Saturday, November 8, 2025

আজ নাকি বাঙালিরও ‘ধনতেরাস’ ! কণাদ দাশগুপ্তর কলম

Date:

Share post:

কণাদ দাশগুপ্ত

শুনলে ‘প্রাদেশিকতা’ মনে হলে হোক …
আজ না’কি বাঙালিরও ‘ধনতেরাস’ !

কী আর করা যাবে, অন্ধ হলে তো প্রলয় আর বন্ধ থাকেনা।

বাস্তব এটাই, বাঙালির কালীপুজো এখন পড়তির দিকে। উত্তর ও পশ্চিম ভারতের ধনতেরাস এই বাংলাতেই এখন চাগিয়ে উঠেছে।

এমন হতেই পারে, ভবিষ্যতে বাঙালির কালীপুজো আরও ম্লান হয়ে যাবে। সত্যি সত্যি সেদিন দেবী কালী ও কালীপুজো রিক্ত, নিঃস্ব হবে। বাঙালির মতোই। বাঙালির কালী দশ গোল খাচ্ছে ভেবে এখন আর ঠোঁট ফুলিয়ে বসে থাকার কোনও মানে হয় না। যে কোনও বিষয়ে সফল হতে, প্রথমেই লাগে উদ্যম। উদ্যম ছাড়া দীর্ঘদিন টিঁকে থাকা অসম্ভব। বাঙালিকে মা কালী কোনওদিন বেপরোয়া বা উদ্যমী হতে শেখাননি। এখনকার যে বাঙালি ভিনদেশে বা ভিনরাজ্যে গিয়ে কর্মক্ষেত্রে উন্নতি করছেন, তাঁদের আর শনি-মঙ্গলে সাবেকি কালীঘাট- দক্ষিণেশ্বর ছুঁয়ে আসা এবং ডাইনে আনতে বাঁয়ে না কুলোনো সংসার জীবন কাটাতে হচ্ছে না। তেমন কাটাতে চান না তাঁরাও। তেমন কাটানোর জন্য তারা বাংলা ছেড়ে ভিনরাজ্যে যাননি !

স্বাচ্ছন্দ্য ও সফলতার অন্য ছবি নব্য-বাঙালি দেখে ফেলেছে। এরা নতুন মডেলের ‘সফল’ বাঙালি। তাঁরা বুঝে ফেলেছে, শুধুই কালীমন্দির বা কালীমূর্তি দিয়ে সব স্বপ্ন পূরণ হওয়ার নয়। আর ঠিক এই ফাঁক দিয়েই মধ্যবিত্ত বাঙালির হেঁসেলেও ঢুকে পড়ছেন আর এক দেবী, তিনি কালী নন, লক্ষ্মী। ধনলক্ষ্মী। উত্তর ও পশ্চিম ভারতে এই ধনলক্ষ্মী পুজো পেয়ে থাকেন। শুক্লপক্ষের ত্রয়োদশীতে তাঁর পুজো।

ধনলক্ষ্মীকে নিয়ে যথারীতি প্রয়োজনমাফিক পৌরাণিক গল্পও আছে বা ছিলো। এক রাজার ছেলেকে নাকি কোনও একদিন সর্পবেশী যম সংহার করতে এসেছিলেন। পারলেন না। সেই দিন শুক্লপক্ষের কালরাত্রিতে লক্ষ্মীপুজো হচ্ছিল। সোনার মুদ্রার ওপর বসে সর্পবেশী যমের রাত্রি কেটে গেল। সমৃদ্ধিতে চোখ গেলো ঝলসে। রাজপুত্রকে আর দংশন করা হল না। এই গল্প ‘প্রাণরক্ষাকারী’ সমৃদ্ধির। ফলে শুক্লপক্ষে ধনলক্ষ্মীর পুজো জনপ্রিয় হয়ে উঠল।

বাঙালির কোজাগরী লক্ষ্মীর সঙ্গে এই ধনলক্ষ্মীর চরিত্রের পার্থক্য আছে। লক্ষ্মীর যে সহজ শ্রী ও পারিপাট্য থাকে তার থেকে ধনলক্ষ্মী আলাদা। চাল- কলা- পিটুলি দিয়ে এই দেবীর পুজো হয় না। এই দেবীর আরাধনার জন্য সোনা কিনতেই হয়।

এইবার আবেগ সরিয়ে বাস্তবে আসুন।

যে দেবীর পুজোর সঙ্গে সোনা বেচা- কেনার সম্পর্ক, সেই দেবীর পুজোয় বাজার- অর্থনীতির প্রবেশ তো করবেই। সেটাই হচ্ছে। ফলে শুক্লপক্ষের ত্রয়োদশীর এই অন্যরকম লক্ষ্মীপুজোয় বাজার- অর্থনীতি ঢুকে পড়েছে। ধর্মাচরন করে পুণ্য হবে কিনা, তা নির্ভর করছে কতখানি স্বণালঙ্কার কিনছেন, তার উপরে।

এইখানেই হেরে গেলেন বাঙালির অতি পুরাতন মাতা কালী। কালীপুজোয় তো আর সোনার গয়না পরা গৃহবধূর ছবির বিজ্ঞাপন দেওয়া যায় না। ‘ধনতেরাস’-এ যায়।
ত্রয়োদশী ভেঙে ‘তেরাস’ হয়েছে। আর সেই সব হায়া-হীন বাঙালি “তেরাস”- টাই দিব্যি উচ্চারন করছে, নিজের সংস্কৃতির পিছনে বংশদণ্ড গুঁজে।

আরও পড়ুন : কালীপুজোর রাতে নিয়মের কড়াকড়ি দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী মন্দিরে

এই মানসিকতার শ্রীবৃদ্ধিতেই বাঙালি কালীপুজোর মহিমা ফাটা বাঁশে আটকে গিয়েছে। স্বর্ণালঙ্কারের বিজ্ঞাপনে বাজার ছেয়েছে, সংবাদমাধ্যমের বাণিজ্য হচ্ছে৷ এই উৎসব পালনের ক্ষেত্রে যে চিহ্নগুলিকে প্রাধান্য দেওয়া হয় তার সঙ্গে সাবেকি বাঙালি জীবনের কোনও যোগ নেই।কোনও কালেই ছিলোনা। তাই, কালীপুজো পড়তি, ধনতেরাস উঠতি।

বাঙালির কালী হেরে যাচ্ছে ভেবে এখন কান্নাকাটি করার মানে হয় না। এখনও কালীপুজোর সমারোহ খানিক আছে, কালীপুজোর হাত ধরে এখনও পর্যন্ত ‘ধনতেরাস’ আসে। হতেই পারে, একদিন আসবে, যেদিন কালীমন্দির বা কালীমণ্ডপের পাশেই ধনলক্ষ্মী-মাতার মন্দির হবে, বারোয়ারি পুজোটুজোও হবে। এমনও হতে পারে, ধনলক্ষ্মী-মাতা আবাহনের চোখধাঁধানো আয়োজন দেখে লজ্জায় মুখ লুকাবে বাঙালির কালী।

আরও পড়ুন : তৈরি করতে হবে নির্ভুল ভোটার তালিকা, নির্দেশ নির্বাচন কমিশনের

এমনও হতে পারে, ভবিষ্যতে বাঙালির কালীপুজো আরও ম্লান হয়ে গেল। সত্যি সত্যি তখন কালীপুজো রিক্ত, নিঃস্ব হবে। বাঙালির মতোই। নিজের সংস্কৃতি বজায় রেখে অর্থনৈতিক ভিত্তিটা পোক্ত না করলে বাঙালির মতো, বাঙালির কালীপুজোর ঐতিহ্যও বিলীন হবেই হবে। ধনতেরাসের ভিত্তি যে এই বঙ্গেও এতখানি দৃঢ় হবে, এ কথা বাঙালি ভাবেনি। ভাবেনি বলেই বাঙালির কালী ক্রমশ ধনতেরাসে ঢাকা পড়ছে। আর এটাই বাস্তব।

তবে এখন ভেবে আর লাভ নেই।
এয়োদশী আর নয়,

এখন “হোক-তেরাস”…..

spot_img

Related articles

জন্মদিনে চরম অসৌজন্য! অভিষেককে নিয়ে বিজেপির পোস্টে সরব নেটদুনিয়া

বাংলায় বরাবর সৌজন্যের রাজনীতি দেখিয়ে এসেছে সব রাজনৈতিক দল। বাম আমলে সিপিআইএম নেতা থেকে তৃণমূল বা কংগ্রেস নেতাদের...

আইএসএল নিয়ে প্রবল অনিশ্চয়তা, অনুশীলনই বন্ধ রাখল মোহনবাগান

অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে মোহনবাগানের(Mohun Bagan) সিনিয়র দলের অনুশীলন। খবর অনুযায়ী, আইএসএল নিয়ে প্রবল অনিশ্চয়তা। টেন্ডার সংক্রান্ত বিষয়...

জন্মদিনে মানুষের ভালবাসা মনে করিয়ে দেয় কর্তব্য: ভিড়ে মিশে গেলেন অভিষেক

সকাল হওয়ার অপেক্ষা নয়। রাত ১২টা বাজার অপেক্ষায় ছিল বাংলার বিপুল জনতা। জননেতা, তৃণমূল সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক...

ফলপ্রকাশ SSC একাদশ-দ্বাদশের: ডিসেম্বরের মধ্যে নিয়োগ বাস্তবায়নের পদক্ষেপ, দাবি ব্রাত্যর

বাংলায় কর্মসংস্থানে সদা সচেষ্ট প্রশাসন ও প্রশাসনের সব দফতর। ফের একবার তার প্রমাণ মিলল নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই এসএসসি-র...