বাংলা সিনেমার ইতিহাসে যুগান্তকারী ঘটনা। রাজ্যের সব সিনেমা হলে বাংলা ছায়াছবির স্ক্রিনিং নিয়ে বড় সিদ্ধান্তের কথা জানালেন রাজ্যের দুই মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস- ইন্দ্রনীল সেন (Arup Biswas- Indranil Sen)। বুধবার নন্দনে (Nandan) অভিনেতা- প্রযোজক- ফেডারেশনের সঙ্গে মিটিং করার পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে অরূপ জানান, রাজ্যের সিনে ইন্ডাস্ট্রি থেকে শুরু করে তথ্য সংস্কৃতি দফতর সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে এবার থেকে প্রাইম টাইম শো চলবে দুপুর ৩টে থেকে ৯টা পর্যন্ত। আগে দুপুর ১২টা থেকে ৯টা থাকার কারণে অনেকেই বাংলা ছবিকে দুপুর ১২টার সময় রাখত। এতে অনেকেই যেতে পারতেন না। তাই নিয়ম বদল। শুধু তাই নয় আগে বছরে ১২০টা বাংলা সিনেমা চালানো হত, এখন রাজ্যের সব সিনেমা হল মাল্টিপ্লেক্সের প্রতিটি স্ক্রিনে বছরে ৩৬৫ দিনই অন্তত একটি প্রাইম টাইম শোতে বাংলা ছবি দেখাতেই হবে। তথ্য সংস্কৃতি দফতরের তরফে এই সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে। ২০১৮ সালের ১৪ সেপ্টেম্বরের পূর্ববর্তী নির্দেশিকা বাতিল করে এই নতুন বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে সরকার। প্রয়োজন হলে ১৯৫৬ সালের তৈরি করা সিনেমা প্রদর্শন সংক্রান্ত নিয়ম কানুনেও সংশোধন আনা হবে বলে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে। নির্দেশ অনুযায়ী, এই নিয়ম অবিলম্বে কার্যকর হবে এবং পরবর্তী নির্দেশ না আসা পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেন বলেন, আজকের দিনটি ঐতিহাসিক। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগে ইন্ডাস্ট্রির সকলের মত নিয়ে এই সিদ্ধান্ত হয়েছে। এটা শুধু মাত্র সিনেমার ক্ষেত্রে নয়,বাংলার সংস্কৃতি, অস্মিতা সব কিছুরই যেন একটা নবজাগরণ হল এই সিদ্ধান্তের মধ্যে দিয়ে। তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের প্রধান সচিব শান্তনু বসুর সই করা বিজ্ঞপ্তি ইতিমধ্যেই রাজ্যের অর্থ দফতর, ক্রীড়া, যুবকল্যাণ, বিদ্যুৎ, পর্যটন, কৃষি আয়কর দফতর, সিনেমা লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষ, ইস্টার্ন ইন্ডিয়া মোশন পিকচার্স অ্যাসোসিয়েশন (EIMPA) ও মাল্টিপ্লেক্স অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়ার কাছে পাঠানো হয়েছে।

বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পকে উৎসাহিত করতেই রাজ্যের সমস্ত সিনেমা হল ও মাল্টিপ্লেক্সগুলিতে বাংলা ছবির দৈনন্দিন প্রদর্শনী বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এদিন নন্দনে মন্ত্রী অরূপ বলেন যে এবার থেকে মাল্টিপ্লেক্সে একটি স্ক্রিন সেখানে ৩৬৫টি , যেখানে দুটি স্ক্রিন সেখানে ৩৬৫x২ অর্থাৎ ৭৩০টি শো চলবে বছরে। তিনটে স্ক্রিন হলে ১০৯৫ এবং চারটে স্ক্রিন থাকলে সেখানে বছরে ১৪৬০টি বাংলা শো চলবে। এর ফলে আরও বেশি বেশি করে বাংলা সিনেমা তৈরি করতে পরিচালক, শিল্পী, প্রযোজকদের আগ্রহ বাড়বে। ফলে নানা কনটেন্টে বাংলা সিনেমা তৈরি হবে এবং প্রচার ও প্রসার দুই বাড়বে। এই যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত বাংলা ছবিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে বলেও আশাবাদী মন্ত্রী। ইন্দ্রনীল সেন বলেন, এই সিদ্ধান্তের ফলে গীতিকার, সুরকার, টেকনিশিয়ান থেকে শুরু করে লক্ষ লক্ষ মানুষ লাভবান হবেন। যারা বিগ বাজেট সিনেমা করতে পারেন না তাঁদের জন্য এটা একটা বড় জায়গা তৈরি করবে। বাংলার নবজাগরণের জন্য অত্যন্ত বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

বাংলা ছবির শো টাইম নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই তরজা চলছে। বলিউডের বড় কোনও ছবি মুক্তি পেলে ‘কোণঠাসা’ হয়ে যায় বাংলা সিনেমা। এই অভিযোগ নতুন নয়। আগামী ১৪ আগস্ট মুক্তি পেতে চলেছে দেব- শুভশ্রী জুটির বহু প্রতীক্ষিত ছবি ‘ধূমকেতু’। ধূমকেতুর বক্স অফিস সাফল্য বাংলা ছবির লক্ষ্মীলাভের ক্ষেত্রে বড় ফ্যাক্টর হতে পারে বলে মনে করছেন অনেকেই। কিন্তু, সমস্যা অন্যত্র। একই দিনে মুক্তি পাবে ‘ওয়ার ২’। অভিযোগ, বলিউড ছবিটির পরিবেশকরা নাকি রাজ্যের সিঙ্গল স্ক্রিনগুলির কাছে শর্ত রেখেছে, চারটি শো দিতে হবে হিন্দিকে। অন্য কোনও সিনেমার সঙ্গে শো টাইম ভাগ করা হবে না বলেও দাবি তাদের। এরপর বাংলা ছবির স্বার্থে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বারস্থ হয় টলিউড। মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লিখলেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, দেব, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, সৃজিত মুখোপাধ্যায়, নিসপাল সিং রানে, শ্রীকান্ত মোহতারা। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস গত সপ্তাহেই বৈঠক করেন সকলের সঙ্গে। সেই বৈঠকেই মন্ত্রী স্পষ্ট জানিয়ে দেন,বাংলায় গুরুত্ব পাবে বাংলা সিনেমা। অন্য ভাষার সিনেমাও চলবে, তবে তা বাংলা ছবিকে অবহেলা করে নয়। এরপরেই রাজ্য সরকার বাংলা সিনেমা প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করে এই বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে। ফেডারেশনের স্বভাপতি স্বরূপ বিশ্বাস রাজ্য সরকারকে ধন্যবাদ দিয়ে বলেন, এই সিদ্ধান্তে আস্তে একটু সময় লেগেছে ঠিকই। কিন্তু বুঝতে হবে এক ছাদের তলায় সকলকে আনা, সব পরিবেশক-প্রযোজক-পরিচালকদের সঙ্গে কথা বলে একমত হওয়া সহজ নয়। এটা কেন ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন তিনি। বলেন, বছরের প্রত্যেকদিন প্রতি হলে প্রাইম টাইমে বাংলা ছবি চালানোর কথা আগের সরকার ভাবেনি, এই সরকার করে দেখিয়েছে। এর ফলে বাংলা ছবি তৈরির সংখ্যা বাড়বে, আরও বেশি শিল্পী এই ইন্ডাস্ট্রিতে যুক্ত হবে।

এদিন অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত বলেন, এই সিদ্ধান্তে আমি খুশি। এটা মননশীল পরিচালক- প্রযোজকদের উৎসাহিত করবে। এদিন এসভিএফের তরফে বলা হয়, ভারতের বুকে এমন সিদ্ধান্ত কোনও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নিতে পারেননি। এটা বাংলা সিনেমাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে। সরকারি মহলের দাবি, এই পদক্ষেপে বাংলা ছবির বাজারে বড় রকম চাঙ্গাভাব আসবে। তবে মাল্টিপ্লেক্স মালিকদের একাংশের আশঙ্কা, নিয়মটি কার্যকর করতে গিয়ে কিছু সমস্যার মুখে পড়তে হতে পারে, বিশেষ করে ছোট শহরের ক্ষেত্রে যেখানে দর্শক টানার জন্য হিন্দি বা ইংরেজি ছবির উপর বেশি নির্ভর করা হয়।

–

–

–

–

–

–

–