কলকাতার রামমোহন সম্মিলনীর পুজোয় মায়ের সজ্জায় মেদিনীপুরের গয়না বড়ি

0
1

পুজো মানে উৎসব, পুজো মানে শিল্প, পুজো মানে অর্থনীতি। সেই সঙ্গে পুজো মানে যে কলকাতা ও গ্রাম বাংলার মেল বন্ধন ঘটানো – তা উত্তর কলকাতার রামমোহন সম্মিলনী ন’য়ের দশক থেকেই করে আসছে। এবারের পুজোয় তাঁদের বিশেষ উপস্থাপনা মাদুর্গার সাজ। সেই সাজেই তাঁরা গ্রাম বাংলাকে মিলিয়ে দিতে চলেছেন শহর কলকাতার পুজোর সঙ্গে। তাই এবার তাঁদের মাতৃপ্রতিমা সেজে উঠবে সাবেক মেদিনীপুরের ঐতিহ্যবাহী গয়না বড়ির অলঙ্কারে। রবিবার পশ্চিম মেদিনীপুরের রানিচক গ্রামে সেই অলঙ্কার হাতে নিয়েই হয়ে গেল রামমোহন সম্মিলনীর থিম উদ্বোধন। উপস্থিত ছিলেন রামমোহন সম্মিলনীর চেয়ারম্যান কুণাল ঘোষ-সহ অন্যান্য সদস্যরা। ছিলেন স্থানীয় বিধায়ক মমতা ভুঁইয়া।

কিন্তু কেন এই থিম নির্বাচন? সেই কাহিনী শোনাতে গিয়ে ইতিহাসের পাতা থেকে কুণাল ঘোষ বর্ণনা করেন, উত্তর কলকাতার রামমোহন সম্মিলনী একটি ক্লাব যার একটি ঐতিহ্য রয়েছে। রাজা রামমোহন রায়ের নামাঙ্কিত এই ক্লাব। ওই এলাকাতেই তিনি থাকতেন। রাজা রামমোহন রায় লাইব্রেরি ওখানে। লাইব্রেরির যে হলটি রয়েছে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল জয় করে ফেরার পরে, সেখানে তাঁকে প্রথম নাগরিক সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। আমাদের সৌভাগ্য আমরা সেই রাস্তাটিতে থাকি। আমাদের পূর্বপুরুষরা যে পুজো শুরু করে গিয়েছিলেন, এখন সেই পুজোটির ৮১ বছর বয়স। আমরা যেটা চেষ্টা করি, পুজো মানে মায়ের আরাধনা, তার পাশাপাশি উৎসব, শিল্প,তার পাশাপাশি অর্থনীতিকে তুলে ধরতে। আমরা চেষ্টা করি গ্রাম বাংলার সঙ্গে পুজোর সূত্রে একটি সেতু বন্ধন করতে। আমাদের কখনও পুজোর থিম হয় ঝাড়গ্রাম। কখনও থিম হয় সুদূর সমুদ্রের পাড়ে থাকা পরিবারের যে মা-বোনেরা রোজ উদ্বিগ্ন থাকেন, যাঁদের ঘরের লোক সমুদ্রে পাড়ি দেন। সেই মা-বোনেদের নিয়ে আমরা পুজোর থিম সাজাই। এর আগে আপনারা দেখেছিলেন একজন মহিলা শিল্পী, তিনি বিশেষভাবে সক্ষম। কী অপূর্ব তাঁর প্রতিভা। ঝিনুক দিয়ে ঠাকুর তৈরি করেন। তাঁকে অনুরোধ করেছিলাম আমাদের পাড়ার মা দুর্গার গয়না দিদিভাই আপনি ঝিনুক দিয়ে তৈরি করে দিতে পারবেন। তিনি আমাদের গর্বিত করেছিলেন, মা দুর্গা থেকে প্রতিমার যেখানে যা গয়না ছিল তা ঝিনুক দিয়ে তৈরি করে। আমরা চেষ্টা করি যাঁরা হাতের কাজ করছেন, গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী শিল্পকে একটু প্রচারের আলোয় একটু বেশি করে আনতে। আমরা কৃতজ্ঞ, যখন বিভিন্ন যোগসূত্রে বিভিন্ন গ্রামের সঙ্গে যোগসূত্র হয়, সেখানকার শিল্পীরা দারুনভাবে সহযোগিতা করেন।

দুর্গাপুজো যে শুধুই আনন্দ উৎসব নয়, তার হাত ধরে বাংলার অর্থনীতি যেভাবে স্বনির্ভর হয় তা অনুধাবন করেছিলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর চিন্তাধারা তুলে ধরে কুণাল বলেন, পুজোয় মা দুর্গা ছেলেমেয়েদের নিয়ে আসবেন। সঙ্গে শিবঠাকুর থাকবেন চালচিত্রে। এই পুজোটা শুধু পুজো নয়। পুজো আজকালকার দিনে বিরাট অর্থনীতি। যিনি ঠাকুর গড়ছেন তিনি সারাবছর অপেক্ষা করছেন কবে পুজো আসবে। যিনি ডেকরেটারের ব্যবসা করেন, যাঁরা আলোর কাজ করেন, এমনকি অনেক দূরে যে চাষী ভাই ফুল চাষ করছে, তিনিও অপেক্ষা করে থাকেন কখন দুর্গাপুজো আসবে। বিপুল পরিমাণে কাজ তাঁরা পাবেন। সেই কারণেই মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায় পুজো কমিটিগুলিকে সাহায্য দেন। আমরা তাঁকে ধন্যবাদ জানাই। কারণ পুজোটা চিরকাল ছিল। কিন্তু আজকের সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে দিতে পুজো একটা অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। অনেক মানুষের কর্মসংস্থান। অনেক শিল্প।

রামমোহন সম্মিলনী যে দীর্ঘদিন ধরেই সেই শিল্পের প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে সেই ইতিহাস তুলে ধরেন সংস্থার চেয়ারম্যান জানান, আমরা কলকাতার প্রথম দুটো পুজো – রামমোহন সম্মিলনী ও কাশিবোস লেন, ন’য়ের দশকে কলকাতার ডেকরেটরের বাইরে গিয়ে মেদিনীপুরের গ্রামে এসেছিলাম। এবং সেখানকার মণ্ডপ শিল্পীরা আমাদের মণ্ডপ করে এসেছিলেন। এখন সেটা অনেকেই করছেন। যখন ফসলের মরশুম চলে যায়, অনেকে সপরিবারে চলে যাচ্ছেন। আমরা তাঁদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করি। সেই সময়টা ওনারা আমাদের মণ্ডপ সাজিয়ে দেন। তারপর ঠাকুর দেখে আবার তাঁরা তাঁদের গ্রামের বাড়িতে ফেরেন।

আর এবারে রামমোহন সম্মিলনী তুলে ধরছে বাংলার শিল্প – গয়না বড়িকে। সেই প্রসঙ্গে কুণাল বলেন, এইবার ২০২৫ সালে সাবেক মেদিনীপুরের একটা শিল্প – গয়না বড়ি। এবার আমরা ঠিক করেছি মেদিনীপুরের মা-বোনেরা যে অপূর্ব বড়ি শিল্পকে অলঙ্কার করে তুলছেন। উত্তর কলকাতার রামমোহন সম্মিলনীর সিদ্ধান্ত এই রানিচক গ্রামের মা-বোনেদের হাতে তৈরি গয়না বড়ি দিয়েই মায়ের গয়না হবে। আমরা সেই গয়না এখানে দেখতে এসেছি। এবং সেই সঙ্গে আমাদের থিমের উদ্বোধন বিধায়ক মমতা ভুঁইয়া, আমরা সবাই মিলে করলাম। এখানে মা-বোনেরা বড়ি বানাচ্ছেন। আমরা ঠিক করেছিলাম কলকাতায় বসে, হল ভাড়া করে থিম উদ্বোধন হবে না। যেখান থেকে গয়না বড়ি আসছে তাঁদের উঠোনে দাঁড়িয়ে থিম উদ্বোধন হবে। সেটাই থিম উদ্বোধনের সার্থকতা। রামমোহন সম্মিলনীর কিছু সদস্য সদস্যা এসেছি। আমাদের থিমের স্লোগান – দুর্গা মায়ের অহঙ্কার, গয়না বড়ির অলঙ্কার।

তিনি আরও যোগ করেন, কলকাতায় বা বাংলার অন্য জায়গায় দেখলে মানুষ অবাক হবে। আমরা চাই বিশ্বের দরবারে এই সংস্কৃতিটা উঠে আসুক। এই শিল্প উঠে আসুক। চাঁদমালা থেকে মুকুট, অন্যান্য অলঙ্কার সব হবে গয়না বড়ি দিয়ে। আমরা চাইছি পুজোকে কেন্দ্র করে গ্রাম ও কলকাতার মেলবন্ধন। আমাদের যে ঐতিহ্য়বাহী শিল্প উৎসবের আলোয় আরও বেশি করে সামনে আসুক। এবং বাংলার মা-বোনেরা কত কী পারেন তা আরও বেশি করে সামনে আসুক। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুপ্রেরণার হাতের কাজ, ক্ষুদ্র-কুটির শিল্প, স্বনির্ভর গোষ্ঠী যেভাবে বিশ্ববাংলার মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে, নিশ্চয়ই তার মধ্যে গয়না বড়ি ছিল আছে, থাকবে। এবারের রামমোহন সম্মিলনীর দুর্গাপুজোয় মা দুর্গা গয়না বড়িতে সেজে ওঠার পরে আরও বেশি মানুষের কাছে এই গয়না বড়ি গিয়ে পৌঁছাবে।

আরও পড়ুন – অসমে ডিটেনশন, ওড়িশায় মারধর! দুই বিজেপি রাজ্যে বাঙালি শ্রমিক নিগ্রহ 

_

 

_

 

_