন ঘটে নি ।

লুডভিগ ফান বেটহোফেন ( ডিসেম্বর ১৭ , ১৭৭০ — মার্চ ২৬ , ১৮২৭ ) একজন জার্মান সুরকার ।
সারা বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুরকার হিসেবে প্রসিদ্ধ এই সঙ্গীতস্রষ্টা । পাশ্চাত্য সঙ্গীতের ধ্রুপদী ও রোমান্টিক যুগের অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ইনি । পিয়ানোয় সোনাটা নং ফোরটিন ইন সি শার্প মাইনর নামে একটি কম্পোজিশন রচনা করেন তিনি , যা কোয়াসি ইনা ফান্টাসিয়া নামেও পরিচিত ।‌ এটিই মুনলাইট সোনাটা নামে বিখ্যাত ।

সোনাটা হলো পিয়ানো কিংবা যৌথভাবে পিয়ানো ও বেহালার জন্য রচিত তিন বা চার পর্যায় বিশিষ্ট যন্ত্রসঙ্গীত। এককথায় কয়েক টুকরো সুর বা সুরের কয়েকটি খণ্ডের সমাহার । এটি ল্যাটিন শব্দ ‘ সোনারে ‘ থেকে এসেছে । অনেকে বলেন , এক টুকরো গান । বেটোফেনের অনেক সৃষ্টি সারা বিশ্বে সমাদৃত হয়েছে । তবে ‘ মুনলাইট সোনাটা ‘ এক স্নিগ্ধ ব্যতিক্রম হিসেবে আজও আলোচিত ।

ফরাসি বিপ্লব দারুণভাবে প্রাণিত করেছিল বিশ্ববিশ্রুত এই জার্মান সঙ্গীতজ্ঞকে । স্নিগ্ধ-বিষাদ , অস্থিরতা , অনিশ্চয়তা ও নিবিড় রহস্যময়তার সমন্বয়ে গঠিত এক আশ্চর্য উপাখ্যান মুনলাইট সোনাটা । একক বাদ্যযন্ত্রের জন্য এমন ধ্রুপদী সৃষ্টি অবশ্যই বিরলের মধ্যে বিরলতর ।

১৭ বছর বয়সী একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছিলেন বেটোফেন। মেয়েটি তাঁরই ছাত্রী । নাম কাউন্টেসা গুয়েলিটা গুইচ্চিআরদি । শোনা যায় বেটোফেন এই মেয়েটিকে উৎসর্গ করেছিলেন তাঁর মুনলাইট সোনাটা । পাশ্চাত্য তথা বিশ্বের ধ্রুপদী সঙ্গীতের এক চিরস্থায়ী বাঁকবদলের কাণ্ডারী বেটোফেন দেখিয়ে গেছেন সঙ্গীত কেবলমাত্র বিশুদ্ধ বিনোদন নয় , তার চেয়েও গভীরতর কিছু , যা একইসঙ্গে প্রাণবন্ত ও স্বপ্নময়।
সুক্ষ্মতর আবেগ ও অনুভূতির মরমী অভিব্যক্তি মুনলাইট সোনাটার অন্যতম আকর্ষণ ।

জীবনের একটি বিশেষ পর্বের গভীর উপলব্ধি প্রকাশের এক অসামান্য প্রয়াস এই সঙ্গীতাংশটি । নির্মল অথচ বিষন্ন এর প্রথমাংশ , দ্বিতীয় পর্বে অর্থাৎ মাঝের অংশটি একইসঙ্গে নরম ও রহস্যময় এবং শেষপর্বে ঝোড়ো সুরবিস্তার এক অপরূপ ভারসাম্য তৈরি করে মুনলাইট সোনাটায় । বেদনার এমন প্রতিষ্ঠা বড়ো সহজ নয় । উদ্ভাবনী ক্ষমতা ও অভিনব সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে মুনলাইট সোনাটা নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এটি সৃষ্টির সময়কাল ১৮০১ সাল ।

মনে রাখতে হবে , ১৮১৯ সালের পর থেকেই এই মহান শিল্পী ধীরে ধীরে বধির হতে থাকেন । কয়েক বছরের মধ্যেই সম্পূর্ণ বধির হয়ে যান। কিন্তু বধিরতা তাঁকে থামাতে পারে নি । সম্পূর্ণ বধির অবস্থায় তিনি তাঁর মৃত্যুকাল অবধি যে সমস্ত অসামান্য কম্পোজিশন সৃষ্টি করে গেছেন সেগুলো শুনলে অপার বিস্ময় জাগে ।

আরও পড়ুন- ইংল্যান্ডকে পঞ্চম টেস্টে হারাতেই বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের শীর্ষে টিম ইন্ডিয়া

Previous articleইংল্যান্ডকে পঞ্চম টেস্টে হারাতেই বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের শীর্ষে টিম ইন্ডিয়া
Next articleবাংলার বিরুদ্ধে ‘চক্রান্তে’ না, পদত্যাগে বাধ্য করা হল নির্বাচন কমিশনারকে!