নীরেন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকীতে ‘ছান্দসিক’ কবির জীবনী প্রকাশ; আলাপনের লেখা বই উদ্বোধনে শীর্ষেন্দু, ব্রাত্য 

ব্রাত্য বসু জানান, লেখকের পুস্তকে ফুটে উঠেছে নীরেন্দ্রনাথের এমন কিছু কাহিনী যেখানে কীভাবে সময় কবির লেখনীতে এসে কড়া নেড়েছে, তাঁকে বদলে দিয়েছে তার একটা সুস্পষ্ট ধারণা মেলে।

১৯২৪ থেকে ২০২৪- জন্মশতবর্ষে বিশিষ্ট কবি সাহিত্যিক নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। ‘অমলকান্তি’র স্রষ্টার জীবন আর সৃষ্টি নিয়ে দু’দিনব্যাপী এক বিশেষ আলোচনা চক্রের আয়োজন করেছে সাহিত্য অকাদেমি (Sahitya Akademi)। শনিবার সেই অনুষ্ঠানের উদ্বোধনে উপস্থিত বিশিষ্ট সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় (Shirshendu Mukherjee)। ‘ছান্দসিক’ কবির স্মৃতিচারণায় এদিন উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু(Bratya Basu), আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় (Alapan Banerjee) অকাদেমির সভাপতি মাধব কৌশিক, সচিব কে শ্রীনিবাস রাও-সহ বিশিষ্টজনেরা। এদিন আলাপনের লেখা নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর জীবনী গ্রন্থ প্রকাশ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ব্রাত্য বসু জানান, লেখকের পুস্তকে ফুটে উঠেছে নীরেন্দ্রনাথের এমন কিছু কাহিনী যেখানে কীভাবে সময় কবির লেখনীতে এসে কড়া নেড়েছে, তাঁকে বদলে দিয়েছে তার একটা সুস্পষ্ট ধারণা মেলে। খাদ্য আন্দোলন থেকে নকশালবাড়ি আন্দোলন এই সবকিছুর সঙ্গে কত সাবলীলভাবে মিশে গেছে নীরেন্দ্রনাথের সৃষ্টি সেটাই যেন আলাপন তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।

দু’দিনব্যাপী আয়োজিত নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর জন্মশতবার্ষিকী আলোচনা চক্রের উদ্বোধনী অধিবেশনে ‘ধূসর পান্ডুলিপি’র সংস্পর্শে এসে বদলে যাওয়া কবির স্মৃতিচারণা করেন ব্রাত্য। ফরিদপুরে কাটানো নীরেন্দ্রনাথ কলকাতায় আসার পর জীবনানন্দের কবিতাতে কি খুঁজে পেয়েছিলেন নিজস্ব স্বর? তাই কি নিজের লেখায় অবিরাম আত্মখন্ডনের রাস্তা বেছে নিয়েছিলেন কবি? নীরেন্দ্রনাথ যখন একটি প্রথম সারির পত্রিকায় নিয়মিত ‘কবিতার ক্লাস’ লেখা শুরু করে দিয়েছেন তখনও কিন্তু অন্যান্য কবিদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ছন্দসৃষ্টির প্রতিভাকে এতটুকু অসম্মান করেননি। তখনও বলতেন, কবিতা লেখা খুব একটা কঠিন কাজ নয়। সাংবাদিক নীরেন্দ্রনাথ কি কবিতার কল্পনায় বিশ্বাস করতেন না? হয়তো তাই নিজস্ব অনুভবকে বাস্তবের সঙ্গে প্রতিমুহূর্তে যাচাই করে নিয়ে অপূর্ব ভঙ্গিমায় কঠোর সত্যিটুকু সৃষ্টি করতে পেরেছেন সাহিত্যের রসে। কবি বিশ্বাস করতেন, সংবাদ মূলত কাব্য, তাই যে মানুষকে নিয়ে লিখেছেন তাঁকে অলীক কল্পনায় আটকে রাখেননি। জলজ্যান্ত পটভূমিতে ছড়িয়ে দিয়েছেন নিজের সৃষ্টিতে। কবির ‘নিরবিন্দু’তে ধরা পড়েছে তাঁর জীবন প্রবাহ।

বাংলার দাবি নিয়ে বলতেই মাইক বন্ধ! প্রতিবাদে নীতি আয়োগের বৈঠক বয়কট মুখ্যমন্ত্রীর

‘অমলকান্তি’ আজও রোদ্দুর হতে পারেনি, কিন্তু তাঁর স্রষ্টা যে স্বপ্ন এঁকে দিয়েছিলেন দুচোখে আজ এত বছর পেরিয়ে কেমন আছে সেই ভাবনারা? বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে আবির্ভূত আধুনিক বাংলা কবিদের অন্যতম নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর (Nirendranath Chakraborty) জন্মশতবর্ষে ঠিক এই প্রশ্নটাই সবার আগে উঠে আসে। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় খুব কাছ থেকে দেখেছেন নীরেন্দ্রনাথকে। তাঁর কথায়, কবি মূলত দু’রকমের হয়। এক, যারা অত্যন্ত সচেতন ভাবে লেখেন, যেমন বিষ্ণু দে । দ্বিতীয় ধরণ সেইসব কবির যাঁরা মেদুরতার মধ্যে বসবাস করেন। মগ্ন চৈতন্যের কবি বোধহয় এদেরই বলে। উদাহরণ হিসেবে উঠে আসে জীবনানন্দ এবং কিছুটা হলেও রবীন্দ্রনাথের নাম, মত প্রবীণ সাহিত্যিকের। কিন্তু এই দুই গুণাবলীর সংমিশ্রণ যেন নীরেন্দ্রনাথ। প্রথম আলাপেই তাঁর সপ্রতিভতায় মুগ্ধ হয়েছিলেন শীর্ষেন্দু। বলেন ভালবেসেই ‘ছান্দসিক’ কবির প্রতি আকৃষ্ট হওয়া। তাঁর কবিতার মধ্যে আবছায়ায় কোথায় যেন স্রষ্টার ছবি ধরা পড়তো। কবির ছন্দের বুৎপত্তি যথেষ্ট শিক্ষণীয় বলেও জানান শীর্ষেন্দু।

১৯৫৪ সালে নীরেন্দ্রনাথের প্রথম কবিতার বই ‘নীল নির্জন’ প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি যেমন স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন তাঁর কবিতায়, ঠিক তেমনই বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে কঠিন প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন সামন্ততান্ত্রিক জমিদার, জোতদার সমাজ ব্যবস্থার দিকে। মানবতার অবমাননা তিনি সহ্য করতে পারেননি, তাই বারবার প্রতিবাদের ভাষা হয়েছে তাঁর বলিষ্ঠ কলম। তবে তাতেও মিশেছে মাধুর্য। সমকালীন জীবনের ভণ্ডামি, শােষণ ও অবিচার ব্যঙ্গের রূপে ছন্দের আশ্রয় নিয়েছে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সৃষ্টিতে। তাঁর জীবন যে বইটির উদ্বোধন হয় সেই গ্রন্থের সংক্ষিপ্তসার ইংরেজি ভাষায় সকলের সামনে তুলে ধরেন লেখক আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়। উপনিবেশিক শাসন পরবর্তী সময়ে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম উল্লেখযোগ্য কবি নীরেন্দ্রনাথের জীবনে দেশভাগের যন্ত্রণা কতটা প্রভাব ফেলেছিল এবং তাঁর সৃষ্টিতে সেই প্রতিফলনের কথা তুলে ধরেন আলাপন। হয়তো চল্লিশের দশকের ভেঙে পড়তে থাকা মূল্যবোধগুলির মমত্ব ভরা সংরক্ষণে সারা জীবন কেটে গেল বলেই, তাঁর নাম চল্লিশের দশকের কবি বলে সঙ্গত হয়। আলাপন বলেন, ঔপনিবেশিকতার শাসন পরবর্তী অধ্যায়ে নিজেদের নতুন করে উপস্থাপিত করার এক তাগিদ অনুভব করেছিলেন কবি। সেটাকে মিশিয়েছিলেন নিজের সৃষ্টির সঙ্গে। তিনি সাধারণ মানুষের কথা বইয়ের পাতায় তুলে ধরে সকলকে পড়তে শিখিয়েছিলেন। ১৯৬০-এর পর থেকে বাংলার অস্থির সময়ের প্রসঙ্গ এদিন তুলে ধরে আলাপন বলেন নীরেন্দ্রনাথের লেখায় অনেক সময় চারণ কবির ছোঁয়া মেলে। মানবতার অবমাননা তিনি সহ্য করতে পারেননি, তাই বারবার প্রতিবাদের ভাষা হয়েছে তাঁর বলিষ্ঠ কলম। দেশভাগের যন্ত্রণা থেকে বাংলার অস্থির সময়ের সাক্ষী সাহিত্যিক পাঠ্য জীবনের গতিকে কখনই শ্লথ হতে দেননি।

এদিনের আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন চিন্ময় গুহ, শেখর বসু, প্রচেত গুপ্ত, পবিত্র সরকার-সহ অন্যান্যরা। প্রত্যেকেই কবির সাহিত্য সৃষ্টির এবং তাঁর ভাবনা চিন্তার সুবিস্তৃত প্রভাবের কথা উল্লেখ করেন।কবির স্মৃতি কথায় সময় গড়ায় তবু সরণি শেষ হয় না। ২৮ জুলাই রবিবার সাহিত্য অকাদেমিতে আলোচনা চক্রের পাশাপাশি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শনীরও আয়োজন করা হয়েছে।