মমতার মাস্টার স্ট্রোক আর অভিষেক-পিকের যোগ্য সঙ্গতে ১৬ আসনে অ্যাডভান্টেজ তৃণমূল

mamata banerjee, bimal gurung, abhishek banerjee, মমতার মাস্টার স্ট্রোক আর অভিষেক-পিকের যোগ্য সঙ্গতে ১৬ আসনে অ্যাডভান্টেজ তৃণমূল
কিশোর সাহা

জোড়বাংলো মোড় টু টাইগার হিল, এই রাস্তায় যিনি নিয়মিত হেঁটে যাতায়াত করেন, তিনি তো দার্জিলিঙের নাড়িনক্ষত্রের হদিস রাখবেনই।

রিচমন্ড হিল থেকে শুরু করে সুকনার জঙ্গলের মহানন্দা নদীর ধারের অন্তত শতাধিক গাছ ও প্রকল্পের নাম দিয়েছেন যিনি, তিনি তো অনায়াসে দার্জিলিঙের হৃৎস্পন্দন ধরতে পারবেনই।
হ্যাঁ, দীর্ঘদিন, বহুবার তাঁর পাহাড় ও সমতলের সঙ্গী থাকার সুবাদে এটা বলতে পারি, দার্জিলিঙের হার্টবিট ভালমতো চেনেন বলেই বিমল গুরুংদের শান্তির পথে হাঁটতে বাধ্য করে দুর্দান্ত মাস্টার স্ট্রোক দিয়েছেন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আগামী বিধানসভা ভোটে সেই মাস্টার স্ট্রোকের ফসল যাতে পুরোপুরি ঘরে ওঠে সে জন্য নিঃশব্দে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন তৃণমূল যুব সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ও ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোর।

একে মাস্টার স্ট্রোক, তার উপরে অভিষেক-পিকের যুগলবন্দি, সব মিলিয়ে আগামী বিধানসভা ভোটের ৬ মাস আগেই উত্তরবঙ্গের ১৬টি বিধানসভা আসনে অনেকটাই এগিয়ে গেল তৃণমূল। জয় নিশ্চিত করে ফেলল বলাটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। তবে পাহাড়ের তিন বিধানসভা আসনে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার প্রার্থীকে তৃণমূল সমর্থন করলে জয় যে নিশ্চিত তা বলাই যায়। সঙ্গে সমতলের ১৩টি আসনে নেপালি ভাষী অধ্যুষিত ভোটের সিংহভাগ ঝুলিতে পড়বে ভাবলে তাতেও জয়ের দিকেই এগোচ্ছে তৃণমূল।

বস্তুত, বুধবার বিকেলে মোর্চার ফেরার নেতা বিমল গুরুং কলকাতায় রোশন গিরি সহ আত্মপ্রকাশ করার পরেই পাহাড়ের ভোটচিত্র বদলেছে। সঙ্গে পাহাড় লাগোয়া তরাই ও ডুয়ার্সের বিস্তীর্ণ এলাকার ভোটের গ্রাফেও তৃণমূল ফের অ্যাডভান্টেজ-এ পৌঁছে গিয়েছে। যে হিসেবটা এক সপ্তাহ আগে শিলিগুড়ির হিলকার্ট রোডের হোটেলে বসে কষেছিলেন অভিষেক-পিকে জুটি। সেটাই মিলিয়ে দিলেন বিমল গুরুং।
সমতলের আসনগুলি হল, শিলিগুড়ি, মাটিগাড়া-নকশালবাড়ি, ফাঁসিদেওয়া, ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ি, মালবাজার, নাগরকাটা, কালচিনি, বীরপাড়া-বানারহাট, মাদারিহাট, ফালাকাটা, আলিপুরদুয়ার, কুমারগ্রাম ও জলপাইগুড়ি। মনে রাখা দরকার, ২০১১ সালে ওই আসনগুলিতে মোর্চা সমর্থন করায় তৃণমূলের পক্ষে লড়াইটা সহজ হয়ে গিয়েছিল। এবারও নেপালি ভাষীদের মধ্যে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার কট্টরপন্থীরা নিশ্চয়ই সমতলের ওই আসনগুলিতে তৃণমূলের দিকেই ঝুঁকবে। সেটার দায়টা যে গুরুংপন্থীরা নেবেন তা বিমল-রোশন বুঝিয়ে দিয়েছেন। এমনকী, বৃহস্পতিবার বিমল-রোশন তাঁর তরাই-ডুয়ার্সের অনুগামীদের বার্তা দিয়েছেন, পুজোর পরেই এলাকায় ফের প্রচারে নেমে পড়তে হবে।

কিন্তু, প্রায় তিন বছর ফেরার গুরুং-গিরি জুটি বলবেন আর পাহাড়-তরাই-ডুয়ার্সের নেপালি ভাষীরা দুহাত তুলে তৃণমূলকে ভোট দেবে তা কী হতে পারে! গুরুংয়ের হাতে কি জাদুকাঠি আছে!! ঘটনা হল, দার্জিলিং পাহাড়ে গুরুংপন্থীরাই যে এখনও প্রধান শক্তি তা গত লোকসভা ভোট ও বিধানসভার উপনির্বাচনেই স্পষ্ট হয়েছে। ফলে, পাহাড়ের তিন আসন নিয়ে কোনও চিন্তার অবকাশ গুরুংদের কাছে নেই। সমতলের তরাই-ডুয়ার্সের বিস্তীর্ণ নেপালী অধ্যুষিত এলাকায় বিনয় তামাং, অনীত থাপাদের কোনও জনপ্রিয়তা নেই। সেখানে এখনও গুরুংই শেষ কথা। যেমন শিলিগুড়ির নেপালী ভাষীদের কথাই ধরা যাক। প্রধাননগরের গুরুংবস্তির বাসিন্দা সূরজ থাপা, সরিতা রাই, সরজু শর্মারা জানান, রক্তারক্তি, হিংসা ছেড়ে বিমল গুরুংরা ফের রাজনীতির মূলস্রোতে ফেরায় তাঁরা খুশি। জিটিএ-এর চেয়ে উন্নততর কোনও স্বশাসনের রাস্তা আগামী দিনে খুলতে পারে বলে তাঁদের ধারণা। সেজন্যই তাঁরা যে গুরুংয়ের সঙ্গেই থাকবেন সেটাও জানিয়ে দিয়েছেন।

মালবাজারের চা বলয়ের বাসিন্দা কেশব লামা, ধর্মরাজ রাই অথবা নাগরাকাটার সুখমন তামাং, কালচিনির দিলবাহাদুর শেরপার মতো অনেকেই জানান, তাঁরা এমন দিনটার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। দিলবাহাদুর বললেন, “২০১১ সালে বিমল গুরুং আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চুক্তির ভিত্তিতেই জিটিএ নিয়ে স্বপ্ন তৈরি হয়েছিল। তা বাস্তবায়িত হয়েছিল। কিন্তু, পাহাড়ে ফের হিংসা শুরু হলে তা নিয়ে দুজনের সম্পর্ক তিক্ত হয়ে যায়। সেই দূরত্ব কমে গুরুং-মমতা কাছাকাছি এলে পাহাড়-সমতল দু-জায়গারই লাভ। তাই আমরা গুরুংয়ের সঙ্গে থাকব।”

বাম আমলের শেষ দিকে বিমল গুরুংয়ের উত্থান। সে সময়ে তৃণমূলনেত্রী শিলিগুড়ির কাছে পিনটেল ভিলেজে সুবাস ঘিসিংয়ের পথ আগলে অনশনে বসা গুরুংদের কাছে পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে পাঠিয়ে যে মাস্টার স্ট্রোক দিয়েছিলেন তারই ফল মিলেছিল ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটে। এবার ফের বিমল গুরুংকে শান্তির পথে হাঁটার কথা খোলাখুলিভাবে বলতে বাধ্য করে সমতলের বিস্তীর্ণ এলাকার দার্জিলিংপ্রেমীদেরও মন জয়ের রাস্তা মসৃণ করলেন তৃণমূল নেত্রী।

তবে বিবৃতি, ঘরে বসে সাংবাদিক বৈঠক করলে যে আগের মতো ভোটের ফসল মিলবে না সেটা দলের নেতা-কর্মীদের স্পষ্ট করে দিয়েছেন অভিষেক-পিকে জুটি। উত্তরবঙ্গের ৫৪টি আসনের বেশিরভাগই গত লোকসভা ভোটে বিজেপির এগিয়ে থাকার বিষয়টি মাথায় রেখেই ওই জুটির অগ্রাধিকার তালিকায় এখন উত্তরবঙ্গ। তাতেই গুরুংয়ের মতো আগুন ঝরানো নেতাকেও গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে সরব না হয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেখানো পথেই হাঁটতে বাধ্য করেছে।

কারণ, গুরুং জানেন ও হাড়ে হাড়ে বোঝেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কতটা রাফ অ্যান্ড টাফ হতে পারেন! আবার প্রয়োজনে ততটাই নমনীয় হয়ে দুহাত ভরে উপহার দিয়ে ঝুলি ভরিয়ে দিতে পারেন। যা কি না উত্তরবঙ্গ তো বটেই, গোটা বাংলায় আলাদা রাজ্যের বিরোধী মনোভাবাপন্ন মানুষের কাছেও ফের মমতার কঠিন-কঠোর ও নমনীয় ভাবমূর্তিকে তুলে ধরল।

আরও পড়ুন-বিশেষজ্ঞদের আবেদন, পুজোর পুরোহিত ও সহযোগীদের কোভিড টেস্ট করুন