একদিকে স্বাধীনতা সংগ্রাম অন্যদিকে ক্রীড়াপ্রেম। ১৯০০ সালের শুরুর দিকটা ছিল বাংলা তথা ভারতীয় ফুটবলে এক যুগান্তকারী সময়৷ ১৯১১ সালে গোড়াদের মুখে ঝামা ঘষে মোহনবাগানের ঐতিহাসিক শিল্ড জয় ছিল তার অন্যতম।স্বদেশি আন্দোনের মাঝেই তখন ঘরে ঘরে বাঙালি যুবকদের মধ্যে একটা ফুটবল উন্মাদনা তৈরি হয়েছিল৷ সকলের মুখে মুখে শুধু একটাই নাম মোহনবাগান৷ শিবদাস ভাদুড়ি-অভিলাষ ঘোষরা খালি পায়ে ইংরেজদের রেজিমেন্ট দলকে ঐতিহাসিক আইএফএ শিল্ড ফাইনালে যেভাবে নাস্তানাবুদ খাইয়েছিলো, অবিভক্ত বাংলার আপামর বাঙলির হৃদয়ে খোদাই হয়ে গিয়েছিল মোহনবাগানের নাম।

সবই ঠিক চলছিল, কিন্তু এরই মধ্যে এক বিতর্ক৷ সেই বিতর্ককে কেন্দ্র করে প্রতিবাদ৷ এবং সেই প্রতিবাদ থেকে জন্ম নিল নতুন একটি ক্লাব৷ নাম ইস্টবেঙ্গল৷ যা আজ ইতিহাস৷ পয়লা অগস্ট ইস্টবেঙ্গল দিবস। শত বসন্ত পেরিয়ে পার করে দিলো ময়দানের এই ঐতিহ্যশালী ক্লাবটি।


কিন্তু কীভাবে জন্ম হয়েছিল এই ক্লাবের? যে ক্লাবের সঙ্গে লাখো মানুষের আবেগ জড়িয়ে আছে৷ কেনই বা তার নাম ইস্টবেঙ্গল?ঐতিহ্য আর আধুনিকতার মোড়কে ময়দানের বুকে বটবৃক্ষের মতো দাঁড়িয়ে থাকা আজ সে নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান৷ চলুন সময়ের কাঁটা ধরে ফিরে যাই অতীতের সেই দিনটায়৷

সালটা ছিল ১৯২০৷ জুলাইয়ের এক গুমোট বিকেল। কোচবিহার কাপের ফাইনাল৷ দুই ফাইনালিস্ট মোহনবাগান আর জোড়াবাগান ক্লাবের মধ্যে খেলা শুরু হব হব করছে৷ হঠাৎ একটি খবর! কোনও এক অজানা কারণে অপ্রত্যাশিতভাবে জোড়াবাগান ক্লাবের প্রথম একাদশ থেকে বাদ পড়েছেন নির্ভরযোগ্য ডিফেন্ডার শৈলেশ বোস। কানাঘুষোয় শোনা গেল, পদ্মাপারের লোক হওয়ার ‘অপরাধে’ই নাকি এমন একচোখো বৈরিতার শিকার হতে হল লেফট ব্যাক শৈলেশকে।


ঘটনার প্রতিবাদে জোড়াবাগানের ভাইস-প্রেসিডেন্ট সনামধন্য শিল্পপতী সুরেশচন্দ্র চৌধুরি তৎক্ষণাৎ পদত্যাগ করলেন। তাঁরই চেষ্টায় এবং সন্তোষের রাজা মন্মথনাথ চৌধুরি (যাঁর নামানুসারে সন্তোষ ট্রফি টুর্নামেন্ট), রমেশচন্দ্র সেন (নাসা), তড়িৎভূষণ রায় এবং অরবিন্দ ঘোষের আনুকুল্যে ১৯২০ সালের পয়লা অগাস্ট, ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের জন্ম হয় উত্তর কলকাতার এক সম্ভান্ত পরিবারের একটি ঘরে৷ পরে ক্লাব তাঁবু সরে আসে ময়দানে৷

ইস্টবেঙ্গল ক্লাব জন্ম নেওয়ার নেপথ্যে মোহনবাগানের ভূমিকা নেহাৎ কম নয়৷ কোচবিহার কাপের ওই ফাইনালে চ্যাম্পিয়ন হয় মোহনবাগান৷ জোড়াবাগান জিতলে হয়তো ইস্টবেঙ্গল নামক ক্লাবটার উৎপত্তিই হত না৷ ইতিহাসটা হতে পারতো অন্যরকম৷ শোনা যায়, বিপক্ষ দলে শৈলেশ বোসকে না খেলানোর পিছনে তৎকালীন মোহন কর্তাদের নাকি ইন্ধন ছিল৷ বাঙালদের প্রতি অযথা বিদ্বেষ এবং তার প্রতিবাদে জন্ম একটি ক্লাবের৷ তাই ঘটিদের উচিত শিক্ষা দিতেই একবাক্যে ক্লাবের নাম রাখা হয়েছিল ইস্টবেঙ্গল৷ আর খুব স্বাভাবিকভাবেই, এই দলের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর নাম মোহনবাগান।

এবার ক্লাবের সাফল্যের ইতিহাসটা একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক৷ দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর প্রথম সাক্ষাতে নেপাল চক্রবর্তীর দেওয়া একমাত্র গোলে ম্যাচের ফল ইস্টবেঙ্গলের অনুকূলে গিয়েছিল।

ইস্টবেঙ্গল কলকাতার একমাত্র ক্লাব যারা টানা ছ’বার কলকাতা লিগ জিতেছে (১৯৭০-১৯৭৫)। পর পর দু’বার জাতীয় লিগ জেতার একমাত্র কৃতিত্ব এই ক্লাবের রয়েছে, ২০০৩-২০০৪ সালে। স্বাধীনতার পর ইস্টবেঙ্গল প্রথম ভারতীয় ক্লাব, যারা ইরানের পাস ক্লাবের মত বিদেশি দলকে হারিয়ে আইএফএ শিল্ড জিতেছে। ১৯৭০-এর সেই ইতিহাস হয়ে যাওয়া ম্যাচের একমাত্র গোলটি করেন পরিমল দে। এরপরে ২০০৩ সালে, এই ক্লাবের আশিয়ান কাপ জয় তো মহাদেশীয় ফুটবলের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে৷
আহমেদ খান কিংবা ভাইচুং ভুটিয়ার মত কিংবদন্তি খেলোয়াড়দের কাছে ইস্টবেঙ্গল নামটার সঙ্গে “মাদার ক্লাব” শব্দবন্ধ জড়িয়ে আছে। এই ক্লাবের গ্যালারি এখনও মনে করে রেখেছে সুধীর কর্মকারের শেষমুহূর্তে করা ট্যাকলে প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়ের পা থেকে বল ছিনিয়ে আনা কিংবা মাঝমাঠ থেকে নির্ভুল নিশানায় পিন্টু চৌধুরির লঙ বল বক্সের মধ্যে থাকা ফরোয়ার্ডের মাথায় ফেলা।

আসলে নিছক চাঁদির টান ছাড়াও ইস্টবেঙ্গল নামের ভেতর লুকিয়ে থাকা অগণিত মানুষের স্বপ্ন-মানচিত্র এই ক্লাবে খেলে যাওয়া প্লেয়ারদের জার্সির লাল-হলুদে ঠিকরে বেরিয়েছে।

দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেই ঘুরে দাঁড়ানোর শপথে শান পড়েছে তখন, অতলের মধ্যে থেকেই পাহাড়চুড়োর স্বপ্ন দেখাটাও সেই বাঙালে গোঁ-এর একটা জাতি-লক্ষণ কিনা!
পদ্মাপারের বৃত্তান্ত হৃদয়ে জ্বালিয়ে সেই যে বল পেটানোর শুরু, তার লাল-হলুদ আবেগ ভারতীয় এবং ক্ষেত্রবিশেষে আন্তর্জাতিক ফুটবলে এখনো জ্বলজ্বল করছে। ময়দানে কোনও বেলাশেষে যখন গঙ্গাপারের স্টিমারে পূরবীর ভোঁ বেজে ওঠে, গড়ের মাঠের আকাশে রঙের পাগলা ঘোড়া সপাট টানের মত ছুটতে শুরু করে, তখন হাতে হাতে জ্বলে ওঠে মশাল, যার আগুনে বাংলার চোখের তারা আর ঘামে ভেজা লাল-হলুদ জার্সি একাকার হয়ে যায়।

কমলকুমার মজুমদার কোন এক ঘরোয়া আড্ডায় একবার বলেছিলেন, “বাঙালদের হিস্ট্রি আছে, জিওগ্রাফি নেই।” ইস্টবেঙ্গল ক্লাব বোধহয় সেই হারিয়ে যাওয়া ভুগোল-বই, যেখানে সুবচনীর হাঁস বেলাশেষে পালক ধুতে বাড়ির পুকুরে নামে, চাল-ধোয়া কিশোরী হাতের স্পর্শ পেয়ে শিউরে ওঠে আলপনারা, আর রেললাইন ধরে তীব্রগতিতে ছুট্টে যাওয়া চোখের অবাধ উল্লাস টুকরো টুকরো হয়ে মিশে যায় কাঠের ডিভাইডারে।

তুমি-তোমরা কিংবা আমি-আমরা ঘরে ফিরি সেই মুহূর্তগুলোতে। ব্যারিকেড অগ্রাহ্য করে কেবল লাল-হলুদ নিয়ে৷ কেবল লাল-হলুদ হয়ে৷