Friday, August 22, 2025

‘মানা কি কুছ নহীঁ গালিব’, উৎপল সিনহার কলম

Date:

Share post:

উৎপল সিনহা

হম ভি গুস্তাকি করেঙ্গে
জিন্দেগী মে এক বার
ইয়ার তো পয়দল চলেঙ্গে
হম জনাজে পর সওয়ার ।
ঔদ্ধত্য আমিও দেখাবো জীবনে একবার
বন্ধুরা সবাই হাঁটবে
আমি তাদের কাঁধে
হবো সওয়ার ।

হজারোঁ খ্বাহিশেঁ এয়সী কে হর খ্বাহিশ পে দম নিকলে
বহুত নিকলে মেরে অরমান
লেকিন ফিরভি কম নিকলে ।

এইসব শব্দের ধমনী ছেঁড়া অনর্গল রক্তপাত নিয়েই জীবন কাটিয়ে গেছেন আমাদের প্রিয় মির্জা গালিব ।
‘ গালিব ‘ শব্দের অনেক অর্থ । তারমধ্যে একটি হলো ‘ বিজয়ী ‘। শব্দটি ইসলামী , কিন্তু এসেছে ফারসি থেকে ।

মির্জা আসাদুল্লাহ খান গালিব । ১৭৯৭ সালে আগ্রায় জন্মগ্রহণ করেন । ১৮১৩ সালে গালিব স্হায়ীভাবে দিল্লি চলে যান । তারপর দিল্লিতেই কাটান বাকি জীবন । নিজের বাড়ি কোনোদিন হয় নি তাঁর । ভাড়াটে হয়েই কেটেছে জীবন । গালিবের কালজয়ী শেরগুলির বিস্তারে যাওয়ার আগে তাঁর সমকালটি দেখে নেওয়া অতি আবশ্যক ।

তখন মোগল-মারাঠা-ইংরেজ—এই ত্রয়ী শক্তির মধ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের ভয়ঙ্কর লড়াই চলছে । একদিকে মোগল সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ার আওয়াজ , অন্যদিকে নতুন ইংরাজ সভ্যতার পদধ্বনি । কোন্ দিকে যাবেন গালিব ? দুদিকেই তাঁর টান । তাই বুঝি তাঁর কবিতায় একদিকে ভাঙনের , পোড়ো ঘরদোর ভাঙচুরের আয়োজন । ধুধু শূন্যতা । আবার অন্যদিকে তিনি টের পাচ্ছেন নতুন দিনের আগমনবার্তা । এই দোটানার কিনারায় দাঁড়িয়ে তাঁর কবিতার আধুনিক রূপধারন । তাঁর কবিতা , এক কথায় , ধ্বস্ত নষ্ট ভঙ্গুরের শোকগাথা।
নহ্ গিলে নগমা হুঁ নহ্ পরদেসাজ্
ম্যায় হুঁ অপনি
শিকস্ত কী আওয়াজ ।
সুরের পর্দা নই কিছুতেই
নই তো গীতের সার
আমি শুধুই শব্দ
নিজের ভেঙে যাবার ।

ইতিহাসের আশ্চর্য পালাবদল স্বচক্ষে দেখেছেন গালিব । যুগ সন্ধিক্ষণের এই স্পর্শে কবির অবস্থা তখন ওইসব পোড়ার মধ্যে একা বাতির মতো চুপচাপ । গালিব ছিলেন গুরুহীন । ছিলেন স্বশিক্ষিত । তবে অগ্রজদের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ছিল অসীম । লিখতেন অধিকাংশই ফারসিতে । তাঁর সমালোচকেরা চাইতেন গালিব লিখুন সহজ সরল ভাষায় সকলের জন্য । কিন্তু গালিব শব্দ নির্বাচনে ছিলেন দুর্গমতার পক্ষপাতী । তিনি ভাবতেন পাঠক হবেন দীক্ষিত । ভাবতেন সব উৎকৃষ্ট সকলের জন্য নয় । সুগন্ধি ফুল যেমন নামগোত্রহীন স্থানে ফুটলেও প্রকৃত রসিক তাকে ঠিকই খুঁজে নেয় , ঠিক তেমনি প্রকৃত পাঠকেরা কালজয়ী কবিতা ঠিকই খুঁজে নেবেন । তারজন্য অহেতুক আটপৌরে ও বহু ব্যবহারে জীর্ণ শব্দগুলি টেনে এনে কবিতার মর্মবস্তু নষ্ট হতে দেওয়া যায় না । এই আপসহীনতাই তাঁর শেরগুলিকে কালোত্তীর্ণ করেছে । গালিব জানতেন তিনি তাঁর সমকাল থেকে অনেকটাই এগিয়ে রয়েছেন । তিনি জানতেন যে তিনি লিখছেন আগামীর জন্য ।

হুঁ গরমিয়ে নিশাৎ-এ
তসৌঅর নগমা সনজ
ম্যায়ঁ আন্দলিব্-এ গুলশন-এ
না আফরিদা হুঁ ।
কল্পনার এই খুশির তাপে
গেয়ে চলেছি গান
যে কাননের পাখি আমি অজাত আজও সেই বাগান ।

১৮৫৭ সাল । সিপাহী বিদ্রোহ । দিল্লি ভাঙছে । মোগল আমলের পতনচিহ্ন ক্রমশ পরিস্ফুট হচ্ছে । তিনি ডায়েরী লিখছেন তখন । ভীষণ অন্ধকার দিনকাল । ঘোর দুঃসময় । এমন দিনে তাঁর পাগল ভাই ইউসুফ মারা যায় । রাতের আঁধারে গোর-কাফনে তাকে আরও গভীর অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিতে পথে বেরোন গালিব ।এমন বিপন্ন সময়েও এই আশ্চর্য কবির অন্তরের রহস্যরসিকতা যেন যেতে চায় না । দিশি মদ তাঁর মুখে রোচে না । তাঁর চাই বিলিতি । চাই কোরা কাগজ ও লেখার সৌখিন সরঞ্জাম । দাম খুব চড়া হলে তবেই বাধ্য হয়ে কখনোসখনো দিশি ছোঁয়া । কে যেন একবার বললো , যে মদ খায় তার প্রার্থনা আল্লা শোনেন না । গালিব হেসে জবাব দেন , ভাই , যার মদ আছে সে আবার কীসের জন্য প্রার্থনা করবে ?

নগমা হ্যায় গমকোভি এ্যয়
দিল গনীমৎ জানিয়ে
বে সদা হো যায়েগা
ইয়ে সাজে হসতি একদিন ।
দুঃখনিঃসৃত গানে ধন্য
থেকো মন
অস্তির বাজনা হবে
একদা নীরব ।

দাগে ফেরাকে সোহবতে
শব কী জ্বলি হুয়ি
এক শমা রহ্ গয়ি হ্যায় তো
উয়ো ভি খামোশ হ্যায় ।
বিরহরাতের স্পর্শে
পুড়েছে অনেক
তার অবশিষ্ট বাতি
সেও চুপচাপ ।
কবিদের কবি সম্ভ্রান্ত ও অভিজাত গালিবের কবিতার
মূল অন্তর্বস্তু কিন্তু শিরা ছেঁড়া রক্তপাত ।

গালিবের সাত সন্তান একের পর এক মারা যায় । নিজের সন্তান বাঁচছে না দেখে ভাগ্নে মীরজা জয়নুল আবেদিনকে পোষ্য নেন । সে ছিল কবির খুব প্রিয় । সেও কবিতা লিখতো । কিন্তু সেও তরুণ বয়সেই মারা যায় । তার অকাল মৃত্যুতে গালিব যে শোকগাথা লেখেন তা উর্দু কাব্যের অন্যতম সেরা শোককবিতা । ধ্রুপদী সংযম , অসামান্য পরিমিতিবোধ এবং শোকদুঃখকে হেলায় উড়িয়ে দিতে গিয়ে তাকে আরও তীব্র ও মর্মস্পর্শী করে তোলা ছিল এই মরমী কবির অতি লক্ষনীয় বৈশিষ্ট ।
লাজিম থা কে দেখো মেরা রাস্তা কোইদিন অওর
তনহা গয়ে হো অব রহো তনহা কয়ী দিন অওর ।
তোমার উচিত ছিল আরও কিছুদিন আমার জন্য
অপেক্ষা করা
এখন যখন একা আছো
কিছুদিন একাই থাকো ।

ব্যক্তিগত , সামাজিক ও সাংসারিক দুর্বিপাক কবিকে কখনোই কাবু করতে পারে নি । তিনি থাকতেন হাসি ও কৌতুকে সদা ঝলমল । আত্মপীড়নেও হেসে উঠেছেন । কবিতায় এঁকেছেন রহস্যরসে ভরা অনাবিল সৌন্দর্য । নিজেকে নিয়েও নিষ্ঠুর ব্যঙ্গ বিদ্রুপে মেতে উঠতেন সততই ।
মাত্র ২৩৪ টি গীতিকবিতা সম্বল করে উর্দু কাব্যের অধীশ্বর হয়ে রইলেন গালিব ।

নাদান হো যো কহতে হো
কিউঁ জিতে হো গালিব
মুঝকো তো হ্যায়
মরনে কি তমান্না
কোই দিন অওর ।

মৃত্যুর বাসনা নিয়ে আরো কটা দিন বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষাই গালিবের লেখার প্রেরণা ।
পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি মিথ্যা বলা হয় ধর্মগ্রন্থ ছুঁয়ে আদালতে । আর সবচেয়ে বেশি সত্য বলা হয় মদ ছুঁয়ে পানশালায় । এই ছিল গালিবের চরম ও পরম উপলব্ধি । আরও লিখলেন :
জীবন বড়োই বিচিত্র । সন্ধ্যা কাটতে চায় না , অথচ দিব্যি কেটে যাচ্ছে বছর । সন্ধ্যা কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা সেই পাখিকে জিজ্ঞাসা করো যার কোনো ঘর নেই ।

জিন্দেগী ইউঁ ভি গুজর
হি যাতি
কিউঁ তেরা রাহ্ গুজর
ইয়াদ আয়া?
তোমার পথের কথা মনে না পড়লেও জীবন যখন সহজেই কেটে যাচ্ছিল তখন কেনই বা ওসব মনে পড়া ?

কতা কিজিয়ে নহ্ তঅল্লুক হমসে
কুছ নহীঁ হ্যায় তো
অদাবৎ হি সহী ।
সব সম্পর্ক ছিন্ন কোরো না
আর যদি কিছু না থাকে
শত্রুতাই থাক ।
হ্যায় আদমি বজায়ে খুদ
এক মেহশরে খয়াল
হম আঞ্জুমান সমঝতে হ্যায়
খেলওয়াৎ হি কিউঁ না হো ।
মানুষ নিজেই সহায়হীন
ভাবনার এক প্রচন্ড ভীড়
একলা হয়ে রইলে বসে
সম্মেলনে থেকেও ।
মানুষ একা কাঁদে , সংঘে কি কাঁদে না ? এই প্রশ্ন রেখে গেছেন আমাদের বাংলা কাব্যের শক্তি কবি । তিনি যে তাঁর বন্ধু আয়ান রশীদের সঙ্গে জুটি বেঁধে গালিবের কবিতা বাংলায় অনুবাদ করে গেছেন ।
নিজের সময় থেকে অনেকটা এগিয়ে থাকা গালিব ধর্মগ্রন্থের অসারতা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন বলেই লিখে গেছেন : মানুষ যদি হতে চাও তাহলে চিকিৎসা বিদ্যা , জ্যোতির্বিজ্ঞান , পদার্থবিদ্যা , তর্ক ও দর্শনশাস্ত্র পড়ো ।

দর্শন গালিব জানতেন কবিতার পরিবর্ত নয় , তবুও বড়ো কবিতা সবসময় ভাবনার খোরাক জোগায় মানতেন । তাঁর নিজের আজব মনটা সবসময় নিজেকে প্রশ্ন করে বেড়াতো । যদিও বিশেষ কোনো তত্ত্ব , চিন্তাধারা কিংবা নির্দিষ্ট কোনো দার্শনিক ভাবধারায় ‌তিনি জব্দ ছিলেন না , তবুও তাঁর কবিতা কখনো ‌কখনো দর্শনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে মানুষকে গভীর চিন্তার খোরাক জোগায় । আজীবন দুঃখী ও বিরহীদের পক্ষে থাকা এই মানবিক কবির প্রেমতৃষ্ণা জীবনের শেষপ্রান্তে উপনীত হয়েও ফুরোয় নি ।

ইশক্ সে তবিয়ৎ নে জিস্ত
কা মজা পায়া
দর্দকা দাওয়া পায়ি
দর্দে লাদওয়া পায়া ।
প্রেম থেকে পাই বাঁচার মজা
সেই মজা সব ব্যথার ওষুধ
প্রেমটি নিজেই এমন ব্যথা
তার কখনো হয় না ওষুধ ।

আরও পড়ুন- মাসল্ মেমরি, এক সাধনা, উৎপল সিনহার কলম

spot_img

Related articles

রায় বেরোনোর পরেই জয়েন্টের তালিকা প্রকাশ: বোর্ডের কৃতিত্বে আনন্দ প্রকাশ মুখ্যমন্ত্রীর

কলকাতা হাই কোর্ট ওবিসি সংক্রান্ত যে জট দীর্ঘদিন ধরে পাকিয়ে রাখার চেষ্টা করে চলেছিল, শুক্রবার তা প্রতিহত হয়...

বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রামীর পেনশনের আবেদনও খারিজ! আদালতে মুখ পুড়ল কেন্দ্রের

ইতিহাসকে বিকৃত করার বিজেপি-আরএসএসের যৌথ পরিকল্পনায় চরম দুর্দশা বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের। নরেন্দ্র মোদি মুখে বাঙালি বিপ্লবীদের নাম নিলেও...

নতুন রঙ নতুন আনন্দ: বাংলার দুর্গাপুজোকে মোদির বন্দনায় কটাক্ষ তৃণমূলের

বাংলায় পুজো করতে গেলে আদালতের অনুমতি লাগে। প্রায় প্রতিদিন ছুটে ছুটে এসব প্রচার করে বেড়াচ্ছেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা...

ইমান বেচলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী: শিখ সম্প্রদায়ের অপমানে নীরব রবনিতকে প্রশ্ন তৃণমূলের

কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রবনিত সিং বিট্টু  শিখ সম্প্রদায়ের মানুষের সম্মানকে বাংলার বিজেপি নেতাদের সামনে বিক্রি করে দিলেন। নরেন্দ্র মোদির...