‘ডিকি অনন্য বার্ড’, উৎপল সিনহার কলম 

Date:

Share post:

বোল্ড আউট হয়েও মাঠ ছাড়তে রাজি হন নি ডব্লিউ জি গ্রেস । আম্পায়ার কারণ জানতে চাইলে বলেছিলেন , ‘ ওহে আম্পায়ার , লোকে টিকিট কেটে তোমার আম্পায়ারিং দেখতে আসে নি , আমার ব্যাটিং দেখতে এসেছে ‘ ।

একথা শুনে আম্পায়ার নিরুত্তর ছিলেন । কিন্তু সেই খেলায় আম্পায়ার হিসেবে যদি মহামান্য ডিকি বার্ড থাকতেন তাহলেও কি আউট হয়ে আবার ব্যাট করার সুযোগ পেতেন গ্রেট গ্রেস ? সম্ভবত না । কারণ মৃদু হেসে স্বভাবসুলভ রসিকতা বজায় রেখে অসামান্য ডিকি বার্ড অবশ্যই বলতেন, ‘ হ্যাঁ , মিস্টার গ্রেস , আপনার কথা একশো শতাংশ সত্য , কিন্তু মাঠে আম্পায়ার না থাকলে খেলাটাই ভেস্তে যায় , এটা কি আপনি ভুলে গেছেন ‘ ?

বড়ো ফুটবল ম্যাচে পিয়ের লুইগি কলিনা রেফারিং করলে যেমন দর্শকদের উত্তেজনা দ্বিগুণ বেড়ে যেতো , ঠিক তেমনি ক্রিকেটের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে ডিকি বার্ড থাকলে খেলায় একটা আলাদা মাত্রা যোগ হতো । এঁদের ব্যক্তিত্বের এমনই মহিমা ।

কিংবদন্তি ডিকি বার্ডের বয়স এখন ৯২ , এখনও একই রকম প্রাণবন্ত । আম্পায়ারিংয়ের জীবন্ত ইতিহাস । একটা গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে ব্যাটিং করছিলেন সুনীল গাভাস্কার । সেদিন বল দেখতে তাঁর কিছু সমস্যা হচ্ছিল , কারণ তাঁর মাথার সামনের বড়ো চুলগুলো শরীরের ঝাঁকুনিতে একেবারে চোখের ওপর চলে আসছিলো । বাধ্য হয়ে গাভাস্কার কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে ডিকি বার্ডের শরণাপন্ন হলেন । সঙ্গে সঙ্গে ডিকি প্রসন্ন হেসে নিজের আম্পায়ারিং জোব্বার

( সাদা আলখাল্লা , তৎকালীন আম্পায়ারেরা পরতেন ) পকেট হাতড়ে বের করলেন ছোট্ট এক কাঁচি । কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই গাভাস্কারের কপালে নেমে আসা কয়েক গোছা চুল ঢুকে পড়লো আম্পায়ারের পকেটে। খেলা আবার শুরু হলো । ডিকি বার্ডের জাদু পকেটে একটা গোটা সংসার লুকিয়ে থাকতো । আলপিন টু এলিফ্যান্ট !

ম্যাচ চলাকালীন সময় পেলেই ক্রিকেটারদের সঙ্গে রঙ্গরসিকতায় মেতে উঠতেন ডিকি । এই সাহস ক’জন আম্পায়ারের থাকে ? ম্যাচ চলাকালীন ক্রিকেটারদের কাঁধে হাত রাখতেন বিরল প্রজাতির এই আম্পায়ার ।

আপাদমস্তক সৎ , প্রত্যয়ী , ন্যায়পরায়ণ , সংবেদনশীল । এমন মানুষ খেলা পরিচালনা করলে বিচারের বাণী কখনও নীরবে নিভৃতে কাঁদে না ।  বিশ্ব ক্রিকেটের সর্বকালের অন্যতম সেরা আম্পায়ার ডিকি বার্ড দেশকাল নির্বিশেষে সকলের শ্রদ্ধেয় ।১৯৭৩ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত সময়কালে তিনি ৬৬ টি টেস্ট এবং ৬৯ টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ পরিচালনা করেন , যার মধ্যে রয়েছে ৩ টি বিশ্বকাপের ফাইনাল ।

তাঁর চোখে ক্রিকেট ছিল একটা শিল্প । আর আম্পায়ারিং ছিল সেই শিল্পকে সঠিক পথে পরিচালিত করার দায়িত্ব ।

ক্রিকেটই ছিল তাঁর জীবন । এখনও , এই ৯২ বছর বয়সেও ম্যাচ চলাকালীন কোনো ক্রিকেট মাঠে তিনি প্রবেশ করলে গোটা স্টেডিয়াম উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে সম্মান জানায় । মুগ্ধতা আর নস্টালজিয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন প্রবীণ দর্শকেরা । অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন নবীন দর্শক । এই সেই বিখ্যাত ডিকি বার্ড , যাঁর এক ইশারায় বদলে যেতো ম্যাচের রং !

তাঁর জন্ম ইয়র্কশায়ারে । শৈশবে স্বপ্ন দেখতেন বড়ো ক্রিকেটার হওয়ার । প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটও খেলেছেন । কিন্তু ক্রমাগত চোট-আঘাত তাঁর সেই স্বপ্ন ভেঙে দেয় । তবে ক্রিকেট তাঁকে ছাড়ে নি।

নিজেকে গড়েছেন আম্পায়ার হিসেবে । নিখুঁত সিদ্ধান্তে ক্রিকেটকে তুলে নিয়ে গেলেন এক অবিশ্বাস্য উচ্চতায় । তিনিই সেই বিরলের মধ্যে বিরলতম আম্পায়ার , যাঁকে নিয়ে গান লিখতেন , পোস্টার বানাতেন ক্রিকেটপ্রেমীরা । তাঁর আত্মজীবনী ‘ Dickie Bird , My Autobiography ‘ প্রকাশের পরপরই বৃটেনে বেস্ট সেলার হয় । কেবল নিয়মরক্ষা নয় , ক্রিকেটের ঐতিহ্য , পরম্পরা ও আভিজাত্য রক্ষা করতেন এই বিশ্ববরেণ্য আম্পায়ার ।

মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এবং মানবিক অনুভব তাঁকে আম্পায়ার হিসেবে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে । তিনি এখনও ভালোবাসেন ক্রিকেট । তাঁকেও মনে রেখেছে ক্রিকেট। এভাবেই বেঁচে থাকুন ক্রিকেটের শাশ্বত স্মারক শ্রদ্ধেয় ডিকি বার্ড ।

আরও পড়ুন – মালদহে দেব-ঝড়, ‘রঘু ডাকাত’ প্রমোশনে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস জেলা জুড়ে

spot_img

Related articles

Sunday Feature: ভূতের বিয়ে! প্রথা আছে এদেশে, বিদেশেও

বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, "পয়সা থাকলে ভূতের বাপের শ্রাদ্ধ হয়!" কথাটা তির্যকভাবে বলা ঠিকই কিন্তু আত্মাদের নিয়ে বিভিন্ন...

অনির্বাণকে যাঁরা হিংসে করছেন, তাঁদের মাথায় পড়ুক বাজ!!!!

অভিজিৎ ঘোষ অভিনেতা অনির্বাণ ভট্টাচার্য (Anirban Bhattacharya) গান গেয়েছেন। এবং সে নিয়ে নানা মুনির নানা কথা। আগেও মাঝে মধ্যে...

টাইম ম্যাগাজিনের প্রভাবশালীদের তালিকায় ভারতীয় অধ্যাপক, মিতেশ খাপরাকে চেনেন?

টাইম ম্যাগাজিনের (TIME Magazine) বিচারে ২০২৫ সালে বিশ্বের সেরা ১০০ জন প্রভাবশালী এআই ব্যক্তিত্বের তালিকায় স্থান করে নিলেন...

এই যে এই রুদ্র, ভাই তোমাকে বলছি

অভিজিৎ ঘোষ এই যে এই রুদ্র (Rudranil Ghosh), তোমাকে বলছি ভাই। তুমি কি সনাতন ধর্মের ঠিকাদার না চৌকিদার না...