ওদের হাসিতে পুজোর আনন্দ খুঁজে পায় মণীন্দ্রচন্দ্র কলেজের সাংবাদিকতা বিভাগ

বর্তমানে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায়শই ছাত্র-শিক্ষক সংঘর্ষ দেখা যায়। প্রায় রোজই খবরের শিরোনামে উঠে আসে এই সব ঘটনা। কিন্তু এমন অবস্থার মধ্যে মহারজা মণীন্দ্রচন্দ্র কলেজের সাংবাদিকতা ও গণজ্ঞাপন বিভাগের অধ্যাপক-অধ্যাপিকা এবং বর্তমান ও প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীরা এক আলাদা বার্তা দিয়েছে। শুরু হয়ে গিয়েছে দেবীপক্ষ। সকলে পুজো পরিক্রমা করতে ব্যস্ত। কিন্তু সেইসব করুণ মুখগুলোর দিকে কেউই সেভাবে তাকানোর সময় পান না, যারা রাস্তার ধারে আলোর রোশনাইয়ের দিকে তাকিয়ে ভাবে তাদের জন্য পুজো কেন আনন্দ নিয়ে আসে না? তবে বিগত ন’বছর ধরে মণীন্দ্র কলেজের সাংবাদিকতা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান বিশ্বজিৎ দাস এবং প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্র- ছাত্রীরা এইসব করুণ মুখগুলোর কথা ভেবে চলেছে।

সালটা ছিল 2011। যখন মণীন্দ্রচন্দ্র কলেজের বিভাগীয় প্রধান বিশ্বজিৎ দাসের মস্তিষ্কপ্রসূত এই ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেয় তারই শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া ছাত্র-ছাত্রীরা। কয়েকজন পথশিশুকে পুজোর আনন্দের মূল স্রোতে ভাসিয়ে দেওয়ার জন্য তাদের নতুন বস্ত্র পড়িয়ে পুজো পরিক্রমা অর্থাৎ মণ্ডপে মণ্ডপে মা দুর্গাকে দর্শন করার যে অভিনব উদ্যোগ বিগত ন’বছর ধরে নিয়ে আসছে মণীন্দ্র কলেজের সাংবাদিকতা বিভাগ, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে।

এই বছর রাজাবাজার এলাকার মোট 75 জন পথশিশুদের নিয়ে কলেজ প্রাঙ্গণ থেকে পুজো পরিক্রমা যাত্রা শুরু করেছিল কলেজের সাংবাদিকতা বিভাগ। এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মণীন্দ্রচন্দ্র কলেজের অধ্যক্ষ মন্টুরাম সামন্ত, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিকে সাউ সহ অন্যান্যরা। সাংবাদিকতা ও গণজ্ঞাপন বিভাগের বর্তমান ছাত্র-ছাত্রীদের সমবেত কন্ঠে ‘আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ঝরিয়ে দাও’ গানটি চতুর্থীর সকালকে কার্যত মোহময় করে তুলেছিল। এরপর বিভাগীয় প্রধান বিশ্বজিৎ দাসের বক্তব্য দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান পর্ব। যেখানে একে একে বিশিষ্ট অতিথিদের মা দুর্গার স্মারক দিয়ে শারদ সম্মান দেওয়া হয়। তারপর একে একে বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট অতিথিরা। তারপর পথশিশুদের হাতে তুলে দেওয়া হয় নতুন বস্ত্র। সেই বস্ত্র পরিয়ে দুটি এসি বাসে করে শুরু হয় পুজো পরিক্রমা

প্রথমে উল্টোডাঙ্গা লালাবাগান সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটি দিয়ে এই যাত্রা শুরু হয়। যেখানে মূলত নিত্যপ্রয়োজনীয় বাসনপত্র দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এই অভিনব প্যান্ডেল। যা দেখে ছোট ছোট শিশুরা আপ্লুত।

সাংবাদিকতা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান বিশ্বজিৎ দাস বলেছেন, ‘দেখতে দেখতে ন’টা বছর কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না। ছোট্ট একটা ভাবনা নিয়ে শুরু করেছিলাম, যা আজ বিরাট আকার ধারণ করেছে। এটা কখনোই সম্ভব হতো না, যদি না আমার বিভাগের বর্তমান ছাত্র-ছাত্রীদের পাশাপাশি প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদের আমি সমর্থন পেতাম। সব মিলিয়ে একটা আলাদা আবেগ, যা পূজোর আনন্দকে আরও হাজার গুণ বাড়িয়ে তোলে।’

বিশ্বজিৎ দাসের সুরে সুর মেলান অধ্যাপিকা শিল্পী মুখার্জি। প্রসঙ্গত, বলে রাখা ভাল শিল্পী বর্তমানে এই কলেজের অধ্যাপিকা হলেও অতীতে এই বিভাগেরই ছাত্রী ছিলেন। প্রাক্তন ছাত্রী থেকে অধ্যাপিকা হয়ে ওঠার মাঝে এই অভিনব উদ্যোগ সম্পর্কে তিনি স্মৃতিচারণা করেন। তাঁর কথায়, ‘আমাদের সময় থেকেই এই অভিনব উদ্যোগের কথা ভেবেছিলেন বিডি স্যার। আজ আমাদের বর্তমান প্রজন্ম সেটাকে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে, এটা দেখতে ভীষণ ভাল লাগছে। আশা করব, পরবর্তীকালে যেসব ছেলে-মেয়েরা এই বিভাগে যোগ দেবে, তারাও একইভাবে এই ধারাকে বয়ে নিয়ে চলবে। 75 জন শিশুকে আজ নতুন বস্ত্র দিয়ে পুজো পরিক্রমা করাচ্ছি আমরা। আগামী বছর 10 বছরে পা রাখবে এই প্রয়াস। তাই ভাবনা আরও বড় হবে বলে আশাবাদী।’

উল্টোডাঙ্গা লালাবাগানের পুজো দিয়ে যাত্রা শুরু হওয়ার পর সল্টলেক এফডি ব্লক, দমদম পার্ক ভারতচক্র, দমদম পার্ক তরুণ দল, দমদম পার্ক তরুণ সংঘ সহ শহরের বেশকটি পূজামণ্ডপে পরিক্রমা চলে। অবশেষে নিউটাউনের একটি পুজো এই শিশুদের হাত দিয়ে উদ্বোধন করিয়ে আবার মণীন্দ্রচন্দ্র কলেজেই ফিরে এসে শেষ হয় এদিনের পুজো পরিক্রমা। সব মিলিয়ে ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ একটা সম্পর্ক রয়েছে, তা এই উদ্যোগ থেকে পরিষ্কার ফুটে ওঠে।

এদিনের অনুষ্ঠানের আরও একটি মূল আকর্ষণ ছিল, প্লাস্টিক মুক্ত পৃথিবী গড়ে তোলার অঙ্গীকার এবং গাছ বাঁচাও অঙ্গীকার বদ্ধ হওয়া। প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীদের একটি করে চারা গাছ দেওয়া হয়, যা আগামী এক বছর ধরে তারা বড় করে তুলবেন। আগামী বছর এই পুজো পরিক্রমার দিনেই সেই বড় হয়ে ওঠা গাছের ছবি ছাত্র-ছাত্রীরা কলেজে পেশ করলে তার থেকে প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্থানাধিকারীকে পুরস্কৃত করা হবে বলে জানিয়েছে কলেজে সাংবাদিকতা বিভাগ। সব মিলিয়ে জমজমাট ছিল মণীন্দ্রচন্দ্র কলেজের সাংবাদিকতা বিভাগের এই পুজো পরিক্রমা, তা বলাই যায়।

Previous articleআলতা-সিঁদুর ৭৫ বছরে রামমোহন সম্মিলনী, উদ্বোধনে দশভূজাকে সম্বর্ধনা
Next articleব্রেকফাস্ট নিউজ