
ওরে মা বুঝি
কৈলাশে চইলাছে
সোনার পিতিমাকে
জলে ভাসাইছে রে
ভিখারি শিবের সাথে
গনেশ- জননী চইলাছে ..

বাঙালির প্রাণের উৎসবে সেজে ওঠে বিশ্ব- বাংলা-র প্রতিটি ঘর । পাড়ায় পাড়ায় ছোট বড় সমস্ত মণ্ডপে ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত আনন্দে মেতে থাকে আপামর বাঙালি। মহাষষ্ঠীতে মা দুর্গার বোধন । তারপর মহাসপ্তমী , মহাষ্টমী ও মহানবমী অতিক্রম করে বাঙালি পৌঁছোয় মহাদশমীতে । যাকে বলা হয় বিজয়া দশমী । মহালয়ার পর প্রথমা থেকে দশম দিন অর্থাৎ দেবীপক্ষের দশম দিনটি বিজয়া দশমী হিসেবে উদযাপিত হয় । ভয়ঙ্কর অত্যাচারী মহিষাসুরকে বধ করে ত্রিভুবনে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন মা দশভূজা । মা দুর্গার এই বিজয়ের উদযাপন করে মানুষ । এই বিজয়োৎসবকে বলা হয় বিজয়া দশমী ।

পুরাকালে মহিষাসুর নামক এক অসুর ব্রক্ষ্মার বর পেয়ে প্রবল ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে । সে নিজের ক্ষমতায় স্বর্গ , মর্ত ও পাতাল দখল করে নেয় । এমনকি দেবরাজ ইন্দ্রকে স্বর্গ থেকে বিচ্যুত করে মহিষাসুর। দেবতারা চরম সঙ্কটে পড়েন । কোনো পুরুষ মহিষাসুরকে বধ করতে পারবে না , এমনই বর তাকে দিয়েছিলেন ব্রক্ষ্মা। কোনঠাসা দেবতারা তাই ঠিক করেন , তাঁরা কোনো নারীর সাহায্য নেবেন । কিন্তু এমন নারী কোথায় ? তখন সমস্ত দেবতার সম্মিলিত শক্তি থেকে আবির্ভূতা হন দেবী দুর্গা । পুরাণে মহিষাসুর বধের কাহিনী অনুসারে টানা নয় দিন ও নয় রাত্রি তুমুল যুদ্ধের পর শুক্লা দশমীতে মহিষাসুরকে বধ করেন মা দশভূজা । এই বিজয়কে বিজয়া দশমী হিসেবে চিহ্নিত করা হয় ।

বিজয়া দশমীর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে রামায়ণ । ত্রেতা যুগে লঙ্কার রাজা দশানন রাবন শ্রী রামচন্দ্রের পত্নী সীতা দেবীকে অপহরণ করেন । সীতাকে উদ্ধার করার জন্য অকাল বোধন করে দেবী দুর্গার আশীর্বাদ নিয়ে রামচন্দ্র লঙ্কা অভিযান করেন । ভীষণ যুদ্ধের শেষে শুক্লা দশমীতে রাবনকে বধ করেন রাম । রাবনের বিরুদ্ধে রামের এই জয়লাভকে চিহ্নিত করা হয় বিজয়া দশমী নামে ।

বৌদ্ধ ধর্ম অনুসারে বিজয়া দশমীর আসল নাম অশোক বিজয়া দশমী । কলিঙ্গ যুদ্ধ জয়ের পর মৌর্য সম্রাট অশোক টানা দশদিন ধরে যে বিজয়োৎসব পালন করেছিলেন সেখান থেকেই নাকি বিজয়া দশমী নামটি এসেছে বলে অনেকেই মনে করেন । এছাড়াও উল্লেখ্য যে, শুক্লা দশমীতেই সম্রাট অশোক বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন । তাই এই দিনটি বৌদ্ধদের কাছেও ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ।

আরও পড়ুন- নাম বদল! সাগ্নিক হয়ে গেল আনিসুর, মণ্ডপে স্লোগান তোলা ধৃতের পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন কুণালের

বাঙালিদের কাছে বিজয়া দশমীর গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম । শুভ শক্তির কাছে অশুভ শক্তির পরাজয় অবশ্যম্ভাবী , এমনই ধারণা ও বিশ্বাস সারা বিশ্বের বাঙালির। শুভ বিজয়া আসলে শুভ শক্তির বিজয় উদযাপনের প্রতীক । মায়ের প্রতিমা নিরঞ্জনের পর সকলে পরস্পরকে আলিঙ্গন করেন এবং মিষ্টিমুখ করান । ছোটরা বড়দের প্রণাম করেন , বড়রা ছোটদের আশীর্বাদ করেন । সবাই সবাইকে শুভেচ্ছা জানান এবং পরস্পরের শুভকামনা করেন । শুভ বিজয়া প্রতীকী হলেও বাঙালি কিন্তু তাদের অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে পারস্পরিক শুভেচ্ছা বিনিময় করে এই বিশেষ দিনটিতে । এদিন সকলের মনপ্রাণ এক অপরিসীম প্রসন্নতায় ভরে থাকে ।

বিজয়া দশমী বিভিন্ন কারণে পালিত হয় এবং ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পৃথক পৃথকভাবে উদযাপিত হয় । দক্ষিণ , পূর্ব , উত্তর- পূর্বাঞ্চল এবং কয়েকটি উত্তর ভারতীয় রাজ্যে বিজয়া দশমী ধর্ম পুনরুদ্ধার ও সুরক্ষার জন্য পালিত হয় । উত্তর , মধ্য ও পশ্চিম ভারতের রাজ্যগুলিতে এই উৎসবটি ‘ দশেরা ‘ নামে ( দাসরা , দশাহরা ) অভিহিত হয় । এই অঞ্চলগুলোতে এটি ‘ রামলীলা’- এর সমাপ্তি চিহ্নিত করে এবং রাবনকে হারিয়ে রামের জয়কে উদযাপন করে । দশেরা উপলক্ষ্যে বহু অঞ্চলে কোথাও সশস্ত্র , আবার কোথাও অস্ত্র ছাড়াই বিশাল শোভাযাত্রা বেরোয় এবং মা দুর্গাসহ অন্যান্য প্রতিমাগুলি বিসর্জনের পাশাপাশি অশুভ শক্তির প্রতীক রাবনের কুশপুতুল দাহ করা হয় অর্থাৎ প্রতীকীরূপে অশুভ শক্তিকে ধ্বংস করা হয় ।

রাবনদহন ও আতসবাজির আলোয় সারা দেশজুড়ে পালিত হয় অশুভশক্তি বিনাশের মহোৎসব দশেরা । বাঙালির বিজয়া দশমী একদিকে যেমন চোখের জলে বাড়ির মেয়েকে বিদায় জানানোর দিন , অন্যদিকে অশুভের বিরুদ্ধে শুভ শক্তির বিজয় উদযাপনের দিন । আবার এটাও বলতে হয় যে , বিজয়া দশমী শুধু বাঙালির কাছেই নয় , সারা দেশের মানুষের কাছেই বিশাল তাৎপর্য নিয়ে প্রতিবছর উপস্থিত হয় । অসত্যের বিরুদ্ধে সত্যের জয় , অধর্মের বিরুদ্ধে ধর্মের জয় , অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের জয় এবং যাবতীয় অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোর জয় হিসেবে বিজয়া দশমীর দিনটি অতুলনীয় ।
শুভ বিজয়া ।
