Wednesday, August 27, 2025

‘অন্যতম তিমিরবিনাশী’, উৎপল সিনহার কলম

Date:

Share post:

উৎপল সিনহা

‘ … আমাদের সমালোচনা করার সময় এটুকুও ভেবো যে , কোন্ এক অন্ধকারে আমরা বেঁচেছিলাম , যে অন্ধকার থেকে তোমরা বেঁচে গেছো ‘ ।

এখন তো ভারতীয় ক্রিকেটের স্বর্ণযুগ । সারাক্ষণ ঝলমলে আলোর রোশনাই । বিশ্ব ক্রিকেটের সমীহ জাগানো শক্তি ভারত , তেমনই প্রভাবশালী । কিন্তু বিষান সিং বেদীদের সময়টা ছিল ভারতীয় ক্রিকেটের প্রায় অন্ধকার যুগ । ব্যাটিং তেমন শক্তিশালী ছিল না । ফিল্ডিং ছিল জঘন্য । আর পেস বোলিং তো দূরের কথা , মিডিয়াম পেসার বলতেও তেমন কেউ ছিলেন না । তখন অনেক ম্যাচেই বোলিং ওপেন করতে হতো স্পিনারদের । সেই দিশাহীন সময়ে বিশ্বের দরবারে ভারতীয় ক্রিকেটকে একটা সম্মানজনক প্রতিষ্ঠা দেওয়ার প্রাণপন সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন যে সমস্ত ক্রিকেটযোদ্ধা , তাঁদের একেবারে প্রথম সারিতে ছিলেন ঘূর্ণিবলের জাদুকর বিষাণ বেদী ।

গত ২৩ অক্টোবর ( ২০২৩ ) তিনি চলে গেলেন পৃথিবী ছেড়ে । বয়স হয়েছিল সাতাত্তর । জন্মেছিলেন ১৯৪৬ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর , অমৃতসরে । ধীরগতির বাঁহাতি এই অর্থোডক্স বোলার ৬৭ টেস্টে উইকেট পেয়েছেন ২৬৬ টি । ১০ টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে পেয়েছেন ৭ টি উইকেট । ২২ টি টেস্ট ম্যাচে দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন । ১৯৬০ ও ১৯৭০- এর দশকে এরাপল্লি প্রসন্ন , ভাগবত চন্দ্রশেখর ও শ্রীনিবাসন ভেঙ্কটরাঘবনকে নিয়ে বিশ্বক্রিকেটে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন স্পিন আধিপত্য । ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৯ তাঁর ক্রিকেট কেরিয়ারের সময়কাল । প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে তাঁর মোট উইকেটের সংখ্যা ১৫৬০ । ইংল্যান্ডে কাউন্টি ক্রিকেটেও তাঁর কেরিয়ার তথা সাফল্য বিস্ময়কর । ১৯৭২ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত সেখানে খেলেন নর্থহ্যাম্পটনশায়ারের হয়ে এবং ৪৩৪ টি উইকেট পান ১০২ ম্যাচে । ১৯৭৬ সালে পোর্ট অফ স্পেন-এ ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেই সিরিজের তৃতীয় টেস্টে চতুর্থ ইনিংসে রেকর্ড ৪০৬ রান তুলে স্মরণীয় জয় পায় ভারত তাঁরই নেতৃত্বে । উপমহাদেশের স্পিন বোলিংয়ের অন্যতম এই প্রাণপুরুষের হাত ধরেই স্পিন বোলিংয়ে বিপ্লব আসে ভারতের ক্রিকেটে । কিন্তু এই সমস্ত চুলচেরা পরিসংখ্যান দিয়ে বিষান সিং বেদী-র মতো ঠোঁটকাটা , আপসহীন , ডাকাবুকো ও স্পষ্টবক্তা স্পিনশিল্পীকে ধরা যাবে না । বিশ্বক্রিকেটের অন্যতম বর্ণময় ক্রিকেটার বিষান বেদী ছিলেন মানুষ হিসেবেও সিংহহৃদয় ।

শেন ওয়ার্ন থেকে অনিল কুম্বলে , সকলেই উপকৃত হয়েছেন বেদীর মূল্যবান পরামর্শে । চিরকালের বিতর্কিত বেদী ছিলেন বিশ্বক্রিকেটের অন্যতম আকর্ষণীয় চরিত্র । আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি উইকেটের মালিক মুথাইয়া মুরলিধরনকে বেদী বলেছেন ‘ বর্শাবাহক ‘ , ‘ চাকার ‘ । আবার সুনীল গাভাস্কারের তীব্র বিরোধী বলে পরিচিত এই মানুষটিকে যখন তাঁর দেখা সেরা ব্যাটসম্যানের নাম বলতে বলা হয়েছিল তখন এক মুহূর্তও না ভেবে জবাব দিয়েছিলেন , ‘ আমার দেখা সেরা ব্যাটসম্যানের নাম সুনীল গাভাস্কার ‘ ।
১৯৯০-এ কোচ হয়েছিলেন ভারতীয় ক্রিকেট দলের । সেখানেও বিতর্ক । একটি সফরে ভারত খারাপ খেলায় তিনি বলেছিলেন , ‘ গোটা দলকে সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলা উচিত ‘ ।

শুধু বিপক্ষ দল নয় , বেদীরা যখন খেলতেন তখন দেশে দেশে দেশপ্রেমী আম্পায়ারদের সঙ্গেও লড়তে হতো ক্রিকেটারদের । প্রচুর অবিচার চলতো মাঠে ও মাঠের বাইরে । মুখে বলা হতো ‘ ক্রিকেট ভদ্রলোকের খেলা ‘ , কিন্তু কার্যক্ষেত্রে প্রচুর অভদ্রতা দেখা যেতো । মাঠে চলতো নানা ধরনের চালাকি , প্রতারণা , অনিয়ম ও বেনিয়ম । বেদী নিজে ছিলেন নিপাট ভদ্রলোক , তাই মাঠে কোনো ধরনের অভদ্রতা তিনি বরদাস্ত করতেন না । তাঁর মতো সাহসী ও প্রতিবাদী ক্রিকেটার বিশ্ব-ক্রিকেটে খুব বেশি খুঁজে পাওয়া যাবে না । শাস্তির ঝুঁকি আছে , এমনকি নিজের অধিনায়কত্ব ও ক্রিকেট কেরিয়ারকে বাজি রেখেও বারবার ক্রিকেট মাঠে অন্যায়ের প্রতিবাদ করে গেছেন এই ডাকাবুকো মানুষটি ।

১৯৭৬ সালে চার পেসার নিয়ে দুরন্ত ওয়েস্ট ইন্ডিজ ভারতীয় ব্যাটারদের শরীর লক্ষ্য করে লাগাতার বাউন্সার দেওয়ায় কয়েকজন আহত হন । অতিরিক্ত বাউন্সার দেওয়ার প্রতিবাদে অধিনায়ক বেদী ৩০৬ রানে ইনিংস ডিক্লেয়ার করে দেন । দ্বিতীয় ইনিংসেও মাত্রাতিরিক্ত বাউন্সারে কয়েকজন চোট পেলে মাত্র ২ টি উইকেট হারানোর পর ইনিংস ডিক্লেয়ার করে দেন বেদী । ক্রিকেটাররা বেঁচে যান কিন্তু ভারত হেরে যায় । সমালোচনার ঝড় ওঠে সারা দেশে । কিন্তু বেদী সেসবের পরোয়া করেন নি । দলের খেলোয়াড়দের বাঁচানো এবং অন্যায়ের প্রতিবাদ করাই সেই মুহূর্তে তাঁর কাছে প্রধান কর্তব্য বলে মনে হয়েছিল ।

১৯৭৮ সালে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে পাকিস্তান দল অসততা অবলম্বন করায় প্রায় জেতা ম্যাচ ছেড়ে মাঠ থেকে দল তুলে নিয়েছিলেন অধিনায়ক বেদী । সেই ম্যাচে আম্পায়ার ছিলেন খিজর হায়াত ও জাভেদ আখতার । পাকিস্তানের অধিনায়ক ছিলেন মুস্তাক মোহাম্মদ ও বোলার সরফরাজ নওয়াজ । এঁদের পরিকল্পিত অন্যায়ের প্রতিবাদে দল তুলে নেন বেদী ।

বিশ্বজুড়ে পেস বোলারদের একচ্ছত্র দাপটের যুগে স্পিন শিল্পকে এনে একঘেয়েমি দূর করে ক্রিকেটকে আরও সুন্দর ও বৈচিত্র্যময় করে তোলার অন্যতম প্রধান কারিগর ছিলেন বিষান বেদী । তাঁর ফ্লাইটের বৈচিত্র ছিল নজরকাড়া । একই ওভারে ছয় রকমের ছ’টি বল করার ক্ষমতা ছিল এই স্পিনারের । মাত্র কয়েক পা ছুটে এসে আঙুল ও কব্জির মোচড়ে হাওয়ায় বল ভাসিয়ে বিভ্রান্ত করতেন ব্যাটসম্যানদের । বল ডেলিভারির একেবারে শেষ মুহূর্তে বলের গতিপথে বদল ঘটানোর বিরল দক্ষতা ছিল স্পিনের এই মহাশিল্পীর । বলের ওপর নিয়ন্ত্রণ ছিল অসামান্য । সারাদিন বল করেও ক্লান্ত হতেন না ক্রিকেট সাধক বেদী । তাঁর ছন্দোময় বোলিং ছিল দর্শকদের চোখের আরাম ও মনের আনন্দ ।

শচীনের খেলা দেখে প্রাণিত হয়েছেন বিরাট । বিরাটের খেলা দেখে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন শুভমন গিল । গাভাস্কারের খেলা দেখে বড়ো হয়েছেন শচীন । কিন্তু বিষান সিং বেদী কাকে দেখে প্রাণিত হয়েছিলেন ? তেমন কোনো ‘কান্তিময় আলো’ তিনি পেয়েছিলেন কি ? তাঁর ‘ব্রক্ষ্মাস্ত্র ‘ আর্ম বল তিনি কার কাছে শিখেছিলেন ? অন্ধকারে একলা চলতে চলতে নিজের পথ সম্ভবত নিজেই খুঁজে নিয়েছিলেন বিষান বেদী । ক্রমাগত রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত হতে হতে ঘনঘোর অন্ধকারে স্বয়ং হয়ে উঠেছিলেন ‘ কান্তিময় আলো ‘ ।

আরও পড়ুন- বাড়িতেই কোজাগরী লক্ষ্মীর আরাধনা রাজ্যের হেভিওয়েট নেতা-মন্ত্রীদের

spot_img

Related articles

বিরক্ত মিঠুন? এড়াচ্ছেন বঙ্গ বিজেপির একাধিক কর্মসূচি

বারবার রং বদল করে আপাতত গেরুয়াতে ঠেকেছেন ডিস্কো ড্যান্সার মিঠুন চক্রবর্তী (Mithun Chakraborty)। ভোটের আগে বা বিজেপির. (BJP)...

আরজি কর কাণ্ডে ভুয়ো প্রচারের অভিযোগ! নোটিশ চিকিৎসক সুবর্ণ গোস্বামীকে

আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক পড়ুয়া অভয়ার মৃত্যুকে ঘিরে ভুয়ো প্রচার মামলায় নোটিশ ধরাল কলকাতা পুলিশ। পুলিশের...

দুর্গাপুজোর আগে রাজ্যে ডেঙ্গি-উদ্বেগ! টানা বৃষ্টিতে বাড়ছে আশঙ্কা 

দুর্গোৎসবের মুখে একদিকে নিম্নচাপের জেরে টানা বৃষ্টি, অন্যদিকে ডেঙ্গি সংক্রমণ রাজ্যবাসীর কপালে ভাঁজ বাড়াচ্ছে। জুলাইয়ের শেষ দিক থেকে...

মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর স্টলে হঠাৎ মুখ্যমন্ত্রী! কিনলেন শাড়ি 

বর্ধমানে প্রশাসনিক সভায় এসে হঠাৎ স্বনির্ভর গোষ্ঠীর স্টলে হাজির মুখ্যমন্ত্রী। শুধু মহিলাদের হাতের কাজই ঘুরে দেখলেন না, কেনাকাটাও...