Friday, December 12, 2025

কলকাতা-স্পেন মিলেমিশে একাকার, ২৬ বছর পর জন্মদাত্রীকে খুঁজে পেলেন প্রিয়া

Date:

Share post:

পরিস্থিতির কাছে আত্মসমর্পণ করে সদ্যোজাত কন্যা সন্তানকে ছেড়ে যাওয়া এক মায়ের সামনে ২৬ বছর পরে এসে দাঁড়াল সেই কন্যা। শেষ এপ্রিলে সেই মুহূর্তের সাক্ষী থাকল কলকাতার এক গলি। যেখানে হাতে হাত রেখে কথা বলে গেল আগলহীন অশ্রু। এক জন বাঙালি, অন্য জন স্প্যানিশ।এই তো সে দিন, মাঝ-জানুয়ারিতে আট হাজার কিলোমিটার উজিয়ে কলকাতায় এসে, শহরের অলি-গলি তন্ন তন্ন করে খুঁজে জন্মদাত্রীকে না-পেয়ে শহর ছেড়েছিলেন প্রিয়া। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি শহরের মানচিত্র থেকে প্রায় হারিয়ে যাওয়া এক গলিপথ থেকে খোঁজ মেলে এক মহিলার। পারিপার্শ্বিক তথ্যপ্রমাণ থেকে মনে হয়েছিল, তিনিই বুঝি স্পেনের বার্সেলোনার মেয়ে প্রিয়া ইরেন ক্যাবালেরো লোপেজ-এর জন্মদাত্রী মা।

কিন্তু, মনে হলেই তো হল না। নিশ্চিত হতে প্রিয়া ও ওই বাঙালি মহিলার ডিএনএ পাঠানো হয়েছিল আমেরিকার ল্যাবরেটরিতে। দু’জনের ডিএনএ নমুনা মিলে যাওয়ার খবর এসেছে কিছুদিনের মধ্যেই। তারপর থেকে অন্য এক খাতে বইতে শুরু করে প্রিয়ার জীবন। মোবাইলে প্রথম খবরটা পেয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিলেন। এত বছর ধরে তাঁর লালন করা স্বপ্নের সামনে গিয়ে দাঁড়াবেন, ভাবতেই ছটফটিয়ে উঠেছেন।বার্সেলোনায় নিকটাত্মীয়দের ডিনারে ডেকে জনে জনে বলেছেন, জানো! আমি আমার মা-কে খুঁজে পেয়েছি। দেখা করতে কলকাতায় যাচ্ছি। আর তাঁর অপেক্ষায় বসে থাকা নিম্নবিত্ত পরিবারের হেঁসেল ঠেলা মা-য়ের কথায়, ও খুশি থাকুক। সুস্থ থাকুক। ২৬টা বছর তো কম সময় নয়।

মা-কে খুঁজে পাওয়ার এই কাজটা যদিও সহজ ছিল না। প্রিয়ার প্রতিনিধি, মহারাষ্ট্রের সমাজকর্মী অঞ্জলি পওয়ার, তাঁর দোসর অরুণ ডোল মিলে গত প্রায় চার মাস ধরে নিরলস চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন। ২৬ বছর আগে এ শহর থেকে সদ্যোজাত প্রিয়াকে দত্তক নিয়ে বার্সেলোনায় চলে যান জেভিয়ার ও কারমেন। পরে ছোটবেলাতেই কন্যাকে সে কথা জানিয়ে দেন তাঁরা। প্রিয়া জন্মদাত্রী মায়ের খোঁজ শুরু করেন বছর দশেক আগে। বছর কয়েক আগেও এক বার শহরে এসে বিফল হয়ে ফিরতি উড়ান ধরেন তিনি। এ বার সেই স্বপ্নের উড়ান ধরে সেই শহরে ফিরলেন প্রিয়া।

ঘুপচি ঘরে তেলচিটে বিছানার ধারে প্রিয়ার হাত ধরে দাঁড়িয়ে মায়ের চোখের জল তখন বাধ মানছে না। মায়ের হেঁশেল জুড়ে নিম্নবিত্ত জীবনযাপনের ছাপ। এ শহরের শিরা-উপশিরায় মিশে থাকা এক গলিতে আজও দিন গুজরান করেন প্রিয়ার আটপৌরে বাঙালি গর্ভধারিণী কবিতা সরকার। প্রিয়া তাঁর খোঁজ পেয়ে উড়ে এসেছেন স্পেনের বার্সেলোনা থেকে। এসেছেন পালক বাবা-মায়ের দেওয়া নিশ্চিন্ত, বিলাসবহুল জীবন থেকে খানিক ছুটি নিয়ে। সেই স্পেনীয় বাবা-মা, জেভিয়ার ও কারমেনকে সঙ্গে নিয়েই বৃহস্পতিবারের রোদে পোড়া বিকেলে কালিকাপুর পূর্বপল্লিতে কবিতার চৌকাঠে দাঁড়ালেন প্রিয়া ইরেন ক্যাবালেরো লোপেজ।

বাংলা ছাড়া আর প্রায় কোনও ভাষাই বোঝেন না কবিতা। আর প্রিয়া স্প্যানিশের বাইরে খুব ভাঙা ভাঙা ইংরেজি বলতে পারেন। কিন্তু দুনিয়ার সব মায়ের ভাষাই সন্তানের জন্যএক! গরমে ঘেমে নেয়ে ওঠা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কাঁদছিলেন মা। মেয়েও কেঁদে আকুল। কান্নার আওয়াজ পেয়ে উঁকিঝুঁকি দিলেন কবিতার দু’এক জন প্রতিবেশী।একচিলতে ঘর থেকে ছিটকে আসছিল কথোপকথন। মা-মেয়ে তখন আরও একটু বেশি কথা বলতে চান পরস্পরের সঙ্গে। কবিতা চোখের জলে ভাসছিলেন আর বলছিলেন, স্বপ্নেও তো ভাবিনি, ওকে দেখতে পাব! শুধু প্রার্থনা করে গিয়েছি। যদি এক দিন এক বারের জন্য চোখের দেখা দেখতে পাই। চোখ মুছে প্রিয়া তখন হাসছেন। মাকে বলছেন, আমিও তোমার শহরে এসে মন্দিরে গিয়ে একই প্রার্থনা করেছিলাম।




spot_img

Related articles

MGNREGA থেকে PBGRY: নাম বদল মোদি সরকারের, ‘মহাত্মা’ শব্দ বাদের তীব্র বিরোধিতা কুণালের

১০০ দিনের কাজ করিয়ে টাকা দেয়নি। বঞ্চিত বাংলা। সেই টাকা দেওয়ার নাম নেই উল্টে বাংলাকে আপমান করতে MGNREGA...

তিনবারের মোদি জমানায় প্রথমবার জনগণনা: খরচ হবে ১১ হাজার কোটি

প্রথমবার জনগণনা করতে চলেছে নরেন্দ্র মোদি সরকার। এতদিনে সম্মতি মিলিছে মন্ত্রিসভার। তবে তা শুরু হতেই এখনও একবছরের বেশি...

সোনালির স্বাস্থ্যের খোঁজ সুপ্রিম কোর্টের: স্বামীকে ফেরানো নিয়ে রায় নতুন বছরে

বাংলাদেশ থেকে সদ্য দেশে, নিজের বাড়িতে ফেরা সোনালি খাতুনের স্বাস্থ্যের খোঁজ নিল দেশের শীর্ষ আদালত। সেই সঙ্গে তাঁর...

গুজরাটে ভেঙে পড়ল নির্মীয়মাণ সেতু, আহত ৫

ফের গুজরাটে (Gujrat) ভেঙে পড়ল নির্মীয়মাণ সেতু (Bridge Under Construction)। এবার নির্মীয়মাণ সেতু ভেঙে ৫ জনের আহত হওয়ার...