শ্রীমানী বাড়ির প্রতি কোণায় পুরনো কলকাতার ছোঁয়া, দুর্গাপুজোয় আজও অটুট সাবেকি রীতি

Date:

Share post:

উত্তর কলকাতার সুকিয়া স্ট্রিট ও আপার সার্কুলার রোড অর্থাৎ মহেন্দ্র শ্রীমানী স্ট্রিট এবং ও আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রোডসহ রাজা রামমোহন রায় রোডের সংযোগস্থলের উত্তর-পশ্চিম কোণে মহেন্দ্রনাথ শ্রীমানীর (Mahendranath Srimani) বাড়ি। এককালে এই অঞ্চলের সফল ধনী ব্যবসায়ী ছিলেন তিনি। তাঁর নামেই ১৯৪৬ সালে তাঁর বাড়ির সামনের রাস্তার নাম মহেন্দ্র শ্রীমানী স্ট্রিট (Mahendra Srimani Street) করা হয়। মহানগরীর ইতিহাস ঘাঁটতে গেলে উঠে আসবে এই বাড়ির দুর্গাপুজোর কথা, যার অনেকটাই এ প্রজন্মের কাছে সম্পূর্ণ অজানা।

 

শ্রীমানী বাড়ির সর্বত্র পুরনো কলকাতার গন্ধ স্পষ্ট। এই পরিবার এখানে আসার আগে শ্রীমানী বাজারের উল্টোদিকে সিমলা স্ট্রিট ও বারাণসী ঘোষ স্ট্রিট অর্থাৎ ডাঃ নারায়ণ রায় সরণি ও তারক প্রামাণিক রোডের সংযোগস্থলের উত্তর-পূর্ব দিকে বসবাস করতেন। পরাধীন ভারতবর্ষে এ বাড়ির নির্মাণ। কলকাতার বুকে ১৯১১তে এই আর্ট ডেকো বাড়ি তৈরি হয়, যেখানে সদর দরজার সামনে দক্ষিণমুখী ঠাকুর দালান আর তিন পাশে বারান্দাসহ ঘর আপনাকে ঊনবিংশ শতকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে অনায়াসে।

মহেন্দ্র শ্রীমানীর তিন ছেলে- শ্যামদুলাল, নন্দদুলাল ও গোবিন্দদুলাল। গোবিন্দদুলালের ছেলে সুজয়নারায়ণ, উদয়নারায়ণ ও সঞ্জয়নারায়ণ শ্রীমানী সপরিবারে এই ১৭নং বাড়িটিতে থেকে যান। শ্যামদুলালের ছেলে অজয়নারায়ণ শ্রীমানী সপরিবারে ১৫ নম্বর বাড়িতে এবং নন্দদুলালের ছেলে বিজয়নারায়ণ ১৫/১ নম্বর বাড়িতে চলে আসেন। আজ ১৭ নম্বর বাড়িটিতে উদয়নারায়ণের পুত্র প্রমাঙ্কুর শ্রীমানী থাকেন। প্রাচীন এই বাড়ির দুর্গাপুজোর ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায় ১৮৯৮ সালে বারাণসী ঘোষ ষ্ট্রীট অর্থাৎ তারক প্রামাণিক রোডের বাড়িতে পুজো আরম্ভ হয়। পরে ১৯১১ সালে এই বাড়িটি নির্মাণ হলে, এখানে স্থানান্তরিত হয়। সেই থেকে আজ পর্যন্ত এখানেই সাবেকি রীতি মেনে পুজো হচ্ছে।

রথের দিন হয় কাঠামো পুজো, প্রতিমা করা হয় বাড়ির ঠাকুরদালানে। শাস্ত্র মেনে মহালয়াতে চক্ষুদানের পর প্রতিপদের দিন থেকে চলে চণ্ডীপাঠ। ষষ্ঠীতে আবাহন, সপ্তমীতে নবপত্রিকা স্নান, অষ্টমীতে কুমারী পুজো হয়ে আসছে একেবারে শুরুর দিনের মতোই। আট বছরের কম বয়সী ব্রাহ্মণ কন্যারাই কুমারী হতে পারেন এখানে। সন্ধিপুজোয় চল্লিশ কেজি চালের নৈবেদ্য অর্পণ করা হয়। যা পরবর্তীতে অন্নদান রূপে চলে যায় রামকৃষ্ণ মিশন অথবা যোগোদ্যানে। একসময় সন্ধিপুজো সূচনা ও সমাপ্তি লগ্নে বন্দুক দাগা হতো। এখন অবশ্য তা হয় না। দশমীতে দর্পণ বিসর্জনের পর আলপনা শোভিত উঠোনে প্রতিমাকে এনে তলে সিঁদুর খেলা। শোনা যায় আগে মায়ের বিদায় বেলায় নীলকন্ঠ পাখি ওড়ানোর রীতি ছিল। এই পুজোর উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো চক্ষুদান থেকে প্রতিমা কেউ তাতে স্পর্শ করতে পারেনা। পুজোর কদিন হোমকুন্ডের আগুন যাতে না নেভে সেদিকে খেয়াল রাখা হয়। শ্রীমানী পরিবারের গৃহদেবতা শ্রীশ্রী রাধানাথ জিউ, তাই দুর্গাপুজো হয় বৈষ্ণব মতে। পশু বলিদানের প্রথা নেই। দেবীকে ১২-১৩ রকমের ফল অর্পণ করা হয়। বেলুড় মঠের রীতি অনুসারে এখানেও বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা মেনে পুজো হয়। দুর্গাপুজো ছাড়াও লক্ষ্মীপুজো, কালীপুজো, কার্তিক পুজো এবং অন্নপূর্ণা পুজোও হয়।

এই শ্রীমানী পরিবার পুরনো কলকাতার বনেদি ও ধনী পরিবার। এঁনাদেরই বারাণসী ঘোষ ষ্ট্রীট ও কর্নওয়ালিস ষ্ট্রীট অর্থাৎ তারক প্রামাণিক রোড ও বিধান সরণির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে ২০৬ নং কর্নওয়ালিস ষ্ট্রীট অর্থাৎ বিধান সরণিতে অবস্থিত শ্রীমানী বাজার। বলাইবাহুল্য মহেন্দ্রনাথ শ্রীমানীর নামেই এই বাজার। পুরনো কলকাতার ইতিহাসের অনেক অজানা অংশের মতো এই বাড়িও অধিকাংশের অপরিচিত। অথচ সেই উনিশ শতক থেকে উত্তর কলকাতার বাড়ির পুজোগুলোর মধ্যে অন্যতম শ্রীমানী বাড়ির দেবী আরাধনা।

spot_img

Related articles

হেপাটাইটিসের বিরুদ্ধে যৌথ লড়াই: বহরমপুরে পৌরসভা‑যশোদা হাসপাতালের বিশেষ জনসচেতনতা কর্মসূচি

বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস উপলক্ষে ভাইরাল হেপাটাইটিস সম্পর্কে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে বহরমপুর পৌরসভা ও হায়দরাবাদের যশোদা হাসপাতালের (সোমাজিগুড়া) যৌথ...

জাতীয় পতাকা দিবস উদযাপন শ্যাম সুন্দর কোং জুয়েলার্সের 

১৯৪৭ সালে ২২ জুলাই ভারতীয় তেরঙ্গাকে দেশের জাতীয় পতাকা হিসেবে গ্রহণ করার স্মৃতি হিসেবে এই দিনটি 'জাতীয় পতাকা...

অ্যাক্রোপলিস মলে দিনভর টেবিল টেনিস প্রতিযোগিতা, ক্রীড়াপ্রেমীদের উচ্ছ্বাসে সাড়া

শহরের অন্যতম জনপ্রিয় শপিং ও বিনোদন গন্তব্য অ্যাক্রোপলিস মল আজ এক দিনব্যাপী টেবিল টেনিস প্রতিযোগিতার আয়োজন করল। ফরাসি...

দুর্গোৎসবের শুরু: খুঁটি পুজো হয়ে গেল নিউটাউন সর্বজনীন দুর্গোৎসব সমিতির, এবারের থিম কী?

কলকাতার বুকে এক নতুন পুজো বলা চলে নিউটাউন সর্বজনীনকে। মাত্র ৩ বছরের মধ্যেই কলকাতা তথা গোটা রাজ্যে সাড়া...