Wednesday, November 12, 2025

নোবেল এবং ‘ফাটা বাঁশে আটকানো’ বিজেপি

Date:

Share post:

কণাদ দাশগুপ্ত

এমনিতে তিনি নাকি সোশ্যাল মিডিয়ায় দারুন পোক্ত। কোনও কিছু ঘটার আগেই ট্যুইটারে ওনার সচিত্র মন্তব্য দেখা যায়। সেই তিনি ‘মাত্র’ 4 ঘন্টা সময় নিলেন নোবেলজয়ী বাঙালি অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়কে অভিনন্দন জানাতে। একেই বোধহয় বলে ‘ফাটা বাঁশে সব কিছু আটকে যাওয়া’। নাহলে ‘ট্যুইটার-ফ্রেন্ডলি’ নরেন্দ্র মোদি তো এত দেরিতে ফুটেজ খাওয়ার মানুষ নন। সংশ্লিষ্ট লোকজন জানেন, বারোমাসই সোশ্যাল মিডিয়ায় অত্যন্ত তৎপর নরেন্দ্র মোদির ট্যুইটার হ্যান্ডলগুলো। সেই মোদি নিশ্চুপ রইলেন চারঘন্টা। আসলে বুঝতে পারছিলেন না যতই নোবেল পান, এই অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ধারাবাহিকভাবেই মোদি-অর্থনীতির কড়া সমালোচক। দেশ-বিদেশে ঘুরে যুক্তি দিয়েই সমালোচনা করেছেন মোদির নোটবন্দির। যে কাজের জন্য আজ তিনি নোবেলজয়ী হলেন, তার একটা অংশে ভারতের উল্লেখ আছে। যেখানে ছত্রে ছত্রে সমালোচনা করা হয়েছে এদেশের সাম্প্রতিক দিশাহীন অর্থনীতির। সেই লোকটিকে আজ অভিনন্দন জানাতে হবে, এটা সম্ভবত প্রথমে চাননি প্রধানমন্ত্রী। সূত্রের খবর, সরকারিস্তরে নাকি স্থির হয়েছিলো, রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী নোবেল-ইস্যুতে চুপ থাকবেন। উপরাষ্ট্রপতি নিয়ম রক্ষার ট্যুইট করবেন। কিন্তু ততক্ষণে আবেগে ভেসেছে এই বাংলা। সোশ্যাল মিডিয়া উপচে যায় অভিজিৎ-বন্দনায়। ভোটের মুখে এই ঝুঁকি নিতে বারণ করা হয় রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীকে। আর তারপরই সোমবার সন্ধ্যা 7টা 14 মিনিটে ট্যুইটারে অভিনন্দন বার্তা দেন নরেন্দ্র মোদি। আর 7টা 27 মিনিটে অভিনন্দন-ট্যুইট করেন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ। মাঝে শুধু কেটেছে চার-চারটি ঘন্টা। একেও যদি ‘ফাটা বাঁশে আটকানো’ কেস বলা না যায়, তাহলে আর কাকে বলবেন !

তবে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর অভিনন্দন যতই তিনি পান, অভিজিৎ বিনায়কের কপালে কিন্তু বিজেপির খিস্তি নাচছেই। অভিজিতের ‘স্যর’ অমর্ত্য সেন যে সব কারনে উঠতে বসতে ‘গেরুয়া-খিস্তি’ খেয়ে চলেছেন, সেই একই কারনে এবার তোপের মুখে পড়বেনই ‘ছাত্র’ অভিজিৎ বিনায়ক। ‘অপরাধ’ একটাই, মোদি-সরকারের অর্থনীতির সমালোচনা করা। এই অপরাধ নাকি ক্ষমারও অযোগ্য। তাই অপেক্ষা শুধু সময়ের। মোদির নোটবন্দির কঠোর সমালোচক অভিজিৎকে নিয়ে এমনিতেই অস্বস্তিতে ভুগছিলেন মোদি। তাই তাঁর এই নোবেল পাওয়াকে বড় বিষয় হিসেবে দেখতে নারাজ কেন্দ্র তথা কেন্দ্রের শাসক দল।

দেখবেই বা কেন?
Demonetisation বা নোটবন্দি-র কড়া সমালোচনা করে অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় 2017 সালেই বলেছিলেন, “নোট বাতিলের পথ ব্যর্থ হবে”। সেদিনই তিনি আশঙ্কা করেছিলেন, “ক্ষতির পরিমাপটা আমরা এখনও ঠিকমতো আন্দাজ করতে পারিনি। হয়তো তা আমাদের আন্দাজের থেকে অনেক বেশি। কারন, সংগঠিত ক্ষেত্রের উপরে দাঁড়িয়ে আমরা অসংগঠিত ক্ষেত্রের আন্দাজ পাই। ফলে আমাদের মোট অভ্যন্তরীন উৎপাদন বা GDP অনেক সময়ে ক্ষতির পুরো আন্দাজটা দিতে পারেনা।”

2017 সালে অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় যে আশঙ্কা করেছিলেন, তার প্রাথমিক প্রমান মিলতে শুরু করেছে। সেদিন অভিজিত বলেছিলেন, “মোদির এই নোটবন্দির ঘোষণা তাঁর মতোই বিশ্বের অর্থনীতিবিদের মহলকে খানিকটা হতচকিত করে দিয়েছে। নোটবাতিলের পর কেনই বা দু’হাজার টাকার নোট বাজারে ছাড়া হলো তাও অভিজিৎবাবুর কাছে বোধগম্য হয়নি সেদিন। এ ধরনের মন্তব্যের কারনও ব্যাখ্যা করেছিলেন এই অর্থনীতি-বিশেষজ্ঞ। দীর্ঘ গবেষণা এবং অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তিনি বলেছিলেন, “ভারতে শ্রমজীবীদের 85 থেকে 90 শতাংশই অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন এবং ওই ক্ষেত্র প্রায় পুরোটাই নগদ নির্ভর। সুতরাং নোটবন্দির জেরে বাজারে নগদের জোগানে টান পড়লে বিপুল সংখ্যক অসংগঠিত শ্রমিকের রুটি-রুজিতে টান পড়বে।” এসব কথা একদমই পছন্দ হয়নি কেন্দ্রের শাসক দলের। বিজেপি নেতৃত্বের তাই আজ মনে হতেই পারে, একা অমর্ত্যে রক্ষে নেই, অভিজিত দোসর! অভিজিৎবাবুও বিজেপি বা মোদি প্রসঙ্গে অমর্ত্য সেনের সুরেই কথা বলেন। এটা হজম করা একটু কঠিন হতেই পারে। অভিজিত বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়কে হেয় করার নীতিই সম্ভবত বিজেপি তথা কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ে ফেলেছে। সেকারনেই মোদির অভিনন্দন বার্তা আসতে দেরি হয়েছে। অভিজিৎবাবু যে মোদির আর্থিক নীতিকে পছন্দ করেন না, তা বিজেপি জানে। লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের ইস্তাহারে যে ‘ন্যায়’ প্রকল্প ঘোষণা করা হয়েছিলো, সেই সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির রূপরেখা তৈরি করেছেন অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ই। এ কথাও বিজেপির অজানা নয়। সেই অভিজিত-ই নোবেল পেলেন।

নোবেল কর্তৃপক্ষ বলেছে, “এ বছরের নোবেল বিজেতাদের গবেষণা দুনিয়াভর দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য আমাদের শক্তি বর্ধন করেছে। মাত্র দু ‘দশকে তাঁদের নতুন গবেষণা ভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি উন্নয়নের অর্থনীতিতে রূপান্তর এনেছে, যা বর্তমানে গবেষণার এক উদীয়মান ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।” নোবেল পুরস্কারের মুখপাত্রের ব্যাখ্যা, “এই অর্থনীতিবিদদের বৈশিষ্ট্য হল, উন্নয়ন অর্থনীতির সমস্যাগুলি নিয়ে, বিশেষ করে দারিদ্র্য দূরীকরণের ব্যাপারে তাঁরা সমস্যাজনক সেইসব অংশগুলিকেও ক্ষুদ্রতর অংশে ভেঙে নিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছেন কোন নীতি কাজ করছে, কোন নীতি কাজ করেনি।” এসব কথা তো কেন্দ্রীয় সরকারকে অস্বস্তিই দিচ্ছে।
দু’টো কথা এরপরেও বলা যায়।
প্রথম, নোটবন্দি ভারতের অর্থনীতিকে বিন্দুমাত্র সাহায্য করতে পারেনা, দু’বছর আগেই তা বুঝতে পেরেছিলেন অভিজিৎবাবু। যে মেধা দিয়ে তিনি এটা বুঝেছিলেন, সেই মেধাকেই স্বীকৃতি দিয়ে এই নোবেল। যারা সেদিন অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিতের মতো নোটবন্দির জয়গান গেয়েছিলেন, তাঁদের গালে থাপ্পড় মেরেছে এই নোবেল পুরস্কারজয়ী অর্থনীতিক। এই নোবেলপ্রাপ্তি বুঝিয়েছে, তিনিই ঠিক। তাঁর আশঙ্কা সত্যি প্রমান করেই দেশজুড়ে আজ মন্দা নেমে এসেছে।

এবং দ্বিতীয়, নোবেল কমিটি অর্থনীতির কিসস্যু বোঝে না। বুঝলে এই পুরস্কারটা গতবছর মোদিজিই পেতেন।

আরও পড়ুন-ঘরের মাঠেই বিপত্তি! বিজেপির আর্থিক নীতিকে দুষলেন খোদ নির্মলার স্বামী

 

spot_img

Related articles

ইডেনে অল-রাউন্ডারদের অতিরিক্ত গুরুত্ব, জুরেলকে নিয়ে ভারতীয় থিঙ্ক ট্যাঙ্কের ভাবন কী?

ভারত দক্ষিণ আফ্রিকা প্রথম টেস্টে(Ind vs Sa Test) শুরু হওয়ার আগে চর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে  ইডেনের পিচ। মঙ্গলবার অনুশীলনের দফায়...

দিল্লি বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন দেহ সনাক্তকরণে ট্যাটু- টি-শার্টে ভরসা!

লালকেল্লার সামনে ভয়াবহ বিস্ফোরণের (Delhi blast near Red fort) জেরে মৃতদের সনাক্তকরণে বাড়ছে সমস্যা (Deadbody Identification)। দেহ ছিন্নভিন্ন...

দিল্লি বিস্ফোরণে ধৃত বেড়ে ১৫, তদন্তে দশ সদস্যের NIA টিম

লালকেল্লায় কাছে বিস্ফোরণ পরিকল্পনা মাফিক নয় বরং তাড়াহুড়োর জেরেই ঘটেছে এই ঘটনা, কি খাবার কেন্দ্রীয় রিপোর্টে উঠে এলো...

তিলোত্তমার তাপমাত্রা ১৭ ডিগ্রি, বুধেই মরশুমের শীতলতম দিন মহানগরীতে!

বঙ্গবাসীর আশা পূরণ করে স্বমহিমায় ইনিংস শুরু করেছে শীত (Winter)। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ শেষ হতে না হতেই পারদ...