‘গিলগামেশ’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

উরুক শহরের রাজা গিলগামেশ অমরত্বের সন্ধানে বেরিয়েছিলেন । কিন্তু কেন তাঁকে বেরোতে হয়েছিল অমরত্বের খোঁজে ? কেননা তিনি দেবতাদের রোষানলে পড়েছিলেন ।

উরুক কোথায় ? মেসোপটেমিয়ার নগররাজ্য উরুক। সেখানকার রাজা গিলগামেশ । আসলে গিলগামেশ মেসোপটেমিয়া পুরাণের একটি চরিত্র । তাঁর গল্প মানবিক ইতিহাসের প্রথম মহাকাব্য । এটি খৃষ্টপূর্ব
২০০০ সালে রচিত । এই মহাকাব্য আবর্তিত হয়েছে মূলত গিলগামেশ ও তাঁর বন্ধু এনকিদু-কে ঘিরে । আক্কাদীয় ভাষায় রচিত এই মহাকাব্য । মেসোপটেমিয়া বর্তমান ইরাক , সিরিয়া , তুরস্ক এবং কুয়েতের কিছু অংশ । মানুষ অমর নয় , সে জানে । তবুও সে কিছুতেই মরতে চায় না । সে নিজেকে ভাবে অমৃতের সন্তান । তাই সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই মানুষ অমরত্বের সন্ধান করে চলেছে । গিলগামেশ পৃথিবীর প্রাচীনতম উপাখ্যান । সম্ভবত এটিই পৃথিবীর প্রথম গল্প ।

গল্পে আছে , এনকিদুকে দেবতারা প্রেরণ করেন গিলগামেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য । কিন্তু কিছু ঘটনাপরম্পরায় এনকিদু একসময় গিলগামেশের সঙ্গে বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হন । এনকিদু কমিক্সের বীর টারজানের মতো একটি চরিত্র , যাঁকে দেবতা আরুরু সৃষ্টি করেন । দেবমাতা নিনসনের দ্বিতীয় পুত্র হিসেবে তিনি পরিচিতি লাভ করেন । দেবমাতার আদেশে গিলগামেশ ও এনকিদু একসাথে বিভিন্ন অভিযানে যান , যার বিবরণ এই মহাকাব্যে পাওয়া যায় । মহাকাব্যে ঘটনাক্রমে স্বর্গের ষাঁড় হত্যা ও অপদেবতা হুমাবাবা হত্যার জন্য শাস্তি হিসেবে এনকিদুর মৃত্যু হলে ভেঙে পড়ে গিলগামেশ । বন্ধু এনকিদুর মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেন না তিনি ।তাই প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকেন মৃত বন্ধুকে পুনর্জীবিত করার। তিনি শুনতে পান , পৃথিবীর একেবারে শেষ প্রান্তে নাকি উৎনাপিশতিম নামে একজন আছেন , যিনি নাকি মৃত্যুকে জয় করেছেন । শুধুমাত্র তিনিই জানেন অমরত্বের রহস্য । তাই যে করেই হোক তাঁর কাছে পৌঁছানোর জন্য গিলগামেশ বেরিয়ে পড়েন রাজ্য ছেড়ে । বিশাল অরণ্য , পাতাল থেকে শুরু করে আকাশছোঁয়া মাশুপর্বত পেরিয়ে তিনি মৃত্যুসাগরের তীরে পৌঁছোন । উৎনাপিশতিমের নৌকার মাঝি উর্শানাবি ছাড়া আর কেউ ওই নদী পেরোতে পারে না । অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও মাঝি গিলগামেশকে নদী পেরোতে কোনো সাহায্য করে না । তখন সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় অসম্ভবকে সম্ভব করে গিলগামেশ অবশেষে হাজির হলেন উৎনাপিশতিমের কাছে। কিন্তু উৎনাপিশতিম তাঁকে জানান , মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার কোনো উপায় তাঁর জানা নেই । তিনি নিজে মহাপ্লাবনের সময় দেবতা এয়ার দয়ায় বেঁচে গেছেন । অতএব মৃত্যু অনিবার্য এবং এটাই জীবনের নিয়ম ।

এ কথা শুনে ভীষণ আশাহত হন গিলগামেশ । তাঁকে দেখে তখন উৎনাপিশতিমের স্ত্রীর খুব মায়া হয় । প্রায় অসম্ভবকে সম্ভব করে আসা একজন মানুষকে এভাবে আশাহত করার জন্য তিনি রীতিমতো ভর্ৎসনা করেন তাঁর স্বামীকে । তখন উৎনাপিশতিম বলেন , মৃত্যুসাগরের তলায় গায়ে কাঁটাযুক্ত একধরনের লতা আছে , জীয়নলতা । এই লতাই পারে মানুষকে অমরত্ব দিতে । অতঃপর গিলগামেশ অভিযানে নেমে উদ্ধার করেন সেই মহামূল্য জীয়নলতা । তারপর ফিরতে থাকেন উরুকের উদ্দেশে ।‌ তাঁর বন্ধুকে যে করেই হোক বাঁচাতে হবে । দিতে হবে অমরত্ব । ফেরার পথে একসময় এক দীঘির পাড়ে জীয়নলতা রেখে স্নান করতে নামেন গিলগামেশ । শীতল জলে স্নান করে প্রাণ জুড়িয়ে যায় তাঁর । মনে তাঁর সফল অভিযানের প্রশান্তি । কিন্তু পাড়ে এসে কী দেখলেন তিনি ? জীয়নলতা নেই । একটা সাপ এসে খেয়ে গেছে সেই জীয়নলতা । এভাবেই তাঁর এত পরিশ্রম ব্যর্থ হয়ে যায় । শেষ হয়ে যায় সব আশা ।

মন ভেঙে যায় তাঁর । তারপর একসময় গিলগামেশ উপলব্ধি করেন যে , মৃত্যু জীবনের অনিবার্য সত্য । কেউ অমর নয় । তখন তাঁর হতাশা কেটে যায় । সত্যের আলোয় উদ্ভাসিত হয় তাঁর মনপ্রাণ । তাঁর উপলব্ধি তাঁকে নতুন স্বপ্ন দেখায় । এভাবেই শেষ হয় গিলগামেশ উপাখ্যান । এই কাব্যে বন্ধুর জন্য বন্ধুর ভালোবাসা অমর হয়ে আছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী এই গল্প পুরোনো হয় না । এখনও মানুষ এই গল্প পড়ে চলেছে , ভবিষ্যতেও পড়বে ।

আরও পড়ুন- ইডেনে ব্যাট হাতে বিরাট দাপট কোহলির, প্রথম ম্যাচে হারের মুখ দেখল কেকেআর

_

 

_

 

_

 

_

 

_

 

_