অংশুমান চক্রবর্তী

বিশিষ্ট সমাজসেবী ও শিল্পপতি মোস্তাক হোসেন। মহৎপ্রাণ এক মানুষ। উদার হাতে ব্যক্তিগত তহবিল থেকে অর্থ দিয়ে আধুনিক শিক্ষার প্রসারে মানবতার দূত হিসেবে এগিয়ে এসেছেন। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় তাঁর আর্থিক সহযোগিতায় গড়ে উঠেছে বহু মিশন স্কুল। তাঁর কৃতিত্ব ও পৃষ্ঠপোষকতার কারণে বাঙালি অনগ্রসর সমাজের অনেকেই অন্ধকার থেকে আলোর পথে পা রাখতে পেরেছে। তাঁর সহযোগিতায় জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সব শ্রেণীর মানুষ প্রতিনিয়ত উপকৃত হচ্ছেন। বলা যায়, পশ্চিমবঙ্গের অনগ্রসর শ্রেণীর মানুষের মধ্যে আধুনিক শিক্ষা বিস্তারে বসন্ত এনে দিয়েছেন এই দানবীর মানুষটি। তাঁকে নিয়ে ফারুক আহমেদের সম্পাদনায় উদার আকাশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে একটি ঐতিহাসিক গ্রন্থ ‘মোস্তাক হোসেন: জীবন ও ঐতিহ্য’। ৭২০ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থে কলম ধরেছেন ১১৭ জন লেখক।

ভূমিকায় পবিত্র সরকার লিখেছেন, “আমার পৃথিবী উদ্যোগী ও শিল্পপতিদের পৃথিবী থেকে বেশ কিছুটা দূরে অবস্থিত। কিন্তু তিনি যে আধুনিক পশ্চিমবাংলার একজন প্রধান উদ্যোগপতি, সে কথা নানা সূত্র থেকে জানি। শুধু সফল শিল্পপতি নন, তার বাইরেও আরও অনেক কিছু, কিন্তু সেই প্রসঙ্গে পরে আসব।” তিনি আরও লিখেছেন, “তাঁর সাফল্য ও সমৃদ্ধিকে নিজের ব্যক্তিগত বা পারিবারিক সম্ভোগের সীমায় আবদ্ধ রাখেননি, তিনি তাকে সমগ্র মানবসমাজের উপকারের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। তাঁর নিজের সম্প্রদায়ের শিক্ষা বিস্তারের জন্য তিনি শুরুর দিকে আল-আমীন মিশন স্কুলগুলির পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন উদারভাবে, পরে তা সমস্ত বাঙালির জন্যই বিস্তারিত হয়েছে। নিজেদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত জিডি অ্যাকাডেমি ও জিডি স্টাডি সার্কেলগুলি সেই লক্ষ্য নিয়ে বিপুল উদ্যমে কাজ করে চলেছে। তাছাড়া সর্বজনীন চিকিৎসা সেবাতেও তাঁর যোগদান এক উৎসাহব্যঞ্জক ঘটনা এবং বাঙালির পক্ষে সুসংবাদ।”

সম্পাদকের কথায় ফারুক আহমেদ লিখেছেন, “অনুপ্রেরণা ও উদাহরণ হিসেবে আমাদের সামনে আছেন মোস্তাক হোসেন। আশা রাখি, আগামীতে সমাজ কল্যাণে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা নিশ্চয়ই এগিয়ে আসবেন। লোকহিতকর কাজে যুক্ত থাকা সব থেকে মহত্তর কাজ। মানুষের সেবায় বাচাই হোক আমাদের উদার জীবনের অন্বেষণ।”
সংকলনের শুরুতেই রয়েছে মোস্তাক হোসেনের লেখা ‘স্বপ্নপূরণে বদ্ধপরিকর হাসপাতালের জন্ম’। সূচনা হয়েছিল কীভাবে? তিনি লিখেছেন, “আমার মা দিলখোশ বিবি ছিলেন সহজ-সরল, ধর্মভীরু, গ্রামীণ মহিলা। দুঃস্থ পাড়া প্রতিবেশী আর আত্মীয়-স্বজনের বিস্তর খেয়াল রাখতেন, কারও অসুখের খবর পেলে নির্দ্বিধায় তাঁর পাশে দাঁড়াতেন। তিনি কঠিনতম ডায়াবেটিসের শিকার ছিলেন। আমৃত্যু তাঁকে এই সর্বনাশা রোগ অশেষ কষ্ট দিয়েছে। আমরা তাঁর চিকিৎসায় কোথাও কোনও ত্রুটিকে প্রশ্রয় দিয়নি। তবু রোগ সারেনি। বাঁচিয়ে রাখতে পারিনি।” তিনি আরও লিখেছেন, “মায়ের অসুখ আর মৃত্যুশোক আজও আমাদের তাড়া করে। এই ব্যক্তিগত বেদনা অতিক্রম করা কঠিন। এর কবল থেকে বেরিয়ে আসার রাস্তা খুঁজতে খুঁজতেই তাঁর স্মৃতিতে, তাঁর নামে হাসপাতাল গড়ার সংকল্প নিই, এই সংকল্পের বাস্তবতার নাম জিডি ডায়াবেটিস ইনস্টিটিউট অ্যান্ড স্পেশালিটি ক্লিনিক।” এইভাবেই পথচলা শুরু। লেখার ‘প্রতিজ্ঞা ও প্রতিশ্রুতি’ অংশে দৃঢ়তার সঙ্গে তিনি বলেছেন, “আমি ব্যক্তিগতভাবে স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি। স্বপ্নকে মাঝপথে ফেলে রেখে পালাতে শিখিনি। তার পূর্ণাঙ্গ চেহারা-গঠন আমাদের একান্ত লক্ষ্য।” সেই লক্ষ্য পূরণে তিনি যে সফল, সেকথা বলার অপেক্ষা রাখে না।

মোস্তাক হোসেনের লেখা ‘গুহার ভেতরে আলো’ বইটি পাঠকমহলে সমাদৃত। বইটি পড়ে সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী বলেছিলেন, “মোস্তাক হোসেনকে বলব, ইসলামকে সহজ ভাষায় সকলের মনে পৌঁছে দেওয়ার জন্য, তিনি আমাদের জন্যও আরও বই লিখুন।”

সংকলনে আছে কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি রচনা। তিনি লিখেছেন, “বাংলার ব্যবসায়ীদের মধ্যে অল্প বয়েসেই বিশেষ সাফল্য অর্জন করেছেন মোস্তাক হোসেন। এজন্য তাঁকে অবশ্যই খুব ব্যস্ত থাকতে হয়। তবু তিনি শিক্ষা বিস্তার এবং সমাজসেবার জন্য সময় ব্যয় করেন। হাওড়ার খলতপুরের আল-আমীন মিশন একটি সুখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, জনাব মোস্তাক হোসেন এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত।”

সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় সংকলন-গ্রন্থে লিখেছেন, “মোস্তাক হোসেনের জীবনমুখী কার্যকলাপের কথা জেনে মুগ্ধ ও বিস্মিত হয়েছি। তাঁর মতো মানুষ বিরল। এই যুগে এমন মানুষ কমই দেখা যায়। এমন জীবনদরদী ও মানবদরদী মানুষ এখন আমাদের খুব দরকার।”

সুসম্পাদিত এই গ্রন্থের লেখক তালিকায় কবি, সাহিত্যিকের পাশাপাশি আছেন অধ্যাপক, গবেষক, প্রকাশক, সম্পাদক, প্রাবন্ধিক প্রমুখ। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কবীর সুমন, তপন মিত্র, অশোক দাশগুপ্ত, মইনুল হাসান, আহমদ হাসান ইমরান, গোলাম রাশিদ, সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায়, খাজিম আহমেদ, জয়ন্ত ঘোষাল, সুমন ভট্টাচার্য, দেবাশিস পাঠক, জয়ন্ত সিংহ প্রমুখ। তাঁদের লেখায় ধরা পড়েছে মোস্তাক হোসেনের কর্মময় জীবন। তিনি এমন এক বর্ণময় ব্যক্তিত্ব, যিনি সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে জয়ী হয়েছেন। গড়ে তুলেছেন বিশাল ‘পতাকা’ সাম্রাজ্য। ব্যক্তিগত সাফল্যে তাঁর জীবন সীমায়িত হয়নি। সমাজসেবা এবং শিক্ষা প্রসারে নেতৃত্ব দিয়ে ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছেন কিংবদন্তি। তাঁকে জানার জন্য সংকলন-গ্রন্থটি সংগ্রহে রাখতে হবে। পড়তে হবে। আজ তিনি বহু মানুষের আদর্শ।

২০২৫ কলকাতা বইমেলায় প্রকাশিত অনবদ্য গ্রন্থটির প্রথম সংস্করণ দ্রুত ফুরিয়েছে। এপ্রিলে বেরিয়েছে দ্বিতীয় সংস্করণ। আশাকরি আরও কয়েকটি সংস্করণ প্রকাশিত হবে। এমন একটি প্রয়োজনীয় কাজ করার জন্য সম্পাদককে জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ। পরিচ্ছন্ন প্রচ্ছদ মৌসুমী বিশ্বাসের। দাম ৬৯৯ টাকা।

আরও পড়ুন- রবীন্দ্রনাথকে অসম্মান! সরব তৃণমূল, বিজেপিকে ধিক্কার কুণাল-সুদীপের
_
_
_