ভারতের রাজস্থানের শ্রীগঙ্গানগরের এক ধুলোমাখা শহরে ১৯৫২ সালে জন্মেছিল এক সাধারণ ছেলে—রাভিন্দ্র কৌশিক। স্কুল-কলেজে নাচ, নাটক, অভিনয়ে সবার নজর কাড়লেও কেউ জানত না, এই তরুণ একদিন ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা RAW–এর ইতিহাসে অন্যতম সাহসী নাম হয়ে উঠবে। ১৯৭৩ সালে RAW প্রথম নজরে আনে তার অসাধারণ অভিনয়ক্ষমতা, দ্রুত ভাষা শেখার দক্ষতা এবং গভীর পর্যবেক্ষণশক্তিকে। এক প্রশ্ন ছিল সংস্থার—দেশের জন্য কি নিজের নাম, পরিবার, ধর্ম, পরিচয়—সব ত্যাগ করা সম্ভব? রাভিন্দ্রের উত্তর ছিল শান্ত, দৃঢ়, নির্ভীক—দেশ যদি ডাকে, তার নিজস্ব পরিচয়ের প্রয়োজনই বা কেন?
এরপর শুরু হয় প্রস্তুতির কঠিনতম অধ্যায়। ধীরে ধীরে ‘রাভিন্দ্র’ নামটি ইতিহাস হয়ে যায়। বদলে যায় চেহারা, ধর্ম, ভাষা, অভ্যাস। জন্ম নেয় নতুন পরিচয়—নবী আহমেদ শাকির। পাকিস্তানের সমাজব্যবস্থা, প্রার্থনা, উচ্চারণ—একজন মুসলিম পরিবারের ছেলের মতো করে নতুন জীবন গড়ে তোলার প্রশিক্ষণ চলে মাসের পর মাস। মাত্র ২৩ বছর বয়সে তাকে পাঠানো হয় পাকিস্তানের অভ্যন্তরে। ধাপে ধাপে এমন দক্ষতায় তিনি মিশে যান সমাজ ও ব্যবস্থার মধ্যে যে শেষে জায়গা করে নেন পাকিস্তানের সেনাবাহিনীতেও। সেখান থেকেই ভারতকে পাঠাতে থাকেন গুরুত্বপূর্ণ নথি, সামরিক কৌশল, অস্ত্রচুক্তি সংক্রান্ত তথ্য। বলা হয়, কয়েকটি বড় সংঘর্ষ এড়াতে তার পাঠানো রিপোর্ট ছিল অত্যন্ত কার্যকর। RAW তাকে দেয় বিশেষ উপাধি—‘ব্ল্যাক টাইগার’। অন্ধকারের মধ্যে হেঁটে গিয়ে আলো নিয়ে ফিরে আসার সামর্থ্যের জন্যই এই নাম।
কিন্তু ভাগ্যের চাকা থেমে যায় ১৯৮৩ সালে। RAW–এর আরেক এজেন্ট ধরা পড়লে জেরায় বেরিয়ে আসে রাভিন্দ্রের পরিচয়। এক রাতে তাকে তুলে নিয়ে যায় পাকিস্তানি গোয়েন্দারা। শুরু হয় নিষ্ঠুর নির্যাতন—বৈদ্যুতিক শক, পানিতে ডুবিয়ে জেরা, নখ তোলা, হাত বেঁধে উল্টো ঝোলানো। তবু মুখে একটিও স্বীকারোক্তি আনতে পারেনি কেউ। ১৯৮৫ সালে মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হলেও পরে তা বদলে দেওয়া হয় যাবজ্জীবনে। এক সময় যিনি সেনার অভ্যন্তরে গোপনে কাজ করতেন, নিজের পরিচয় বিলিয়ে দিয়েছিলেন দেশের জন্য, তার শেষ দিনগুলো কাটে একটি অন্ধকার সেলে। পরিবারকে ফোন করারও অনুমতি ছিল না। মা লিখেছিলেন—ছেলেকে ফিরিয়ে দেয়ার আবেদন। কিন্তু প্রোটোকলের কারণে RAW পর্যন্ত কোনো সান্ত্বনা পাঠাতে পারেনি।
সেলে বসে রাভিন্দ্র লিখতেন কবিতা। তার একটি লাইন আজও উল্লেখ করা হয় RAW–এর পুরনো নথিতে—
“আমি মরলেও বদনাম হোক আমার, দেশের সুনাম থাকলেই তাতেই আমার স্বর্গ।” ২০০১ সালে পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালি জেলের ভেতরেই নিঃশব্দে শেষ হয় এই বীরের জীবন। না কোনো পতাকা, না কোনো রাষ্ট্রীয় সম্মান, না কোনো প্রচার। তবু RAW–এর নথিতে আজও লেখা— “Ravindra Kaushik — India’s greatest asset.”
আরও পড়ুন- সরকার বাড়িতে উৎসবের রঙ! আইবুড়ো ভাতে আবেগে ভাসলেন মৌবনী
_
_
_
_
_
_
