‘গ্রেট গ্রেস’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

প্রথম বলেই ক্লিন বোল্ড । বোলার অখ্যাত । ব্যাটসম্যান কিন্তু নির্বিকার । প্যাভিলিয়নে ফেরার কোনো নামগন্ধ নেই । তিনি কী করলেন ? স্ট্যাম্পের বেল আবার জায়গামতো বসিয়ে বোলারকে বললেন , ‘ ট্রায়াল বল হিসেবে প্রথম বলটা ভালোই করেছো বাছা । বেশ , তবে এবার শুরু হোক আসল খেলা । ‘ বোলার তো হতভম্ব ! কোনভাবেই ব্যাটসম্যানকে সাজঘরে ফেরাতে রাজি করানো গেল না । আরেকবার অন্য একটা ম্যাচে আম্পায়ার তাঁকে এল বি ডব্লিউ আউট ঘোষণা করার পর তিনি সরাসরি আম্পায়ারকে বলেন ,
‘ এই যে এত মানুষ টিকিট কেটে মাঠে এসেছে , এরা কেউ তোমার আম্পায়ারিং দেখতে আসে নি , এসেছে আমার ব্যাটিং দেখার জন্য ‘ ।
কে এই আশ্চর্য ক্রিকেটার ?
ইনি বিখ্যাত ডব্লিউ জি গ্রেস । পেশায় ডাক্তার । ক্রিকেট পাগল । আরও পরিস্কার করে বললে ব্যাটিং পাগল । সবসময় ব্যাট করতে চাইতেন , কিন্তু কখনও আউট হতে চাইতেন না । আম্পায়ার আউট দিলেও মাঠ ছাড়তে চাইতেন না ।

একবার একটা ম্যাচে বোল্ড হবার পর তিনি আম্পায়ারকে বলেন , ‘ আপনি জানেন কিনা জানিনা , আসলে ঝোড়ো বাতাসেই স্টাম্পের বেলটা পড়ে গেছে ‘ । এর উত্তরে ওই আম্পায়ার মুচকি হেসে বলেন , ‘ আশা করি বাতাসটি আরেকটু ঝোড়ো গতি পেয়ে ডাক্তার সাহেবকে প্যাভিলিয়নে উড়িয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে’ । আউট হতে ইচ্ছে করতো না তাঁর ।‌ কিছুতেই মাঠ ছাড়তে চাইতেন না । আম্পায়াররাও বোধহয় তাঁর এই ইচ্ছেটাকে সম্মান করতেন অথবা কিছুটা বাধ্য হয়েই মেনে নিতেন ।

১৮৯৮ সালে অনুষ্ঠিত এক ম্যাচে একাধিকবার আউটের আবেদন করেও প্রত্যাখ্যাত হয়ে ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন ফাস্ট বোলার চার্লস কোর্টনাইট । শেষে একেবারে দুটো উইকেট উপড়ে দিয়ে বোল্ড করে দিলেন গ্রেসকে । এরপর গ্রেসের দিকে এগিয়ে এসে বললেন , ‘ ডাক্তার সাহেব , তুমি এবার নিশ্চয়ই মাঠ ছাড়বে ? ‘ তখন গ্রেস বলেন , ‘ দেখতেই তো পাচ্ছো একটা স্টাম্প এখনও মাটিতে দাঁড়িয়ে আছে , তাছাড়া লোকে গাঁটের পয়সা খরচ করে আমার ব্যাটিং দেখতে এসেছে , তোমার বোলিং দেখতে আসে নি ‘ । গ্রেসের একটা মজার অভ্যাস ছিল । স্লিপে বা আউটফিল্ডে ক্যাচ উঠলে তিনি বিকট চিৎকার করে উঠতেন , ‘ মিস ইট ‘ ব’লে ।‌ সেই ভয়াবহ চিৎকারে ফিল্ডার হকচকিয়ে গিয়ে ক্যাচ ফেলে দিতো । আসলে ক্রিকেট ব্যাপারটাই তিনি দারুণ উপভোগ করতে চাইতেন । ব্যাটিং ছিল তাঁর প্রাণের আরাম ।

তাঁর সমকালে দলের সঙ্গে কোনো ফিজিও থাকতেন না। তাই গ্রেস সাহেব তাঁর ডাক্তারি ব্যাগটা সবসময় সঙ্গে নিয়ে খেলতে যেতেন । নিজের দলের অথবা প্রতিপক্ষ দলের কোনো খেলোয়াড় আহত বা অসুস্থ হলেই তিনি তাঁর চিকিৎসা সরঞ্জাম নিয়ে লেগে পড়তেন তাঁকে সুস্থ করে তুলতে । তাঁর এই মানবিক দিকটি তাঁকে আরোও বেশি জনপ্রিয় করে তোলে । উইলিয়াম গিলবার্ট গ্রেস । সংক্ষেপে ডব্লিউ জি গ্রেস । তাঁকে বলা হয় আধুনিক ক্রিকেটের জনক । ১৮৪৮ সালের ১৮ জুলাই তিনি জন্মগ্রহণ করেন ইংল্যান্ডের ব্রিস্টলে এবং ২৩ অক্টোবর ( ১৯১৫ ) লন্ডনে তাঁর মৃত্যু হয় ৬৭ বছর বয়সে । প্রথমে তিনি ছিলেন অপেশাদার ক্রিকেটার । তিনিই প্রথম ক্রিকেটার যিনি একইসাথে ব্যাকফুট ও ফ্রন্টফুটে অতি সার্থকভাবে শটস খেলা শুরু করেন । সেইসময় ব্যাকফুটে খেলার প্রচলন ছিল না । গ্রেসের উদ্ভাবনী ক্ষমতা ছিল দেখার মতো । তাঁর নিখুঁত পেশাদারী মানসিকতা তাঁকে পরবর্তীতে পেশাদার ক্রিকেটের দিকে ঠেলে দেয় ।

প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ২৯ টি দলের হয়ে খেলে ৮৭০ ম্যাচে তিনি রান করেন ৫৪,২১১ । সেঞ্চুরি করেন ১২৪ টি , ফিফটি ২৫১ টি । বল হাতে পেস বোলিং করে উইকেট পান ২৮০৯ টি । ৫ উইকেট পান মোট ২৪০ বার এবং ১০ উইকেট পান ৬৪ বার । ক্যাচ নিয়েছেন মোট ৮৮৭ টি । এমন খাঁটি অলরাউন্ডার বিশ্ব ক্রিকেটে খুব কমই দেখা গেছে । ইংল্যান্ডের জাতীয় দলের হয়ে তাঁর অভিষেক হয় ৩২ বছর বয়সে । মোট ২২ ম্যাচে ২ টি সেঞ্চুরি-সহ ১০৯৮ রান করেন । খেলেছেন প্রায় ৫১ বছর বয়স পর্যন্ত । এই নিষ্ঠা ভাবা যায় না । এমন বর্ণময় ক্রিকেট-জীবন বিশ্ব ক্রিকেটের ইতিহাসে বিরল ।

আরও পড়ুন- শুধুমাত্র ফাটানো যাবে সবুজ বাজি! সময়সীমা বেঁধে দিল কলকাতা পুলিশ