
‘ এ পানপাত্র নিদারুণ বিষে ভরা
দূরে ফেলে দাও দূরে ফেলে দাও ত্বরা ‘

যে মারে , সে ভুলে যায় । যে মার খায় , সে ভোলে না । অবশ্য এর উল্টোটাও ঘটে । মহাজ্ঞানী সক্রেটিসের শেষ দিনগুলোয় এমন দেখা গিয়েছিল । তাঁর মৃত্যুদণ্ডের দিন ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পরেও কারাগারে সক্রেটিসের নির্লিপ্তি দেখে হতবাক হয়ে গিয়েছিল সকলে । যিনি মাত্র কয়েকদিন পরেই মারা যাবেন , তিনি এত নির্বিকার , এমন শান্তচিত্ত থাকতে পারেন কীভাবে ? অথচ কারাগারের দায়িত্বে থাকা কর্মীরা , এমনকি যিনি বিষের পাত্র তুলে দেবেন সক্রেটিসের হাতে , তিনি পর্যন্ত কাঁদছেন , অথচ পরম নিশ্চিন্তে রয়েছেন সক্রেটিস স্বয়ং । তাঁর সারা মুখে একরাশ প্রশান্তি ।
সক্রেটিস বললেন , ‘ আজীবন আইন মেনেছি , মৃত্যুতে আইন ভাঙবো কেন ? ‘ তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে সন্ধ্যায় । তখনকার নিয়ম অনুযায়ী পরিবারের সকলে এবং একান্ত শিষ্যবৃন্দ তাঁকে ঘিরে আছেন অন্ধকার ঘরে । প্রধান কারারক্ষী এসে শেষ বিদায় জানালেন , তাঁর চোখেও জল । অথচ যিনি মারা যাবেন , তিনি ধীরস্থির , শান্ত । কী আশ্চর্য জীবন ! কারাগার প্রধান বললেন , এথেন্সের হে মহান সন্তান , দয়া করে আমাকে অভিশাপ দেবেন না , আমি তো দায়িত্ব পালন করছি মাত্র । এতো বছর কারাগারের দায়িত্বে আছি , কিন্তু আপনার মতো জ্ঞানী , সাহসী ও মহৎপ্রাণ মানুষ আমি দেখি নি । আমাকে ক্ষমা করুন ।

মৃত্যুর আগে নতুন পোশাক পরলেন সক্রেটিস । পরিবারের নারী ও শিশুদের চলে যেতে বললেন । শান্ত , নিরুদ্বেগ তিনি । মৃত্যুতে কি কিছুই যায় আসে না তাঁর ? চাইলেই তো মৃত্যু এড়িয়ে যেতে পারতেন তিনি ।

কী অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে ? কেন তাঁর মৃত্যুদণ্ড ? তিনি নাকি দেবতাদের প্রতি ভিন্নমত পোষণ করেছেন । তরুণ প্রজন্মকে বিপথগামী করেছেন । রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র করেছেন । নিয়মানুযায়ী খোলা মাঠে তাঁর বিচারসভা বসেছিল । বিচারক ছিলেন তৎকালীন সমাজের ৫০০ জন জ্ঞানী মানুষ । এঁদের অনেকেই গ্রীসের রাজার একান্ত অনুগত ছিলেন । তাঁরা ঈর্ষা করতেন সক্রেটিসের মেধা ও জনপ্রিয়তাকে । বিশেষ করে তরুণ সমাজে তাঁর তুমুল জনপ্রিয়তায় তাঁরা শঙ্কিত ছিলেন । তবুও হয়তো প্রাণে বেঁচে যেতেন তিনি । কিন্তু কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েও বিচারকদের উপহাস করতে ভুললেন না তিনি । ফলে চরম শাস্তি মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হলো । হেমলক বিষপ্রয়োগে তাঁর মৃত্যু ধার্য হলো ।

আত্মপক্ষ সমর্থনে সক্রেটিস বিচারকদের প্রশ্নবানে জর্জরিত করে তোলেন । তাঁর একটি প্রশ্নেরও ঠিকঠাক উত্তর দিতে পারেন নি বিচারপতিরা । মৃত্যুর আগে একমাস কারাগারে বন্দী ছিলেন তিনি । সেই একমাস তাঁর প্রজ্ঞায় মুগ্ধ হয়ে যান কারাকর্মীরা । তাঁরা সক্রেটিসেকে পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিতেন । কিন্তু সক্রেটিস সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতেন । তিনি সবিনয়ে জানাতেন যে , পালিয়ে গেলে ইতিহাস তাঁকে কাপুরুষ হিসেবে মনে রাখবে । অপমানের জীবনের চেয়ে বীরের মৃত্যু শ্রেয় , এই ছিল তাঁর দর্শন । শেষদিন নির্দিষ্ট সন্ধ্যায় জল্লাদ এলেন পেয়ালা হাতে ।

পেয়ালা ভর্তি হেমলকের বিষ। জল্লাদের নির্দেশ , পুরো বিষটা পান করতে হবে সক্রেটিসকে । একফোঁটা নষ্ট করা যাবে না । তিক্ত বিষের পুরোটা পান করলেন তিনি । তারপর নিয়মানুযায়ী কিছুক্ষণ পায়চারি করতে হলো তাঁকে , যাতে বিষের প্রভাব তাঁর সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে । শিষ্যেরা হায় হায় করে কাঁদতে লাগলেন ।
সক্রেটিস ম্লান হেসে তাঁদের শান্ত থাকতে বললেন । তিনি বললেন , ‘ আমাকে শান্তিতে মরতে দাও ‘ । লজ্জিত জল্লাদ মাথা নামিয়ে নিলেন ।

চাদর দিয়ে নিজের মুখটা ঢাকতে ঢাকতে সক্রেটিস তাঁর এক ছাত্রকে বললেন , ‘ এক প্রতিবেশীর কাছে একটা মুরগি ধার করেছিলাম আমি , ওটা ফেরত দিয়ে দিও ‘ । প্রহসনের বিচারে তাঁর মৃত্যু হয়েছে ঠিকই , কিন্তু মৃত্যু তাঁকে শেষ করতে পারে নি । শিষ্যদের জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করে তিনি বেঁচে রইলেন অনন্তকাল । শোনা যায় , তাঁর মৃত্যুর পর জল্লাদ সহ বেশ কয়েকজন বিচারক অনুশোচনায় আত্মহত্যা করেছিলেন । প্রায় আড়াই হাজার বছর পরে সক্রেটিসের গুণমুগ্ধ প্লেটো লিখলেন গুরু সক্রেটিসকে নিয়ে গ্রন্থ , রিপাবলিক । এরপর প্লেটোর শিষ্য এবং আলেকজান্ডারের শিক্ষক মহাজ্ঞানী এরিস্টটল লিখলেন অমর গ্রন্থ ‘ দ্য পলিটিক্স ‘ ।


_

_
