‘অপরাজেয় মাতৃভাষা’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

বাংলায় শিখে বাংলায় লিখে

বাংলায় গান গেয়ে

বাংলায় মরি বাংলায় বাঁচি
বাংলার নুন খেয়ে ।

তোমার বাংলা আমারও বাংলা
সকলেরই অধিকার
ভাষার অস্ত্রে ভেঙে ফেলো বেড়া
ছিঁড়ে ফেলো কাঁটাতার ।

কতগুলো প্রাণ বলিদান হলে
মাতৃভাষাটি বাঁচে
ভাষাকে বাঁচিয়ে ইতিহাস গড়া
বাঙালির জানা আছে ।।

ভাষার জিভে লাগাম পরাতে চাও কারা হে তোমরা মাতব্বর ! কত লোক আছে তোমাদের দলে ? কত অস্ত্র , কত শক্তি তোমাদের ? ভালো চাও তো যাও ফিরে যাও সংখ্যাগরিষ্ঠ আস্ফালনের খোঁয়াড়ে । মগজে শান দিয়ে ইতিহাস ঘাঁটো । পড়ো দুনিয়ার দেশে দেশে বিপন্ন ভাষাসমূহের অস্তিত্ব রক্ষার মরণপণ সংগ্রামের রক্তঝরা ইতিবৃত্ত । প্রতিটি অধ্যায় ঘেঁটে দেখে নাও প্রতিটি লড়াইয়ে কারা জয়ী ।

মানুষ যে ভাষায় স্বপ্ন দেখে সেই ভাষাই তার মাতৃভাষা । যে ভাষায় সে প্রথমবার ‘ মা ‘ ব’লে ডাকে সেই ভাষাই তার মাতৃভাষা । যে ভাষায় আধো আধো বুলি আউড়ে একটি শিশুর জিভের জড়তা কাটতে থাকে সেটিই তার মাতৃভাষা । এই ভাষাতেই শিশুটি চিৎকার করে , আদর জানায় , হাসে ও কাঁদে । এই ভাষাতেই মানুষ প্রেম নিবেদন করে , প্রতিবাদ জানায় , বিদ্রোহ করে , ধিক্কার জানায় , আবেগ প্রকাশ করে , কবিতা লেখে , গান গায় । সেই প্রাণের ভাষা , আনন্দ-বেদনার ভাষা , স্বপ্ন ও জাগরণের ভাষা আক্রান্ত অথবা বিপন্ন হলে যে কোনো ভাষা-সম্প্রদায়ের তথা জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বই যেন টলমল করতে থাকে । ভাষা তো নাড়ির টান , রক্তের টান ।

ভাষা যে মানুষের বেঁচে থাকার এক অবিচ্ছেদ্য অবলম্বন। যেন শরীরেরই একটি ভীষণ জরুরি অঙ্গ । সেই ভাষার অস্তিত্ব বিপন্ন হলে কী হয় তা ইতিহাস ঘাঁটলেই জানা যায়।

ভাষা , সে ক্ষুদ্র কিংবা বৃহৎ জনগোষ্ঠীর হোক , ভাষা , সে সংখ্যাগরিষ্ঠ কিংবা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের হোক , ভাষা বিপন্ন বা আক্রান্ত হলে অসমের বরাক উপত্যকা থেকে বাংলাদেশের ঢাকা পর্যন্ত বিপুল বিক্ষোভে ও বিদ্রোহে কেঁপে ওঠে । দিকে দিকে ফুঁসে ওঠেন ভাষাপ্রেমী ও ভাষার সন্তানেরা । রাষ্ট্রের পেশিশক্তি ও সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাষাগোষ্ঠীর আগ্রাসনের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা ক’রে পথে নেমে পড়েন লাখো লাখো মানুষ , রক্ত ঝরে বিস্তর , পথে প’ড়ে থাকে মাতৃভাষাকে আঁকড়ে ধরে থাকা শহীদদের মৃতদেহগুলি ।
বেঁচে থাকে ভাষা অবিনশ্বর ।

আধিপত্যকামী ভিন্ন ভাষার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রাণপণ লড়াই করে চলে তথাকথিত সংখ্যালঘু ভাষা । ভালোবাসার ভাষাকে এইভাবে , এমনকি কখনো কখনও অসম যুদ্ধ করেই বেঁচে থাকতে হয় । নিজের ও নিজেদের প্রাণের ভাষাটি বাঁচিয়ে রাখার জন্য এই তুমুল সংগ্রাম , এমন মরণপণ লড়াই পৃথিবীর দেশে দেশে কালের পর কাল চলতেই থাকে বিরামহীন ।
ভাষা তো আর নিছকই ভাবপ্রকাশের মাধ্যমমাত্র নয় ।

যে কোনো ভাষার রয়েছে অসীম ক্ষমতা । ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কীটানুকীটের কোনো প্রজাতির বিলুপ্তি যেমন প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে বিপজ্জনক , ঠিক তেমনি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর যে কোনো জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষাও যে কোনো মূল্যে রক্ষা করতে হয় , না হলে মানবসম্পর্কের তথা বিশ্বসভ্যতার ভারসাম্যের ভিত টলে যায় । এক অর্থে যে কোনো ভাষার বিলুপ্তি মানবসভ্যতার পক্ষে বিপজ্জনক । শুধু তো মায়ের গর্ভেই নয় , মানুষ তো ভাষার গর্ভেও জন্মগ্রহণ করে , তাই ভাষাও তো ভিন্নার্থে মানবজননী । মানুষ কি ভাষার সন্তান নয় ? মা-জননীর ওপর নির্যাতন হলে সন্তান কখনোও চুপ থাকতে পারে ? ভাষা কখনও জোর করে চাপিয়ে দেওয়া যায় না । তাই মাতৃভাষাকে বাঁচাতে প্রাণ দিতে প্রস্তুত থাকে ভাষার সন্তান । মনে রাখতে হবে কারোর মুখের ভাষা উৎখাত ক’রে অন্য ভাষা জোর ক’রে গুঁজে দেওয়ার মতো ভয়ঙ্কর অন্যায় আর কিছু হতে পারে না ।

পরিশেষে এটাই বলার যে কোনো ভাষাই তুচ্ছ নয় । নিজের মাতৃভাষায় কথা বলাটা সব মানুষেরই জন্মগত অধিকার । সেই অধিকার কেউ কোনোভাবেই কেড়ে নিতে পারে না । সেই অর্থে কোনো ভাষাই সংখ্যালঘু নয় । সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাষাগোষ্ঠীর আগ্ৰাসনে তথাকথিত সংখ্যালঘু ভাষাগুলো বিপন্ন , নিপীড়িত অথবা বিলুপ্ত হয়ে যাবে এটা কখনোই কাম্য নয় । সমস্ত ভাষাই স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে ও স্বতন্ত্র মর্যাদায় সমবেতভাবে মানবসভ্যতার জয়গানে মুখরিত হয়ে উঠুক ।

প্রাণের উচ্ছ্বাসে উচ্চারিত ও উদ্ভাসিত হোক সকলের প্রাণের মাতৃভাষা ।

আরও পড়ুন- “বিধবা রক্ষি*তার সঙ্গে ফুর্তি! সাংসদ স্বামীকে নিয়ে বি*স্ফোরক সুজাতা