Friday, November 7, 2025

‘নিদারুণ বিষ ও সক্রেটিস’, উৎপল সিনহার কলম

Date:

Share post:

উৎপল সিনহা

‘ এ পানপাত্র নিদারুণ বিষে ভরা
দূরে ফেলে দাও দূরে ফেলে দাও ত্বরা ‘

যে মারে , সে ভুলে যায় । যে মার খায় , সে ভোলে না । অবশ্য এর উল্টোটাও ঘটে । মহাজ্ঞানী সক্রেটিসের শেষ দিনগুলোয় এমন দেখা গিয়েছিল । তাঁর মৃত্যুদণ্ডের দিন ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পরেও কারাগারে সক্রেটিসের নির্লিপ্তি দেখে হতবাক হয়ে গিয়েছিল সকলে । যিনি মাত্র কয়েকদিন পরেই মারা যাবেন , তিনি এত নির্বিকার , এমন শান্তচিত্ত থাকতে পারেন কীভাবে ? অথচ কারাগারের দায়িত্বে থাকা কর্মীরা , এমনকি যিনি বিষের পাত্র তুলে দেবেন সক্রেটিসের হাতে , তিনি পর্যন্ত কাঁদছেন , অথচ পরম নিশ্চিন্তে রয়েছেন সক্রেটিস স্বয়ং । তাঁর সারা মুখে একরাশ প্রশান্তি ।

সক্রেটিস বললেন , ‘ আজীবন আইন মেনেছি , মৃত্যুতে আইন ভাঙবো কেন ? ‘ তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে সন্ধ্যায় । তখনকার নিয়ম অনুযায়ী পরিবারের সকলে এবং একান্ত শিষ্যবৃন্দ তাঁকে ঘিরে আছেন অন্ধকার ঘরে । প্রধান কারারক্ষী এসে শেষ বিদায় জানালেন , তাঁর চোখেও জল ।‌ অথচ যিনি মারা যাবেন , তিনি ধীরস্থির , শান্ত । কী আশ্চর্য জীবন ! কারাগার প্রধান বললেন , এথেন্সের হে মহান সন্তান , দয়া করে আমাকে অভিশাপ দেবেন না , আমি তো দায়িত্ব পালন করছি মাত্র । এতো বছর কারাগারের দায়িত্বে আছি , কিন্তু আপনার মতো জ্ঞানী , সাহসী ও মহৎপ্রাণ মানুষ আমি দেখি নি । আমাকে ক্ষমা করুন ।

মৃত্যুর আগে নতুন পোশাক পরলেন সক্রেটিস । পরিবারের নারী ও শিশুদের চলে যেতে বললেন ।‌ শান্ত , নিরুদ্বেগ তিনি । মৃত্যুতে কি কিছুই যায় আসে না তাঁর ? চাইলেই তো মৃত্যু এড়িয়ে যেতে পারতেন তিনি ।

কী অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে ? কেন তাঁর মৃত্যুদণ্ড ? তিনি নাকি দেবতাদের প্রতি ভিন্নমত পোষণ করেছেন । তরুণ প্রজন্মকে বিপথগামী করেছেন । রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র করেছেন । নিয়মানুযায়ী খোলা মাঠে তাঁর বিচারসভা বসেছিল । বিচারক ছিলেন তৎকালীন সমাজের ৫০০ জন জ্ঞানী মানুষ । এঁদের অনেকেই গ্রীসের রাজার একান্ত অনুগত ছিলেন । তাঁরা ঈর্ষা করতেন সক্রেটিসের মেধা ও জনপ্রিয়তাকে । বিশেষ করে তরুণ সমাজে তাঁর তুমুল জনপ্রিয়তায় তাঁরা শঙ্কিত ছিলেন । তবুও হয়তো প্রাণে বেঁচে যেতেন তিনি । কিন্তু কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েও বিচারকদের উপহাস করতে ভুললেন না তিনি । ফলে চরম শাস্তি মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হলো । হেমলক বিষপ্রয়োগে তাঁর মৃত্যু ধার্য হলো ।

আত্মপক্ষ সমর্থনে সক্রেটিস বিচারকদের প্রশ্নবানে জর্জরিত করে তোলেন । তাঁর একটি প্রশ্নেরও ঠিকঠাক উত্তর দিতে পারেন নি বিচারপতিরা । মৃত্যুর আগে একমাস কারাগারে বন্দী ছিলেন তিনি । সেই একমাস তাঁর প্রজ্ঞায় মুগ্ধ হয়ে যান কারাকর্মীরা । তাঁরা সক্রেটিসেকে পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিতেন । কিন্তু সক্রেটিস সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতেন । তিনি সবিনয়ে জানাতেন যে , পালিয়ে গেলে ইতিহাস তাঁকে কাপুরুষ হিসেবে মনে রাখবে । অপমানের জীবনের চেয়ে বীরের মৃত্যু শ্রেয় , এই ছিল তাঁর দর্শন । শেষদিন নির্দিষ্ট সন্ধ্যায় জল্লাদ এলেন পেয়ালা হাতে ।

পেয়ালা ভর্তি হেমলকের বিষ। জল্লাদের নির্দেশ , পুরো বিষটা পান করতে হবে সক্রেটিসকে । একফোঁটা নষ্ট করা যাবে না । তিক্ত বিষের পুরোটা পান করলেন তিনি । তারপর নিয়মানুযায়ী কিছুক্ষণ পায়চারি করতে হলো তাঁকে , যাতে বিষের প্রভাব তাঁর সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে । শিষ্যেরা হায় হায় করে কাঁদতে লাগলেন ।
সক্রেটিস ম্লান হেসে তাঁদের শান্ত থাকতে বললেন । তিনি বললেন , ‘ আমাকে শান্তিতে মরতে দাও ‘ । লজ্জিত জল্লাদ মাথা নামিয়ে নিলেন ।

চাদর দিয়ে নিজের মুখটা ঢাকতে ঢাকতে সক্রেটিস তাঁর এক ছাত্রকে বললেন , ‘ এক প্রতিবেশীর কাছে একটা মুরগি ধার করেছিলাম আমি , ওটা ফেরত দিয়ে দিও ‘ । প্রহসনের বিচারে তাঁর মৃত্যু হয়েছে ঠিকই , কিন্তু মৃত্যু তাঁকে শেষ করতে পারে নি । শিষ্যদের জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করে তিনি বেঁচে রইলেন অনন্তকাল । শোনা যায় , তাঁর মৃত্যুর পর জল্লাদ সহ বেশ কয়েকজন বিচারক অনুশোচনায় আত্মহত্যা করেছিলেন । প্রায় আড়াই হাজার বছর পরে সক্রেটিসের গুণমুগ্ধ প্লেটো লিখলেন গুরু সক্রেটিসকে নিয়ে গ্রন্থ , রিপাবলিক । এরপর প্লেটোর শিষ্য এবং আলেকজান্ডারের শিক্ষক মহাজ্ঞানী এরিস্টটল লিখলেন অমর গ্রন্থ ‘ দ্য পলিটিক্স ‘ ।

আরও পড়ুন- প্রসার ঘটছে বাংলার কৃষ্টি-সংস্কৃতির! বিধাননগরের প্রকৃতি উৎসবে মুখ্যমন্ত্রীর প্রশংসায় সুজিত-দোলা-কৃষ্ণারা

_

_

spot_img

Related articles

ব্রিটিশ-তোষণে লেখা ‘জন গণ মন’! বিজেপি সাংসদের অপমানজনক মন্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ তৃণমূলের

ব্রিটিশদের তোষণ করতেই নাকি লেখা হয়েছিল ‘জন গণ মন’। ভারতের জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে এই ন্যক্কারজনক মন্তব্য করে ফের...

চিংড়িঘাটা মোড়ে যানজট কমাতে নতুন সেতু নির্মাণের উদ্যোগ কেএমডিএ-র

ইএম বাইপাসের চিংড়িঘাটা মোড়ে দীর্ঘদিনের যানজট সমস্যার সমাধানে বড় পদক্ষেপ নিতে চলেছে কেএমডিএ। শান্তিনগর খালের উপর বর্তমান সরু...

নামের বানানভুল থেকে ডিটেনশন আতঙ্ক! এসআইআর আতঙ্কে মানসিক চাপে সাঁইথিয়ায় মৃত্যু বৃদ্ধের

ইলামবাজারের ঘটনার পর ফের এসআইআর আতঙ্কে মৃত্যু বীরভূমে। হৃদরোগে প্রয়াত হলেন সাঁইথিয়া পুরসভার ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা বিমান...

বিহারে প্রথম দফায় অতিরিক্ত ভোটদানে নতুন সমীকরণ! চিন্তায় শাসক শিবির

বিহার বিধানসভা নির্বাচনের প্রথম দফায় ভোটদানের হার নিয়ে রাজনৈতিক চর্চা তুঙ্গে। বৃহস্পতিবার ১২১টি আসনে ভোটগ্রহণ শেষ হয়েছে। নির্বাচনী...