‘অনির্বাণ জ্যামিতি’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

নিজের বাড়ির উঠোনে গণিতের সূত্র আঁকিবুকি করছেন একজন মগ্ন মানুষ । নিজের কাজে বিভোর তিনি । যেন জগতবিচ্ছিন্ন । ঠিক সেই সময় রোমানরা আক্রমণ করেছে তাঁর দেশ । তাঁর দেশের সম্রাট হেরেও গেছেন। কিন্তু তিনি ডুবে আছেন অঙ্কে। তিনি সাধক , তিনি মহা পণ্ডিত , বিজ্ঞানী । হঠাৎই তাঁর উঠোনে এক সৈন্যের আগমণ এবং হুঙ্কার বিজ্ঞানীকে এই মুহূর্তে করতে হবে আত্মসমর্পণ । কিন্তু সাধক মানুষটি সৈন্যের হুমকির তোয়াক্কা করেন না । তাঁর কোনোদিকে খেয়াল নেই। তাঁর ভুবন জুড়ে শুধু গণিত , গণিত আর গণিত ।

সৈন্য আবার হুঙ্কার ছাড়ে । এবার বিরক্ত হন সাধক । বলেন , ‘ আহ্ , বিরক্ত কোরো না , দেখছো না আমি কাজে ব্যস্ত ! ‘ আমার বৃত্ত স্পর্শ কোরো না । আর যায় কোথায় ! এ তো একেবারে আঁতে ঘা ।‌ জ্যামিতি বা গণিতের কী বোঝে সৈনিক ? সে বললো , ‘ কী ! পরাজিত নাগরিকের এতো বড়ো স্পর্ধা ? ‘ বলেই তলোয়ারের এক কোপ বসিয়ে দিল বিজ্ঞানীর গলায়। লুটিয়ে পড়লেন সাধক । এইভাবেই মৃত্যু হয় গ্রীক বিজ্ঞানী আর্কিমিডিসের ।

শোনা যায় আর্কিমিডিসের কাটা মুণ্ডু দেখে খুব দুঃখ পেয়েছিলেন রোমান সম্রাট । তাঁর নির্দেশ ছিল গ্রীক পণ্ডিত আর্কিমিডিসকে যেন হত্যা না করা হয় , কেননা তিনি মানব সভ্যতার সম্পদ । সম্রাট নাকি গুণের কদর করতেন ।

যদিও আর্কিমিডিসের বুদ্ধিতেই তিনি বারবার হেরে যাচ্ছিলেন যুদ্ধে । বিজ্ঞানীর তৈরি করা বিশেষ আয়না পুড়িয়ে মেরেছে রোমান সৈন্যদের । তাঁর তৈরি করা অদ্ভুত যন্ত্র ডুবিয়ে দিয়েছে বহু জাহাজ । তবুও গুণী বিজ্ঞানীর প্রতি রুষ্ট হন নি সম্রাট । বরং মহাপণ্ডিত এই সাধককে একবার সচক্ষে দেখতে চেয়েছিলেন তিনি । সে যাই হোক , মূর্খ সৈনিক জানতেও পারলো না কত বড়ো ক্ষতি সে করলো মানবসভ্যতার ।

আর্কিমিডিস কেন বিখ্যাত সবাই জানে । বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে তাঁর বিশাল অবদানের কথাও কে না জানে । তিনি ছিলেন একাধারে গণিতবিদ , জ্যোতির্বিদ , প্রকৌশলী এবং দার্শনিক । প্রাচীন গ্রীক সভ্যতা তার উন্নতির সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেছিল বিজ্ঞানী আর্কিমিডিসের সময়ে । তাই তাঁকে ক্লাসিক্যাল যুগের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী হিসেবে বিবেচনা করা হয় । পদার্থবিদ্যায় তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদানের মধ্যে রয়েছে স্থিতিবিদ্যা আর প্রবাহী স্থিতিবিদ্যার ভিত্তি স্থাপন , লিভারের কার্যনীতির বিস্তারিত ব্যাখ্যাপ্রদান। জল তোলার জন্য স্ক্রু-পাম্প , যুদ্ধকালীন আক্রমণের জন্য সীজ ইঞ্জিন ইত্যাদি মৌলিক যন্ত্রপাতির ডিভাইসের উদ্ভাবক তিনিই । পাশাপাশি রাখা একগুচ্ছ আয়নায় সূর্যরশ্মির প্রতিফলনে আক্রমণকারী জাহাজে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার ( যদিও এর সম্ভাব্যতা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে আজও ) পদ্ধতিরও উদ্ভাবক পণ্ডিত আর্কিমিডিস ( জন্ম : ২৮৭ বিসি , মৃত্যু : ২১২ বিসি ) । তিনি মেথড অফ এক্সহসন ব্যবহার করে অসীম ধারার সমষ্টি রূপে প্যারাবোলার বক্ররেখার অন্তর্গত ক্ষেত্রের ক্ষেত্রফল নির্ণয় করেন । ‘ পাই ‘ – এর নিখুঁত একটি মান নির্ণয় করেন । অনেক বড়ো সংখ্যাকে সহজে প্রকাশ করার একটি চমৎকার পদ্ধতি আবিষ্কার করেন ।

আনুমানিক ৫৩০ খ্রীষ্টাব্দে গ্রীক স্থপতি ইসেডোর অফ মিলেতাস সর্বপ্রথম বিজ্ঞানী আর্কিমিডিসের সমগ্র রচনা একত্রে লিপিবদ্ধ করেন । পরবর্তীতে ষষ্ঠ শতাব্দীতে গ্রীক গণিতবিদ ইউতোসিয়াস আর্কিমিডিসের কাজের উপর একটা বিবরন প্রকাশ করেন , যা তাঁকে বৃহত্তর পাঠকসমাজের কাছে পরিচিত করে তোলে । তাঁর কাজের খুব কম লিখিত দলিল মধ্যযুগের পর অবশিষ্ট ছিল । কিন্তু সেই অল্প কিছু দলিলই পরবর্তী সময়ে রেনেসাঁ যুগের বিজ্ঞানীদের কাছে খুবই উপকারী বলে বিবেচিত হয় । ১৯০৬ সালে আর্কিমিডিসের একটি নতুন পাণ্ডুলিপি আবিষ্কৃত হয় , যা গাণিতিক সমস্যা সমাধানের পদ্ধতির ওপর নতুনভাবে আলোকপাত করে । আর হ্যাঁ , মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে তাঁর নির্বিকার চিত্তে বৃত্ত আঁকা অমর হয়ে আছে ।

রোমান দার্শনিক সিসেরো আর্কিমিডিসের সমাধির উপরে একটি সিলিন্ডারের ভেতরে আবদ্ধ একটি গোলকের উল্লেখ করেছেন । আর্কিমিডিস প্রমাণ করেছিলেন যে সিলিন্ডারের ভেতরে আবদ্ধ গোলকটির আয়তন এবং ভূমির ক্ষেত্রফল উভয়ই সিলিন্ডারের দুই-তৃতীয়াংশ , যা আর্কিমিডিসের অন্যতম সেরা এক অর্জন হিসেবে প্রশংসিত । আর্কিমিডিসের সবচেয়ে জনপ্রিয় আবিষ্কারসমূহের অন্যতম হলো , অনিয়মিত আকারের বস্তুর আয়তন পরিমাপের পদ্ধতির উদ্ভাবন।

সম্রাটের জন্য তৈরি সোনার মুকুটে খাদ আছে কিনা তা বের করার দায়িত্ব দেওয়া হয় আর্কিমিডিসকে । মুকুটের কোনো ক্ষতি না করে খাদ আছে কিনা তা বের করা কি বড়ো সহজ কাজ ? ঘুম ছুটে গেল বিজ্ঞানীর । কি উপায় ! কী উপায় ? এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই একদিন হঠাৎ করেই ঘটে গেল বিরাট এক ঘটনা । জলভরা এক চৌবাচ্চায় স্নান করতে নেমে শরীর ডোবাতেই তিনি দেখলেন বেশ কিছুটা জল উপচে পড়লো । সঙ্গেসঙ্গেই তিনি চিৎকার করে উঠলেন ,’ ইউরেকা ইউরেকা ‘ , অর্থাৎ পেয়ে গেছি , পেয়েছি । মুকুটের খাদ বের করার উপায় পেয়ে গেলেন তিনি । লিভারের নীতি ও তরলে নিমজ্জিত বস্তুর উপর ক্রিয়াশীল ঊর্ধ্বমুখী বলের সূত্র আবিষ্কার করে ধাতুর ভেজাল নির্ণয় করতে সমর্থ হলেন তিনি । বস্তুর আপেক্ষিক ঘণত্ব নির্ণয়ের এই সূত্র বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় এক অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ।

আরও পড়ুন- ঘরের মাঠে ব্যাক টু ব্যাক জয় লাল-হলুদের, জামশেদপুরকে হারাল ১-০ গোলে

_

_

_