ব্রিটেনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েলবিয়িং রিসার্চ সেন্টার এবং মার্কিন ম্যানেজমেন্ট সংস্থা ‘গ্যালাপ’ প্রকাশিত ‘বিশ্ব সুখ-সূচক, ২০২৫’ নিয়ে উঠেছে একাধিক প্রশ্ন। সমীক্ষা রিপোর্টে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেন ও গাজা এবং পাকিস্তানকে ভারতের চেয়ে সুখী দেশ বলে দাবি করা হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, যেখানে যুদ্ধ আর মৃত্যুর হাহাকার, সেখানকার বাসিন্দারা কীভাবে সুখী ? এমনকী, আনন্দে আছে পাকিস্তানও!অথচ শান্ত ভারতের মানুষের মন দুঃখে ভরা!তাই স্বাভাবিকভাবেই এমন অদ্ভুত সমীক্ষা রিপোর্ট নিয়ে গোটা বিশ্বে শোরগোল পড়ে গিয়েছে।

এই রিপোর্টকে ‘পাগলের প্রলাপ’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন নেটিজেনদের একাংশ।চলতি বছরের ২০ মার্চ প্রকাশিত হয় ‘বিশ্ব সুখ-সূচক’ । সেখানে সুখী দেশগুলির একটি তালিকা দিয়েছেন সমীক্ষকেরা। ওই তালিকায় ১৪৭টি রাষ্ট্রের মধ্যে ১১৮তম স্থান পেয়েছে ভারত।আশ্চর্যজনক ভাবে নয়াদিল্লির বেশ কিছুটা ওপরেই রয়েছে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেন এবং প্যালেস্টাইন।এ ছাড়া ‘বিশ্ব সুখ-সূচক’এ ভারতের আগে জায়গা পেয়েছে প্রায় দেউলিয়া হতে চলা ও গৃহযুদ্ধের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা পাকিস্তান। গত কয়েক বছরে বিদ্রোহী এবং সন্ত্রাসীদের হামলায় রীতিমতো ক্ষতবিক্ষত পাকিস্তান। তার পরও ইসলামাবাদ উপরের দিকে স্থান পেয়েছে।তাই সমীক্ষকদের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

সমীক্ষা রিপোর্টটি প্রকাশ করেছে ব্রিটেনের বিখ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েলবিয়িং রিসার্চ সেন্টার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানেজমেন্ট সংস্থা ‘গ্যালাপ’ তাদের সহযোগিতা করেছে। রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২২ এবং ২০২৩ সালের তুলনায় ভারতের অবস্থার উন্নতি হয়েছে। ওই দু’বছর ১২৬তম স্থানে ছিল নয়াদিল্লি।এ বছরের সমীক্ষা রিপোর্টে ১০৯ নম্বরে রয়েছে পাকিস্তান। ইউক্রেন রয়েছে ১১১ নম্বর স্থানে। ইসলামাবাদের চেয়ে এক ধাপ উপরে রয়েছে প্যালেস্টাইন। তাদের অবস্থান ১০৮। রিপোর্টটি প্রকাশিত হওয়ার এক দিনের মাথাতেই প্যালেস্টাইনের গাজ়ায় ইজরায়েলি বায়ুসেনার বোমাবর্ষণে বহু মানুষের জীবনহানির খবর প্রকাশ্যে এসেছে।

এছাড়া ভারতের উপরে একগুচ্ছ আফ্রিকার দেশ রয়েছে রিপোর্টে। যাদের মধ্যে রয়েছে ক্যামেরুন, নাইজেরিয়া, সেনেগাল, নাইজার, মরক্কো, তিউনিশিয়া এবং কেনিয়া। প্রতিবেশী দেশগুলির মধ্যে নেপাল এবং ভুটানের স্থান যথাক্রমে ৯২ এবং ৯৫। এ ছাড়া পূর্ব দিকের বাংলাদেশ এবং মায়ানমার রয়েছে ১৩৪ এবং ১২৬ নম্বর স্থানে।এই সমীক্ষা রিপোর্টে আরও এক বার আফগানিস্তানকে বিশ্বের ‘সবচেয়ে অসুখী’ দেশ বলা হয়েছে।


সমীক্ষকদের দাবি, পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী দেশ হল ফিনল্যান্ড। দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ স্থানে রয়েছে ডেনমার্ক, আইসল্যান্ড এবং সুইডেন।‘বিশ্ব সুখ সূচক’ অনুযায়ী, আফগান মহিলাদের জীবনযাত্রার অবনতি ঘটেছে। তালিকায় কানাডার নীচে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ২৪তম স্থান পেয়েছে ওয়াশিংটন, যা বিগত বছরগুলির নিরিখে সর্বনিম্ন। চিন রয়েছে ৬৮তম স্থানে। এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে সুখী দেশ হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে তাইওয়ান। তাদের র্যাঙ্কিং ২৭।


আরও মজার বিষয় হল, এই রিপোর্টে ভারতের সামনে রয়েছে ইরাক এবং সিরিয়ার মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। তালিকায় ১০ ধাপ নীচে নেমে গিয়েছে হংকং এবং সিঙ্গাপুর। তাইল্যান্ড, জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়া রয়েছে যথাক্রমে ৪৯, ৫৫ এবং ৫৮ নম্বর স্থানে। শ্রীলঙ্কা রয়েছে ১৩৩ নম্বরে। আর যুদ্ধবিধ্বস্ত ইজ়রায়েলের স্থান আট।

সমীক্ষকদের দাবি, মূলত তিনটি মূল বিষয়ের উপর নির্ভর করে এই তালিকা তৈরি করা হয়েছে। সেগুলি হল জীবনের মূল্যায়ন, ইতিবাচক আবেগ এবং নেতিবাচক আবেগ। তারা বলেছেন, সুখের র্যাঙ্কিং মূলত জীবনের মূল্যায়নের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়। কারণ এটি মানুষের জীবনযাত্রার মানকে আরও স্থিতিশীল করে তোলে। এ ছাড়া ‘বিশ্ব সুখ-সূচক’ তৈরি করতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলির আমজনতার মতামত সংগ্রহে জোর দিয়েছে মার্কিন ম্যানেজমেন্ট সংস্থা ‘গ্যালাপ’। তালিকায় নাম থাকা প্রতিটি রাষ্ট্রের অন্তত হাজার জন নাগরিকের সঙ্গে কথা বলেছে তারা। পাশাপাশি নাগরিকদের মাথাপিছু গড় আয়ও দেখা হয়েছে বলে জানা গিয়েছে।

সমীক্ষকদের আরও দাবি, সংশ্লিষ্ট রিপোর্টে সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার ভূমিকা খতিয়ে দেখা হয়েছে। তাদের কথায়, সুখ বা যত্ন ভাগ করে নেওয়ার একটি সর্বজনীন পদ্ধতি হল, নাগরিকদের খাবার ভাগ করে খাওয়ার প্রবণতা। সুখী দেশগুলির বাসিন্দারা পরিবার পরিজনদের সঙ্গে এক টেবিলে বসে খেতে পছন্দ করেন। অন্য দিকে আমেরিকায় এই প্রবণতা কমছে। কিন্তু এই রিপোর্ট প্রকাশিত হতেই ফুঁসে উঠেছেন নেটিজেনরা। সমীক্ষকদের প্রতিটা কথা যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করেছেন তারা।

সমাজমাধ্যমে এক জন লিখেছেন, মাথাপিছু গড় আয়ের নিরিখে প্যালেস্টাইন বা পাকিস্তানের থেকে অনেক এগিয়ে রয়েছে ভারত। তা হলে কিসের ভিত্তিতে নয়াদিল্লিকে তালিকায় পিছনের দিকে স্থান দেওয়া হচ্ছে? নেটিজেনদের দ্বিতীয় প্রশ্ন সামাজিক মিথস্ক্রিয়া নিয়ে। ইরাক বা সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলার কারণে সেখানে এক টুকরো রুটির জন্য আমজনতাকে রীতিমতো মারামারি করতে হয়। একই ছবি পাকিস্তানেও।ভারতে এই ধরনের কোনও পরিস্থিতি নেই। উল্টে এখানকার পারিবারিক বন্ধন এখনও অনেক বেশি মজবুত ভীতের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে।তৃতীয়ত, যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেন, প্যালেস্টাইন বা সিরিয়ার নাগরিকদের ইতিবাচক মনোভাব খুব বেশি, এমনটা মানতে নারাজ তারা।
বরং, ইতিবাচক এবং নেতিবাচক মনোভাব বলতে সমীক্ষকেরা কী বোঝাতে চাইছেন, তাই নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তারা।সমীক্ষা রিপোর্টে আবার স্বেচ্ছাসেবী কাজ, দান-ধ্যান এবং অপরিচিতদের সাহায্য করার নিরিখে ভারতের স্থান উপরের দিকে রাখা হয়েছে। এই তিন শ্রেণিতে নয়াদিল্লি পেয়েছে যথাক্রমে ১০, ৫৭, এবং ৭৪ নম্বর র্যাঙ্কিং। প্রতিবেশী, অপরিচিত এবং হারানো টাকার ব্যাগ ফেরত পাওয়ার ক্ষেত্রে ১১৫, ৮৬ এবং ৯৩তম জায়গায় রয়েছে ভারত।রিপোর্টের এই অংশটি নিয়েও খোঁচা দিতে ছাড়েননি নেটিজেনরা। তাঁদের প্রশ্ন, দান-ধ্যান বা অপরিচিতদের সাহায্য পাকিস্তান, সিরিয়া, প্যালেস্টাইন বা ইরাকের মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলির নাগরিকেরা অনেক বেশি করছেন?

–
