Friday, December 19, 2025

বঙ্গে বাম-উল্লাস নেহাতই স্ট্যাণ্ড-আপ কমেডি, কণাদ দাশগুপ্তর কলম

Date:

Share post:

কণাদ দাশগুপ্ত

পাশের বাড়ির ছেলের চাকরি হয়েছে শুনে নিজের বাড়িতে ৩ কেজি খাসির মাংস চাপিয়েছে আলিমুদ্দিন৷ বন্ধুভাগ্যে পুত্র লাভের ঠেলাতেই এমন উৎসব?

বিহার ভোটের ফলপ্রকাশের পর
সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরির মন্তব্য, “বামেদের বাতিল বলে ধরে নেওয়ার দিন শেষ”৷ বিহার ফল দেখে এ রাজ্যের বামেরা ভলগা বা হোয়াংহো নদীর জলের ছিটেয় একুশের ভোটের আগে চাগিয়ে উঠেছে৷ সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন ভাব দেখানো হচ্ছে যেন সিপিএম বাংলার শাসন ক্ষমতাই ফিরে পেয়েছে৷

****
এটা ঠিকই, বিহারে তিন বাম দল জিতেছে ১৬ আসনে৷ এই ফলাফল বাংলার ভোটে প্রভাব ফেলবে বলেও বামেদের বিশ্বাস৷ কিন্তু এই সাফল্য কতখানি নির্ভেজাল বামেদের ?
তেজস্বী যাদবের মহাজোটের শরিক হয়ে বিহার ভোটে ২৯টি আসনে প্রার্থী দিয়েছিলো তিন বামদল, সিপিআই-এমএল (লিবারেশন), সিপিআইএম এবং সিপিআই যে ১৬ কেন্দ্রে জিতেছে, সেই সব কেন্দ্রের আরজেডি বা কংগ্রেসের ভোটাররা তাহলে কোন প্রার্থীকে ভোট দিলেন? না’কি বামেরা নিশ্চিত ওই ১৬ কেন্দ্রের একটিতেও মহাজোটের অন্য শরিকদের একখানা ভোটও ছিলো না ? ১৬ জন জয়ী বামপ্রার্থী কি শুধুই বাম-ভোটে জয়ী হয়েছেন ? দুনিয়ার কোনও ভোটে এমন হতে পারে ? শরিক দলের প্রার্থীদের আরজেডি বা কংগ্রেসের ভোটাররা
যদি ভোট না দিতেন, তাহলে ওই ১৬ কেন্দ্রের ক’টিতে লালঝাণ্ডা উড়তো, তা নিয়ে আলোচনা হতেই পারে৷ তাই ইয়েচুরি বা বঙ্গ-বাম নেতাদের বা সমর্থকদের এই উল্লাসে হাসি পাওয়া অস্বাভাবিক নয়৷ এর অর্থ কখনই এমন নয় যে জয়ী প্রার্থীদের এই জয়কে খাটো করা হচ্ছে, শুধু বোঝানো হচ্ছে, এই জয়ের কারিগর শুধুই বামেরা, এমন ভাবনা অবাস্তব, আবেগতাড়িত এবং হাস্যকর৷ এবং এই জয়ের কারণে বাংলায় বামেদের পালে হাওয়া লাগবে, এমন ধারনাও অপরিনত৷
এবারের বিহার-ভোটে বিরোধী শিবিরের ‘আইকন’ নিঃসন্দেহে তেজস্বী যাদব৷ নেতৃত্ব কীভাবে দিতে হয়, তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধিরা কীভাবে রাজ্যবাসীর ভরসার প্রতীক হতে পারেন, তা এবার শিখিয়েছেন তেজস্বী৷ কে কতখানি শিখলেন, তা অবশ্য বোঝা যাবে আগামীদিনে৷
মসনদ দখল করতে না পারলেও বিহারজুড়ে এবার তীব্র ছিলো তেজস্বী-হাওয়া৷ সেই হাওয়া ঝড় হয়ে প্রায় উড়িয়েই দিয়েছিলো এনডিএ-জোটকে, বলা ভালো, মোদি-নীতীশের ‘ডবল-ইঞ্জিন’-কে৷ আর সেই হাওয়ায় ডানা মেলে দেওয়ার সুযোগ মিলেছিলো বলেই বামেদের হাতে ১৬ আসন গিয়েছে৷ যদি মহাজোটের শরিক না হয়ে, নিজেদের কেন্দ্রে এনডিএ এবং মহাজোটের প্রাথীদের বিরুদ্ধে লড়তে হতো ওই ১৬ জয়ী প্রার্থীকে, এবং দুই জোটকে হারিয়ে যদি বামেরা জিততেন, তাহলে নিশ্চিতভাবেই বামেদের কৃতিত্ব পুরোটাই ছিলো৷ কিন্তু তেমন হয়নি৷ তাছাড়া বোঝাই যাচ্ছে না, সিপিএম এতো লাফাচ্ছে কেন ? ওই ১৬টার মধ্যে ১২টাই তো সিপিআই (এম- এল) লিবারেশনের! সিপিএম তো ২ টো আসন পেয়েছে! গোটা বিহারে মাত্র ২জন বিধায়ক যে দলের, সেই দলের এমন সব উল্লাস বা হুংকার অনেকটা স্ট্যাণ্ড-আপ কমেডির মতোই লাগছে৷

****
লিবারেশন দলটি তো কোনওকালেই সিপিএমকে দু’চক্ষে দেখতে পারেনা৷ আবার আলিমুদ্দিনও সহ্য করেনা লিবারেশনকে৷ যদিও ঠেকায় পড়ে
বামফ্রন্টের বাইরে থাকা যে ১৭টি বামপন্থী দলের সঙ্গে ফ্রন্টের কর্মসূচি ভিত্তিক বোঝাপড়া হয়েছিল, তাঁর মধ্যে এই লিবারেশনকেও রাখা হয়েছিলো৷ সিপিএম ইদানিং অনেক কিছুই ভুলে যাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে৷ নিজেদের তৈরি করা যে সব কীর্তি বা কথায় আলিমুদ্দিন প্রমাদ গোনে, তা এখন সিপিএমের মনেই আসেনা৷ সিপিআই (এম-এল) লিবারেশন অথবা এই দলের সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বছরের পর বছর ধরে সিপিএম সম্পর্কে ঠিক কী কী বলেছিলেন, কী পরামর্শ দিয়েছেন, একুশের ভোটের আগে তা মানতে কি তৈরি আলিমুদ্দিন ? না’কি, সেসব এখন আর মনেই নেই ?
২০১৬-র বিধানসভা ভোটের পর দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলেছিলেন অনেক কথাই, তার দু’একটা লাইন তুলে ধরতেই হচ্ছে :
( ১) ভাবের ঘরে চুরি নয়, কংগ্রেসের সাথে জোটের জট ছেড়ে গণ- অান্দোলনের মেঠো পথে এগিয়ে চলুক স্বাধীন সংগ্রামী বামপন্থা৷

( ২) গ্রামাঞ্চলে কৃষক জনগণ ও খেটেখাওয়া নিম্নবিত্ত মানুষের ব্যাপক অংশ এখনও সিপিএম সম্পর্কে অত্যন্ত বিরক্ত ও বিক্ষুব্ধ এবং তৃণমূল সম্পর্কে যথেষ্ট মোহাচ্ছন্ন।
( ৩) পশ্চিমবাংলায় বুদ্ধবাবুর নেতৃত্বে সিপিএম “শিল্প অামাদের ভবিষ্যৎ” বলে পুলিশ নামিয়ে বহুফসলি জমি অধিগ্রহণে নেমে পড়লো৷ চললো যৌথ বাহিনী নামিয়ে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। ২০০৬ সালে বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পর এভাবেই একদিকে ক্ষমতার ঔদ্ধত্য ও অন্যদিকে জাতীয় এবং অান্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমের হাততালিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে পশ্চিমবাংলার ‘ব্র্যান্ড বুদ্ধ’ শিল্পায়নের উন্মাদনায় ২০০৬ থেকে ২০১১ সালের মধ্যেই পশ্চিমবাংলায় ক্ষমতা থেকে অপসারিত হওয়ার পটভূমি রচনা করেছিল সিপিএম। অথচ সিপিএমের বঙ্গীয় নেতৃত্বের এক বড় অংশ এই দিবাসত্যকে তখনও স্বীকার করেননি, অার অাজও মানতে নারাজ।
( ৪) বামপন্থী ঐক্যকে শিকেয় তুলে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট গড়ে তোলা হল।বামপন্থী কর্মী ও জনগণের উপর নেতৃত্বের এত বড় অনাস্থার উদাহরণ কি অাগে অামরা দেখেছি?
( ৫) জোটের নির্বাচনী ফলাফলের সমীক্ষা করতে গিয়ে এখন সিপিএমের কেউ কেউ বলছেন জোটের ব্যাপারটা জনগণকে ঠিক বোঝানো যায়নি। কী অদ্ভুত কথা। নির্বাচনের অাগে বলা হল জনগণের দাবিতে, জনগণের চাপে জোট, অার নির্বাচনের পরে বলা হচ্ছে জনগণকে বোঝানো গেল না! এত ফাঁপা বিশ্লেষণের উপর দাঁড়িয়ে বামপন্থী রাজনীতি কখনও পরিচালিত হতে পারে?
( ৬) সাম্প্রতিক অতীতের বড় বড় ভুলভ্রান্তি ও বিশ্বাসঘাতকতার জন্য অান্তরিকভাবে অাত্মসমালোচনা না করলে গণতন্ত্রের প্রশ্নে সিপিএমের পক্ষে বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরে পাওয়া অসম্ভব।
পুরোনো কথা বাদ দিয়ে, বিহার-ফল প্রকাশের পর দীপঙ্কর ভট্টাচার্য কী “বিশেষ পরামর্শ” দিয়েছেন, তা একবার দেখি৷ খুব স্পষ্টভাবেই দিনদুয়েক আগে তিনি বলেছেন,
◾‌তৃণমূল নয়, এই মুহূর্তে বিজেপিকেই প্রধান প্রতিপক্ষ ধরে নিয়ে বাংলায় বামেদের এগোনো উচিত৷
◾বিহার ভোটের একটা বড় প্রভাব পড়তে পারে বাংলায়। কাকে নিশানা করা হবে,‌ তা ঠিক করতে হবে বাংলার বামেদের। তৃণমূল নয়, বামেদের প্রধান প্রতিপক্ষ হওয়া উচিত বিজেপি।
◾পশ্চিমবঙ্গের একটা সমস্যা হচ্ছে এখানে বামপন্থীরা জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে রাজ্য রাজনীতিকে দেখেন না। এখানে লড়াইটা রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ছে। যার ফলে বিজেপি সুযোগ লাভ করছে।
◾কংগ্রেস বা তৃণমূলের সঙ্গে জোট বাঁধতে সিপিএম-লিবারেশনের কোনও আপত্তি নেই৷

আলিমুদ্দিন আপাতত কংগ্রেসের সঙ্গে জোট গড়ে একুশের ভোটে যাওয়ার ব্যাপারে তৈরি৷ ফলে ধরেই নেওয়া যায় এই সব প্রশ্ন বা প্রস্তাব সিপিএম বা বামফ্রন্ট কানেই তুলবে না৷ সিপিএমের সামনে যে শুধুই ফাঁপা কিছু স্লোগান আর বিশ্লেষণ, তা বেশ ধরা যাচ্ছে৷

*****
বিহারে লিবারেশনের দুরন্ত সাফল্যে নিজেরা যুদ্ধজয়ের আনন্দ কেন পাচ্ছে সিপিএম ? বঙ্গ-বামের তো এটা ভাবা দরকার, প্রবল তেজস্বী- হাওয়া থাকা সত্ত্বেও বিহারে কার্যত ‘রিজেক্টেড’ কংগ্রেস৷ চূড়ান্ত ব্যর্থ সোনিয়া-রাহুল গান্ধীদের দল। ৭০ আসনে লড়ে কংগ্রেস প্রার্থীরা জিতেছেন মাত্র ১৯ টি আসনে। আর এই ব্যর্থতাই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং মহাজোটের মধ্যে পাঁচিল গড়ে দিয়েছে। যে হাওয়ায় বামেদের ২৯ প্রার্থীর মধ্যে ১৬ জন জেতে, সেই হাওয়াতেও কংগ্রেস ৭০ আসনে লড়ে ১৯-এ থেমেছে৷ পূর্ব ভারতেই কংগ্রেস এখন বেহাল৷ তাহলে বাংলায় কোন যুক্তিতে কংগ্রেসের কাঁধে উঠে আলিমুদ্দিন ‘চমকপ্রদ’ ফলের স্বপ্ন দেখছে ?
রাজ্য সিপিএম কি একবারও ভেবে দেখেছে, তাদের কোন কোন নেতা একুশের ভোটে মানুষের কাছে গিয়ে ভোট চাইবেন? যে নামগুলির কথা বলার জন্য সদস্য-সমর্থকরা তৈরি, মনে রাখতে হবে, ওই নামগুলিকে সেই ২০০৬-এর নির্বাচন থেকেই ভোটাররা খারিজ করছেন৷ ২০০৬- এর পর প্রতিটি ভোটে এইসব মুখগুলিকে অপছন্দ করছেন বাংলার মানুষ৷ ওদিকে দাগ কাটতে সক্ষম তরুণ প্রজন্মের এমন একজন নেতাও আজ আলিমুদ্দিনের ভাঁড়ারে নেই৷ এরপরেও সিপিএমের স্বপ্ন দেখা কতখানি মানানসই ? এবং
এতকিছুর পরেও কেন সিপিএমের ‘সীমাহীন’ আনন্দ বিহার ঘিরে ?

*****

কানহাইয়া কুমার বা তেজস্বী যাদব তো নেহাতই স্বপ্ন, এই মুহুর্তে আলিমুদ্দিনের প্রয়োজন নিদেনপক্ষে তেজপ্রতাপ-মাপের কিছু তরুণ নেতা, যারা ‘ফ্রেশ’ মুখ নিয়ে মানুষের সামনে দাঁড়াতে পারবেন৷ তা না হলে একুশের ভোটের পর সিপিএম আর বিপ্লবী বাংলা কংগ্রেসে কোনও ফারাকই থাকবে না৷

বিজয়োল্লাস থামিয়ে আলিমুদ্দিন সে দিকেই নজর দিক৷

আরও পড়ুন-দলের বিধায়কদের এক মাস পাটনা থাকতে বললেন তেজস্বী, কিন্তু কেন?

spot_img

Related articles

হিজাব বিতর্কে নয়া মোড় ,সরকারি চাকরিতে যোগ দিচ্ছেন না মহিলা চিকিৎসক!

বিহারের সরকারি অনুষ্ঠানে মহিলা চিকিত্‍সকের মুখ থেকে হিজাব টেনে নামিয়ে দিয়ে বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন সে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ...

কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো-র সংবাদপত্রের দফতরে হামলা! 

বাংলা দৈনিক প্রথম আলো-র দফতরে হামলা! বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে একদল অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি সংবাদপত্রটির দফতরে ঢুকে একাধিক তলায় ব্যাপক...

জলপাইগুড়ির আকাশে ভিনগ্রহীদের যান! রহস্যময় আলো ঘিরে বাড়ছে জল্পনা

বৃহস্পতিবার রাতের আকাশে হঠাৎ রহস্যময় আলো ঘিরে চাঞ্চল্য জলপাইগুড়ি জেলায় (Jalpaiguri District)। কেউ বলছেন উল্কা কেউ বলছেন ইউএফও...

এসআইআর প্রক্রিয়ায় নজির! প্রথমবার ভোটারকে শো-কজ কমিশনের

ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধনী (এসআইআর) প্রক্রিয়ায় এই প্রথম কোনও ভোটারকে শো-কজ নোটিশ পাঠাল নির্বাচন কমিশন। অভিযোগ, এক...