চাকুরিরতা পাত্রীর জন্য সম্বন্ধ আসে। কিন্তু যখনই জীবিকার কথা শোনে পাত্রপক্ষ-ভেঙে যায় বিয়ে। আজ যখন ভারতীয়দলের জার্সি গায়ে মাঠে নামবেন ১১ জন ক্রিকেটার তরুণী, তখনও ডোমের কাজ করেন বলে বিয়ে ভেঙে যায় দক্ষিণ ২৪ পরগনার বারুইপুরের (Baruipur) টুম্পা দাসের (Tumpa Das)। কিন্তু তাও নিজের দায়িত্ব ছাড়েননি তিনি। ১১ বছর ধরে বীরভূমের পুরন্দরপুর (Purandarpur Crematorium) শ্মশানে ডোমের কাজ করছেন টুম্পা। রাজ্যের ভাষায় ‘সৎকার কর্মী’। পরিবারের সদস্যদের মুখে তুলে দিচ্ছেন অন্ন। তাঁদের কাছে তিনিই অন্নপূর্ণা।

২০১৪ সালে হঠাৎ বাবা বাপি দাস মারা যান। পুরন্দরপুর শ্মশানে কাজ করতেন তিনি। সংসারের প্রধান রোজগেরে মানুষ চলে যাওয়ায় আতান্তরে পড়ে দাস পরিবার। মাধ্যমিক পাশ টুম্পা তখন স্থানীয় প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সামান্য নার্সের (Nurse) কাজ করতেন। সেই বেতনে পুরো পরিবারের ভরণপোষণ চালানো চালানো সম্ভব ছিল না। বাবার শূন্য পদে যোগ দিলেন টুম্পা, পা রাখলেন এক বেনজির জায়গায়।

পুরুষ আধিপত্যের ওই পেশায় টুম্পার (Tumpa Das) পা রাখা ছিল সবার কাছে একটা ঝাঁকুনি। অনেকেই নাক সিঁটকে ছিল। প্রশ্ন তুলেছিল, “মেয়েমানুষ এই কাজ করবে?” বাড়ির লোকরাও ভেবেছিলেন, বাড়ির মেয়ে ডোম হলে সমাজে এক ঘরে হতে হবে হয়তো! কিন্তু টুম্পার তখন নজর ছিল শুধুমাত্র সংসারের দায়িত্ব পালনে। বলেছিলেন, “বাবার জায়গায় কেউ না গেলে আমরা খেতে পাব না।” মন শক্ত করে এগিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।

কেমন ছিল প্রথমের দিনগুলি?
টুম্পা বলেন, “প্রথম দিকে কেমন একটা ভয় করত। সারাদিন একের পর এক বডি চুল্লিতে ঢোকানো। তারপর কাজ হয়ে গেলে অস্থি তুলে আনা। এই সব করতে শরীর যেন অবশ হয়ে যেত। কিন্তু এখন সব কেটে গিয়েছে।” এই পেশাটা যদিও টুম্পার কাছে নতুন নয়। এক অর্থে উত্তরাধিকারও। তার ঠাকুরদা, বাবা দুজনই এই শ্মশানে মৃতদেহ সৎকারের কাজ করতেন।

সকাল ৬টা থেকে রাত ৮টা অবধি একটানা কাজ। প্রথমে মৃতদেহের তথ্য নথিভুক্ত হয় রেজিস্টারে। “তারপর চুল্লি গরম করা, প্রক্রিয়া দেখা, পরিবারের হাতে অস্থি তুলে দেওয়া, সব কিছু নিজে দেখি”- জানালেন সৎকার কর্মী। এই কাজে মানসিক শক্তির সঙ্গে শারীরিক শক্তিরও দরকার। কাঠ তোলা, চুল্লি চালানো, ধোঁয়ার মধ্যে ঘুরে বেড়ানো- সবই করতে হয়।

আগে পুরন্দরপুর শ্মশানে কাঠে পোড়ানো হত। ফলে সময় লাগতো তিন ঘণ্টার বেশি। ২০১৯-এ বৈদ্যুতিক চুল্লি চালু হয়। এখন ঝামেলা কম। টুম্পার কথায় “আগে একটা দেহ পুড়তে তিন ঘণ্টা লেগে যেত, এখন ৪৫ মিনিটে হয়ে যায়”। তবে আত্মবিশ্বাসে ভরপুর টুম্পা জানান, “অনেকে ভাবে, মেয়েরা নরম মনের, এই কাজ পারে না। কিন্তু আমি দেখেছি পুরুষেরাও ভয় পায়”।

এই সাহসিকতার গল্পের আর একটা দিকও আছে। সেটা হল সমাজের একাংশের মানুষের মানসিক প্রতিবন্ধকতার। বিয়ের কথাবার্তা শুরু হলেও যেই পাত্রপক্ষ জানতে পারে টুম্পা ডোমের কাজ করে, সম্বন্ধে ভেঙে যায়। উদাস গলায় টুম্পা জানান, “ওরা বলল, এই কাজ করা মেয়েকে বিয়ে করবে না”। প্রথম প্রথম কষ্ট পেতেন এখন মানসিকভাবে অনেক শক্ত হয়ে গিয়েছেন তিনি। এ কাজ ছাড়বেন না। অনেকেই শ্মশানে এসে টুম্পার কাজ দেখে অবাক হন, তাঁকে আশীর্বাদ করেন। তাঁর কাজের জন্য, সাহসিকতার জন্য প্রশংসা করেন। তাইতেই খুশি টুম্পা। জীবনের শেষ আগুন-ধোঁয়া-ছাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে মর্যাদার নতুন সংজ্ঞা লিখছেন মহিলা ডোম।

–

–

–

