১ লক্ষে ১০ গ্রাম: সোনার ঝলকে বিভ্রান্তি নাকি সুযোগ?

Date:

Share post:

ডঃ দীপ্র ভট্টাচার্য
সোনায় (Gold) বিনিয়োগ বহু বছর ধরেই সাধারণ মানুষের কাছে এক নিরাপদ ও আস্থাজনক মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত। বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশে সোনার প্রতি একধরনের সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক আকর্ষণ রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে যেভাবে সোনার দাম ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে – ১০ গ্রাম সোনার দাম এক লক্ষ টাকা ছাড়িয়ে যাওয়া তারই প্রমাণ – তাতে অনেকেই ভাবছেন, এখন সোনা (Gold) কেনা বা তাতে বিনিয়োগ করা উচিত কি না।

সোনায় বিনিয়োগের ধরন-
১. ফিজিকাল সোনা (বার, কয়েন, গয়না)
ফিজিকাল সোনা হলো সোনা হাতে রাখা – যেমন সোনার বার, কয়েন বা গয়না। এটি সবচেয়ে প্রচলিত এবং ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতি।
সুবিধা:
– সহজলভ্য এবং কেনাবেচার প্রক্রিয়া সরল
– যে কোনও সময় নগদীকরণ সম্ভব
– সাংস্কৃতিক ও সামাজিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষত গয়নার ক্ষেত্রে
অসুবিধা:
– নিরাপত্তার ঝুঁকি (চুরি, হারিয়ে যাওয়া)
– সংরক্ষণের খরচ (লকার চার্জ ইত্যাদি)
– গয়নার ক্ষেত্রে মেকিং চার্জ এবং ব্যবহারজনিত ক্ষতি হয়
– ফেরত বিক্রির সময় পূর্ণ মূল্য পাওয়া যায় না

২. সোনা ETF (Exchange Traded Fund)
সোনা ETF হলো এক ধরনের মিউচুয়াল ফান্ড যা স্টক এক্সচেঞ্জে ট্রেড হয় এবং যার মূল্য সোনার বাজারদরের উপর নির্ভর করে।
সুবিধা:
– ফিজিকাল সোনার মত ঝামেলা নেই
– লিকুইড – শেয়ার মার্কেটের মাধ্যমে সহজেই কেনাবেচা করা যায়
– স্টোরেজ খরচ নেই
– ট্র্যাকিং ও অ্যাক্সেস সহজ (মোবাইল অ্যাপে দেখা যায়)
– মেকিং চার্জ নেই
অসুবিধা:
– ডিম্যাট অ্যাকাউন্ট থাকা প্রয়োজন
– সামান্য ব্যবস্থাপনা খরচ
– মার্কেট ঘনিষ্ঠ জ্ঞান দরকার হতে পারে

৩. সোনার বন্ড (Sovereign Gold Bond – SGB)
ভারত সরকার প্রতি বছর কয়েকবার SGB ইস্যু করে। এগুলোতে নির্দিষ্ট সময়ে সুদও পাওয়া যায়।
সুবিধা:
– ৮ বছরে মূল অর্থ ফেরত এবং সুদের সুবিধা (বর্তমানে ২.৫% বার্ষিক)
– ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্সে ছাড়
– ফিজিকাল সোনার ঝামেলা নেই
– সরকার সমর্থিত
অসুবিধা:
– নির্দিষ্ট মেয়াদ (৫ থেকে ৮ বছর), তার আগে বিক্রি করতে চাইলে মার্কেটের উপর নির্ভর করে
– ইস্যু পিরিয়ডের বাইরের সময় কিনতে হলে সেকেন্ডারি মার্কেটে যেতে হয়, যেখানে প্রিমিয়াম/ডিসকাউন্ট হতে পারে

৪. ডিজিটাল সোনা (Gold Saving Apps, Wallets)
কিছু ফিনটেক কোম্পানি যেমন Paytm, PhonePe, Groww ইত্যাদি ডিজিটাল সোনায় বিনিয়োগের সুযোগ দেয়। এখানে আপনি নির্দিষ্ট টাকার বা গ্রামের হিসাবে সোনা কিনতে পারেন।
সুবিধা:
– ছোট অঙ্কে বিনিয়োগের সুযোগ
– ২৪ ঘণ্টা ট্রেডিং সুবিধা
– খুব সহজ ইন্টারফেস
অসুবিধা:
– সংরক্ষণের নিরাপত্তা ও বিশ্বস্ততা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে
– সেবা প্রদানকারী কোম্পানির উপর নির্ভরশীলতা বেশি
– নিয়ন্ত্রণকারী কাঠামো SGB বা ETF এর মতো শক্ত নয়

সোনায় বিনিয়োগের ভালো দিক-
– মুদ্রাস্ফীতি (inflation) থেকে সুরক্ষা: সোনার দাম সাধারণত মুদ্রাস্ফীতির সাথে বাড়ে, ফলে এটি রিয়েল ভ্যালু সংরক্ষণে সহায়ক।
– বিশ্বজুড়ে অনিশ্চয়তায় নিরাপদ আশ্রয়: যুদ্ধ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, মার্কেট ক্র্যাশ – এসব সময়ে সোনার চাহিদা বাড়ে।
– সম্পদ বৈচিত্র্য: পোর্টফোলিওতে সোনা রাখলে রিস্ক কমে, কারণ সোনার দাম সাধারণত স্টক মার্কেটের বিপরীত দিকে চলে।

সোনায় বিনিয়োগের ঝুঁকি-
– আয় (income) তৈরি করে না, শুধুমাত্র মূলধন বৃদ্ধি হয় (ETF বা ডিজিটাল সোনায়) বা সুদ (SGB তে)
– দাম ওঠানামা করে; গতানুগতিক ধারণা থাকলেও স্বল্প-মেয়াদে ক্ষতি হতে পারে
– লিকুইডিটি কিছু ক্ষেত্রে সমস্যা হতে পারে (SGB ইত্যাদি)

সাধারণ মানুষের জন্য গাইডলাইন-
১. যদি সোনা শুধু গয়না হিসেবে চান, তবে সেটা “ইনভেস্টমেন্ট” নয়। এটি ব্যবহার্য সম্পদ। বেশি মেকিং চার্জ ও অবচয় থাকে।
২. সোনাকে সম্পূর্ণ বিনিয়োগ মাধ্যম হিসেবে দেখলে – ফিজিকাল সোনা না রেখে ETF বা SGB বিবেচনায় নেওয়া ভালো। এর মাধ্যমে নিরাপত্তা ও লাভ দুইই বাড়ে।
৩. যদি মাসে মাসে অল্প অল্প করে বিনিয়োগ করতে চান, তাহলে ডিজিটাল সোনা বা গোল্ড ETF ভালো পছন্দ হতে পারে।
৪. যারা দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ করতে চান এবং নিয়মিত সুদ পেতে চান, তারা SGB নির্বাচন করতে পারেন।
৫. মোট বিনিয়োগের ৫-১০% এর বেশি সোনায় রাখা উচিত নয়। কারণ এটি উৎপাদনশীল সম্পদ নয় এবং শুধুমাত্র বাজারদরের উপর নির্ভরশীল।
৬. সময়ের সাথে সাথে মূল্যায়ন করা জরুরি – সোনার দাম অতীতে যেমন বাড়ছে, ভবিষ্যতেও তেমন হবে এমন গ্যারান্টি নেই। তবে রিস্ক কমাতে এটি এক শক্তিশালী মাধ্যম।

গয়না কি তবে ইনভেস্টমেন্ট নয়?
সোনার গয়না নারীদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিয়ের উপহার থেকে শুরু করে পারিবারিক উত্তরাধিকার পর্যন্ত, গয়না অনেক সময় শুধু অলংকার নয়, আবেগ আর  ঐতিহ্যেরও বহিঃপ্রকাশ। তবে গয়না কেনাকে যদি বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তখন কিছু বাস্তব দিক বিবেচনায় রাখা জরুরি। গয়নায় সাধারণত ২০-৩০ শতাংশ পর্যন্ত মেকিং চার্জ থাকে, যা পুনরায় বিক্রির সময় ফেরত পাওয়া যায় না। উপরন্তু, ব্যবহারের ফলে গয়নার ক্ষয় বা নকশার পুরনো হয়ে যাওয়ার মতো বিষয়ও থাকে, যা রিসেল ভ্যালু কমায়। তাই সোনার গয়না অবশ্যই রাখা যেতে পারে সামাজিক ও পারিবারিক প্রয়োজনের জন্য, কিন্তু শুধুমাত্র বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে হলে গয়নার পরিবর্তে বার, কয়েন বা ডিজিটাল বিকল্পগুলি বেশি কার্যকর হতে পারে।

শেষ কথা
সোনা একটি ঐতিহ্যবাহী, স্থিতিশীল এবং ঝুঁকিমুক্ত বিনিয়োগ মাধ্যম হিসেবে পরিচিত হলেও, বিনিয়োগের পদ্ধতি এবং উদ্দেশ্য বুঝে নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। শুধু দাম বাড়ছে দেখে বিনিয়োগ করলে লাভের বদলে লোকসানও হতে পারে। তাই নিজের আর্থিক লক্ষ্য, সময়কাল ও ঝুঁকির সহনশীলতা বিবেচনা করে সঠিক মাধ্যম বেছে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। গয়না নয়, বিনিয়োগের জন্য ETF বা SGB-র দিকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

spot_img

Related articles

বিদ্যাসাগরের মূর্তির কাছে ক্ষমা চান শাহ: গর্জে উঠলেন অভিষেক

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ২০৫তম জন্মদিনে কলকাতায় এসেও তাঁর মূর্তিতে শ্রদ্ধা জানানোর সৌজন্য দেখালেন না কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। আর...

আগে সোনার উত্তরপ্রদেশ-বিহার-অসম গড়ে দেখান: শাহকে চ্যালেঞ্জ অভিষেকের

ফের একবার রাজ্যে এসে  'সোনার বাংলা' গড়ার ফাঁকা আওয়াজ দিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। আর তার কিছুক্ষণের মধ্যেই...

পরিযায়ী মামলায় হাইকোর্টে জোর ধাক্কা কেন্দ্রের

'পরিযায়ী' তকমা দিয়ে বাংলার পরিবারকে বাংলাদেশে পাঠানোর সিদ্ধান্ত খারিজ করল কলকাতা হাই কোর্ট (Calcutta High Court)। বাংলাদেশি বলে...

নিয়োগ সংক্রান্ত সব মামলায় শর্তসাপেক্ষে জামিন পার্থর, জেলমুক্তি কবে জানালেন আইনজীবীরা

প্রাথমিক নিয়োগ মামলায় (Primary Teachers Recruitment Case) অবশেষে শর্তসাপেক্ষে জামিন পেলেন পার্থ চট্টোপাধ্যায় (Partha Chatterjee)। এই সংক্রান্ত অন্য...