Sunday, August 24, 2025

অবিমৃশ্যকারিতা! কণাদ দাশগুপ্তর কলম

Date:

Share post:

কণাদ দাশগুপ্ত

একইসঙ্গে চোরকে চুরি করার এবং গৃহস্থকে সতর্ক থাকার ‘পরামর্শ’ দেওয়ার প্রকৃষ্ট উদাহরণ, চলতি বছরের দুর্গোৎসব৷

অথচ, আমরাই একদিন সংক্রমণ ছড়ানোর জন্য তবলিগ জামাতকে অভিযুক্ত করেছিলাম৷ আজ কীভাবে সেই অভিযোগের যৌক্তিকতা প্রমাণ করবো ? এই পুজোকে কেন্দ্র করে মহাবিপর্যয়ের একটা আশঙ্কাকে আমরাই ডেকে আনছি৷ সত্যিই তেমন কিছু হলে, তার দায় কে নেবে?

‘কোভিড-মুক্ত দেশ বা রাজ্য’ ঘোষণার কোনও গাইডলাইন এখনও প্রকাশ্যে আসেনি৷ কোন কোন শর্ত পূরণ হলে ‘কোভিড-মুক্ত’ বলা যাবে, সেই বিষয়টিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রক বা ICMR এখনও আলোচনার টেবিলে আনতে পারেনি৷ পারার কথাও নয়৷ কারন, করোনাভাইরাস এখনও ‘মুক্তি’ দেয়নি৷ উল্টে রবিবার কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী বাংলা-সহ একাধিক রাজ্যে ‘গোষ্ঠী-সংক্রমণ’ শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন৷ তাই এ রাজ্যে করোনা-ত্রাস আজও বহাল৷

উৎসবের দোরগড়ায় দাঁড়িয়ে ভালো নেই বাংলা৷ সরকারি তথ্য বলছে, রাজ্যে কোভিড- আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে৷ দীর্ঘায়িত হচ্ছে মৃত্যুমিছিল৷ মাঝে সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে, শ্লথগতিতে হলেও স্বস্তির পথে হাঁটছিলো বাংলা৷ কিন্তু রাজ্যজুড়ে নানা রংয়ের রাজনৈতিক কর্মসূচির সংখ্যা হঠাৎই বেড়ে যাওয়ায় এবং সরকারি অনুমতিক্রমে ঘাটে ঘাটে মহালয়ায় বেলাগাম তর্পণের জেরে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা যে হারে বাড়ছে, তাতে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কিত৷ আর এবার, পুজোর মধ্যে অথবা পুজোর অব্যবহিত পর এই অতিমারি মহাসর্বনাশের পথে ঠেলে দেবে বাংলাকে৷

দুর্গাপুজো-কেন্দ্রিক স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর বা SOP-তে যা যা বলা হয়েছে, তা
লঙ্ঘন করার প্রতিযোগিতাও শুরু হয়ে গিয়েছে৷ যে শর্তে পাড়ার ক্লাবগুলি ৫০ হাজার টাকার ‘উৎসাহ-ভাতা’ পেয়েছেন, দ্বিতীয়া থেকেই সে সব শর্তকে বুড়ো আঙুল দেখানো শুরু হয়ে গিয়েছে৷ ওদিকে, থানায় লোকবলের অভাবে পুলিশের পক্ষে এলাকার সব পুজোয় সমান নজর রাখা কার্যত অসম্ভব৷ সরকারি টাকা হস্তগত হওয়ার পর পুজো কমিটি নিজেদের দায় পালনে কতখানি তৎপর, দ্বিতীয়ার ‘প্যাণ্ডেল-হপিং’ সেই প্রশ্নই তুলে দিচ্ছে৷ এর সমাধান কেমনভাবে হবে?

এসব ছবি নানা আশঙ্কা আর উদ্বেগ জাগালেও প্রশাসনিক পদক্ষেপ এখনও পর্যন্ত শুধুই নির্দেশিকা- জারি কেন্দ্রিক৷ অথচ, হাতেই আছে কেরলের টাটকা উদাহরণ৷ ওনাম উৎসব পালন করে কেরল দেশের সব রাজ্যকে সংক্রমণে হারিয়ে দখল করেছে প্রথম স্থান৷ এখনও পর্যন্ত সামনে কোনও ‘চ্যালেঞ্জার’ নেই৷ দিনকয়েক পর ‘খেতাব’ ধরে রাখতে কেরলকে হয়তো লড়তে হবে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে৷ বিশেষজ্ঞদের অভিমত, সেদিন কেরলের পক্ষে বাংলাকে হারানো কঠিন হবে৷ বাংলার ‘সাফল্য’ দেখতে অপেক্ষা করতে হবে আর মাত্র দিন দশেক৷

ওনামের থেকে দুর্গাপুজোর পরিধি বহুগুণ বড়৷ ওনামের আগে কেরল সরকার বেশ কিছু নির্দেশ জারি করেছিলো৷ কী করতে হবে, কী করা যাবেনা, বিজয়ন সরকার কেরলবাসীকে তা জানিয়েছিলো৷ ওই নির্দেশিকা বা SOP মানা হচ্ছে কি’না, তা দেখবে প্রশাসন, এমনও বলেছিলো কেরল সরকার৷ সতর্কবিধি জারি করে দায় সারতে তথাকথিত ‘কঠোর নজরদারি’র পরেও কেরল সংক্রমণ ঠেকাতে ব্যর্থ৷ এ রাজ্যের সরকার দুর্গাপুজো নিয়ে ‘কড়া’ নির্দেশিকা প্রকাশ করেছে৷ সরকার বলেছে, “দুর্গাপুজো-সংক্রান্ত নির্দেশিকা বা SOP মানা হচ্ছে কি’না, তা দেখবে প্রশাসন৷” এখনই যে সব ছবি সামনে আসছে, তাতে ধন্দ জাগছে, কেরল যা পারেনি, বাংলা তা কতখানি পারবে এবং কীভাবে পারবে? কেরল-পরিসংখ্যানকে সামনে রেখেই এ রাজ্যের চিকিৎসক- বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, ষষ্ঠী-সপ্তমী থেকেই বাংলায় দৈনিক সংক্রমণ দাঁড়াতে পারে ১২-১৩ হাজারে৷ এর মধ্যে কতজন ‘করোনা-জয়ী’ হয়ে ফিরতে পারবেন, তা আগাম আন্দাজ করা কঠিন৷ রাজ্যের বহু জেলায় এখনও সেইভাবে চিকিৎসা পরিকাঠামোই গড়ে তোলা যায়নি৷ পুজোর পরে সংক্রমণ বৃদ্ধির শঙ্কায় প্রশাসন সবে জেলাস্তরে কোভিড-শয্যা বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে নেমেছে৷​ সরকার নিজেই আশঙ্কিত,পুজোর পরে হাসপাতালগুলিতে কোভিড- চিকিৎসার বেড হয়তো থাকবে না৷
হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা সীমিত। টানা মার্চ- এপ্রিল থেকে অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীরা৷ কেউ কোনও ছুটি পাননি। লাগাতর এত পরিশ্রম করা শারীরিকভাবেই অসম্ভব৷ ফলে পরিশ্রম করার ক্ষমতা কমছে। তাহলে দুর্গাপুজোর সময় বা পুজোর পর সংক্রমণ মাত্রাছাড়া হলে তা ঠেকানোর উপায় কী? ​ প্রশাসনের নজরের বাইরে তো কিছু নেই৷ সবাই সব জানে৷ এ কোন অশনি সংকেত? কেরলের কোভিড-পরিসংখ্যান নিশ্চিত করছে, ওনাম উৎসবের কারণেই ওই রাজ্যের স্বাস্থ্যপরিস্থিতি ভয়াবহ হচ্ছে৷ কিন্তু এরপরেও কি রাজ্য প্রশাসন সতর্ক হবে না?

পুলিশ, প্রশাসন, পুজো কমিটি বা ‘ফোরাম ফর দুর্গোৎসব’ সতর্কতামূলক যে ধরনের পদক্ষেপের কথা বলে চলেছে, তার একশো শতাংশ বাস্তবায়ন কার্যত অসম্ভব৷ এক্ষেত্রে নানা সমস্যা মাথাচাড়া দেবে৷ ভোটের বছর, তাই থাকবে গোপন- রাজনৈতিক হস্তক্ষেপও৷ দুর্গাপুজোর মতো মহোৎসব, যেখানে আমজনতার অংশগ্রহণই মুখ্য বিষয়, সেখানে সব সময় লাঠি উঁচিয়ে বিধি মানানো অসম্ভব৷ তেমন ঘটনা পুলিশ বিচ্ছিন্নভাবে ঘটালে, সরকারের কাছে জবাবদিহি করতে হবে৷ কারন, ভোট বড় বালাই৷ তাছাড়া, বিরোধীরা ওই ইস্যুতে পথে নামলে সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও অবনতি ঘটতে পারে ৷

সুতরাং এ বছরের দুর্গাপুজোর ইতিবাচক দিক কার্যত একটিও নেই৷ বরং শারীরিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক, প্রতিটি ধাপেই শারদোৎসবের অনুভূতি অনুভব করার প্রশ্নে সম্পর্কশূন্যতাকেই পরিস্ফুট করছে৷

তবুও প্রশাসনিক সহযোগিতার জোরে এ বছরও আমরা একই মেজাজে পুজোয় মেতেছি৷ পুজোর আয়োজক হলে, পুজোর মদতদাতা হলে, পুজোর হুল্লোড়ে গা ভাসালে করোনা ‘ভয়ে’ পাশ কাটিয়ে চলে যাবে, বিশেষ গবেষণালব্ধ এমন কিছু তথ্য তো এখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে আসেনি,

তাহলে এই অবিমৃশ্যকারিতা কেন ?

আরও পড়ুন-প্রত্যেকটি পুজো মণ্ডপ হোক কনটেনমেন্ট জোন- শুনানিতে মন্তব্য হাইকোর্টের

spot_img

Related articles

‘নিখুঁত ভুলগুলি’, উৎপল সিনহার কলম

একটা দুঃখের কথা পথে ও বিপথে ঘুরে প্রত্যাখ্যাত হতে হতে গান হয়ে ওঠে ...একটি দুঃখের কথা পথে ও বিপথে ঘুরে প্রত্যাখ্যাত হতে হতে গান...

ষোলতেই ১৩০ কেজি! ছেলের খাবার জোগাতেই নাজেহাল বাবা-মা

মুর্শিদাবাদ জেলার সাগরদিঘি থানার কাবিলপুর পঞ্চায়েতের মথুরাপুর গ্রাম। এখানেই থাকেন দিনমজুর মুনশাদ আলি। তাঁর ছোট ছেলে জিশান আলি...

কবে থেকে শুরু জয়েন্টের কাউন্সেলিং? দিনক্ষণ জানিয়ে দিল বোর্ড

ফলপ্রকাশের পর এবার ১৫ দিনের মধ্যেই কাউন্সেলিং প্রক্রিয়া তথা ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ করবে জয়েন্ট এন্ট্রান্স বোর্ড। এবার কাউন্সেলিং...

ফলতা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ইলিশ উৎসব, পড়ুয়াদের জন্য পাতে ভাপা–ভাজা ইলিশ

বাজারে ইলিশের যা আগুন ছোঁয়া দাম তাতে উচ্চবিত্তদেরই পাতে ইলিশ জোটাতে হিমশিম খাওয়ার জোগাড়। কিন্তু সেই  দুর্মূল্যের বাজারেই...