Monday, November 10, 2025
উৎপল সিনহা

নিজের বাড়ির উঠোনে গণিতের সূত্র আঁকিবুকি করছেন একজন মগ্ন মানুষ । নিজের কাজে বিভোর তিনি । যেন জগতবিচ্ছিন্ন । ঠিক সেই সময় রোমানরা আক্রমণ করেছে তাঁর দেশ । তাঁর দেশের সম্রাট হেরেও গেছেন। কিন্তু তিনি ডুবে আছেন অঙ্কে। তিনি সাধক , তিনি মহা পণ্ডিত , বিজ্ঞানী । হঠাৎই তাঁর উঠোনে এক সৈন্যের আগমণ এবং হুঙ্কার বিজ্ঞানীকে এই মুহূর্তে করতে হবে আত্মসমর্পণ । কিন্তু সাধক মানুষটি সৈন্যের হুমকির তোয়াক্কা করেন না । তাঁর কোনোদিকে খেয়াল নেই। তাঁর ভুবন জুড়ে শুধু গণিত , গণিত আর গণিত ।

সৈন্য আবার হুঙ্কার ছাড়ে । এবার বিরক্ত হন সাধক । বলেন , ‘ আহ্ , বিরক্ত কোরো না , দেখছো না আমি কাজে ব্যস্ত ! ‘ আমার বৃত্ত স্পর্শ কোরো না । আর যায় কোথায় ! এ তো একেবারে আঁতে ঘা ।‌ জ্যামিতি বা গণিতের কী বোঝে সৈনিক ? সে বললো , ‘ কী ! পরাজিত নাগরিকের এতো বড়ো স্পর্ধা ? ‘ বলেই তলোয়ারের এক কোপ বসিয়ে দিল বিজ্ঞানীর গলায়। লুটিয়ে পড়লেন সাধক । এইভাবেই মৃত্যু হয় গ্রীক বিজ্ঞানী আর্কিমিডিসের ।

শোনা যায় আর্কিমিডিসের কাটা মুণ্ডু দেখে খুব দুঃখ পেয়েছিলেন রোমান সম্রাট । তাঁর নির্দেশ ছিল গ্রীক পণ্ডিত আর্কিমিডিসকে যেন হত্যা না করা হয় , কেননা তিনি মানব সভ্যতার সম্পদ । সম্রাট নাকি গুণের কদর করতেন ।

যদিও আর্কিমিডিসের বুদ্ধিতেই তিনি বারবার হেরে যাচ্ছিলেন যুদ্ধে । বিজ্ঞানীর তৈরি করা বিশেষ আয়না পুড়িয়ে মেরেছে রোমান সৈন্যদের । তাঁর তৈরি করা অদ্ভুত যন্ত্র ডুবিয়ে দিয়েছে বহু জাহাজ । তবুও গুণী বিজ্ঞানীর প্রতি রুষ্ট হন নি সম্রাট । বরং মহাপণ্ডিত এই সাধককে একবার সচক্ষে দেখতে চেয়েছিলেন তিনি । সে যাই হোক , মূর্খ সৈনিক জানতেও পারলো না কত বড়ো ক্ষতি সে করলো মানবসভ্যতার ।

আর্কিমিডিস কেন বিখ্যাত সবাই জানে । বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে তাঁর বিশাল অবদানের কথাও কে না জানে । তিনি ছিলেন একাধারে গণিতবিদ , জ্যোতির্বিদ , প্রকৌশলী এবং দার্শনিক । প্রাচীন গ্রীক সভ্যতা তার উন্নতির সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেছিল বিজ্ঞানী আর্কিমিডিসের সময়ে । তাই তাঁকে ক্লাসিক্যাল যুগের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী হিসেবে বিবেচনা করা হয় । পদার্থবিদ্যায় তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদানের মধ্যে রয়েছে স্থিতিবিদ্যা আর প্রবাহী স্থিতিবিদ্যার ভিত্তি স্থাপন , লিভারের কার্যনীতির বিস্তারিত ব্যাখ্যাপ্রদান। জল তোলার জন্য স্ক্রু-পাম্প , যুদ্ধকালীন আক্রমণের জন্য সীজ ইঞ্জিন ইত্যাদি মৌলিক যন্ত্রপাতির ডিভাইসের উদ্ভাবক তিনিই । পাশাপাশি রাখা একগুচ্ছ আয়নায় সূর্যরশ্মির প্রতিফলনে আক্রমণকারী জাহাজে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার ( যদিও এর সম্ভাব্যতা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে আজও ) পদ্ধতিরও উদ্ভাবক পণ্ডিত আর্কিমিডিস ( জন্ম : ২৮৭ বিসি , মৃত্যু : ২১২ বিসি ) । তিনি মেথড অফ এক্সহসন ব্যবহার করে অসীম ধারার সমষ্টি রূপে প্যারাবোলার বক্ররেখার অন্তর্গত ক্ষেত্রের ক্ষেত্রফল নির্ণয় করেন । ‘ পাই ‘ – এর নিখুঁত একটি মান নির্ণয় করেন । অনেক বড়ো সংখ্যাকে সহজে প্রকাশ করার একটি চমৎকার পদ্ধতি আবিষ্কার করেন ।

আনুমানিক ৫৩০ খ্রীষ্টাব্দে গ্রীক স্থপতি ইসেডোর অফ মিলেতাস সর্বপ্রথম বিজ্ঞানী আর্কিমিডিসের সমগ্র রচনা একত্রে লিপিবদ্ধ করেন । পরবর্তীতে ষষ্ঠ শতাব্দীতে গ্রীক গণিতবিদ ইউতোসিয়াস আর্কিমিডিসের কাজের উপর একটা বিবরন প্রকাশ করেন , যা তাঁকে বৃহত্তর পাঠকসমাজের কাছে পরিচিত করে তোলে । তাঁর কাজের খুব কম লিখিত দলিল মধ্যযুগের পর অবশিষ্ট ছিল । কিন্তু সেই অল্প কিছু দলিলই পরবর্তী সময়ে রেনেসাঁ যুগের বিজ্ঞানীদের কাছে খুবই উপকারী বলে বিবেচিত হয় । ১৯০৬ সালে আর্কিমিডিসের একটি নতুন পাণ্ডুলিপি আবিষ্কৃত হয় , যা গাণিতিক সমস্যা সমাধানের পদ্ধতির ওপর নতুনভাবে আলোকপাত করে । আর হ্যাঁ , মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে তাঁর নির্বিকার চিত্তে বৃত্ত আঁকা অমর হয়ে আছে ।

রোমান দার্শনিক সিসেরো আর্কিমিডিসের সমাধির উপরে একটি সিলিন্ডারের ভেতরে আবদ্ধ একটি গোলকের উল্লেখ করেছেন । আর্কিমিডিস প্রমাণ করেছিলেন যে সিলিন্ডারের ভেতরে আবদ্ধ গোলকটির আয়তন এবং ভূমির ক্ষেত্রফল উভয়ই সিলিন্ডারের দুই-তৃতীয়াংশ , যা আর্কিমিডিসের অন্যতম সেরা এক অর্জন হিসেবে প্রশংসিত । আর্কিমিডিসের সবচেয়ে জনপ্রিয় আবিষ্কারসমূহের অন্যতম হলো , অনিয়মিত আকারের বস্তুর আয়তন পরিমাপের পদ্ধতির উদ্ভাবন।

সম্রাটের জন্য তৈরি সোনার মুকুটে খাদ আছে কিনা তা বের করার দায়িত্ব দেওয়া হয় আর্কিমিডিসকে । মুকুটের কোনো ক্ষতি না করে খাদ আছে কিনা তা বের করা কি বড়ো সহজ কাজ ? ঘুম ছুটে গেল বিজ্ঞানীর । কি উপায় ! কী উপায় ? এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই একদিন হঠাৎ করেই ঘটে গেল বিরাট এক ঘটনা । জলভরা এক চৌবাচ্চায় স্নান করতে নেমে শরীর ডোবাতেই তিনি দেখলেন বেশ কিছুটা জল উপচে পড়লো । সঙ্গেসঙ্গেই তিনি চিৎকার করে উঠলেন ,’ ইউরেকা ইউরেকা ‘ , অর্থাৎ পেয়ে গেছি , পেয়েছি । মুকুটের খাদ বের করার উপায় পেয়ে গেলেন তিনি । লিভারের নীতি ও তরলে নিমজ্জিত বস্তুর উপর ক্রিয়াশীল ঊর্ধ্বমুখী বলের সূত্র আবিষ্কার করে ধাতুর ভেজাল নির্ণয় করতে সমর্থ হলেন তিনি । বস্তুর আপেক্ষিক ঘণত্ব নির্ণয়ের এই সূত্র বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় এক অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ।

আরও পড়ুন- ঘরের মাঠে ব্যাক টু ব্যাক জয় লাল-হলুদের, জামশেদপুরকে হারাল ১-০ গোলে

_

_

_

Related articles

সব মামলায় জামিন, সাড়ে তিনবছর পরে জেলমুক্তি ঘটতে চলছে পার্থর

অবশেষে সব মামলায় জামিন পেলেন রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় (Partha Chatterjee)। সোমবার বিকেলে বিশেষ সিবিআই আদালত তাঁর...

জাতীয় দলে শামির পক্ষেই সওয়াল সৌরভের, ইডেনে পিচ পরিদর্শন গম্ভীরের

কয়েকদিন পরই  ইডেনে শুরু হবে ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা টেস্ট(IND vs SA Test)। ইতিমধ্যেই দুই দল কলকাতায় চলে এসেছে। সোমবার...

লালকেল্লার কাছে মেট্রো স্টেশনের গেটে ভয়াবহ বিস্ফোরণ, রাজধানী জুড়ে জারি হাই অ্যালার্ট

ভয়াবহ বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল দিল্লির (Delhi) লালকেল্লা চত্বর। লালকেল্লা (Red Fort) কাছে মেট্রো স্টেশনের ১ নম্বর কাছে দাঁড়িয়ে...

রিচার নামে স্টেডিয়ামকে স্বাগত, ট্রোলিং নিয়ে সোজা সাপটা জবাব দিলেন সৌরভ

বিশ্বজয়ী ক্রিকেটার তথা উত্তরবঙ্গের ভূমিকন্যা রিচা ঘোষের(Rich Ghosh) নামে স্টেডিয়াম তৈরি হবে শিলিগুড়িতে। সোমবার শিলিগুড়ির উত্তরকন্যায় প্রশাসনিক বৈঠক...
Exit mobile version