তাজমহল হাত কাটলেও তারাপীঠ স্বীকৃতি দিয়েছে নির্মান-কারিগরদের

তাজমহলের মতো সৌধ গড়েও নির্মাতারা স্বীকৃতি পাননি। স্বীকৃতি তো দূরের কথা, উল্টে নাকি মর্মান্তিক শাস্তি পেতে হয়েছিলো শিল্পীদের। কারন,
আর একটা তাজমহল হোক, এটা নাকি একদমই চাননি মোগল সম্রাট শাহজাহান। তাজমহল তৈরির পর নাকি কারিগরের হাত কেটে দিয়েছিলেন শাহজাহান। ফলে ওই কারিগরেরা দ্বিতীয় তাজমহল নির্মানের কথা ভাবতেই পারেনি।
এর ঠিক বিপরীত কাহিনি বাংলার অন্যতম শক্তিপীঠ ‘তারাপীঠ’ ঘিরে। এই মহামন্দির নির্মাতাদের বা নির্মান-কারিগরদের নাম কিন্তু আজও জ্বলজ্বল করছে পাথরের ফলকে। একটু খোঁজার চোখ নিয়ে দেখলেই চোখে পড়বে তাঁদের নাম। আজ তাঁদের খবর কেউ না রাখলেও, মন্দির প্রতিষ্ঠালগ্নে কিন্তু ওই কারিগরদের অভূতপূর্ব সম্মান দেওয়া হয়েছিলো। আজ হয়তো সেই নামগুলো ঝাপসা, কিন্তু সেদিন বেনজিরভাবেই মর্যাদা দেওয়া হয়েছিলো ওই কারিগরদের।শক্তিপীঠে আজও কারিগরদের নিরুচ্চার জয়ধ্বনি। বছরের প্রতিটি দিনই এই পীঠে ভক্তদের ভিড় লেগে থাকে। কিন্তু কত জন নজর করেন মন্দিরের বারান্দার ঠিক নীচে থাকা একটি ফলক। একটু চেষ্টা করলেই দেখা যায় চোদ্দটি নাম। কালের নিয়মে আজ সেই ফলক প্রায় ঝাপসা হয়ে গিয়েছে। অনেকেই হয়তো জানেন তারাপীঠের মন্দির প্রতিষ্ঠার গল্প। কিন্তু এই মন্দির তৈরির কারিগরদের কথা কতজন জানেন? টেরাকোটা, পাথর দিয়ে তৈরি মন্দির তৈরিতে কত পরিমান কান্না-ঘাম-রক্ত-পরিশ্রম লুকিয়ে ছিল, তার খবর ক’জন আর রাখি? পরবর্তী প্রজন্ম বিস্মৃত হলেও, সেদিন কিন্তু মন্দির-প্রতিষ্ঠাতা ভুলে যাননি কারিগরদের কথা। পাথরের ফলকে পর পর নাম লেখা 14 জন নির্মান-শ্রমিকের। দুনিয়ার কোন জাগ্রত ধর্মস্থানেই সম্ভবত এভাবে কারিগর-পুজোর ইতিহাস নেই। তাই বোধহয় তারা-মায়ের মন্দির আক্ষরিক অর্থেই শক্তিপীঠ, শক্তি-শিল্প-পরিশ্রমকে মর্যাদা দেওয়ার মহামন্দির।

তারাপীঠ। তারা-মায়ের জাগ্রত মন্দির। রামপুরহাট থেকে ছ’কিমি দূরে দ্বারকা নদীর ধারে এই ছোট্ট মন্দিরনগরী। মন্দির সংলগ্ন মহাশ্মশান।
কেউ বলেন পাঁচশো, কেউ বলেন সাতশো বছরের ইতিহাস এই তারাপীঠের। শুরুর সময় এই জায়গার নাম ছিল চন্ডীপুর। ঘন জঙ্গল। ভয় ভয় একটা পরিবেশ। তারই মাঝে প্বার্শবর্তী দ্বারকা নদী ধরে বাণিজ্যে বেরিয়েছিলেন ধনী ব্যবসায়ী জয় দত্ত সওদাগর। সঙ্গে তাঁর ছেলে। কথিত আছে, এই চন্ডীপুরেই নাকি তাঁর ছেলেকে সাপে কাটে। লোকশ্রুতি, পুত্রশোকে হাহাকার করা জয় দত্ত সওদাগর সেখানেই নৌকা-বজরা থামান। স্বপ্নাদেশে সেখানেই নাকি ‘জীবিত-কুন্ড’-র জলপান করে প্রাণ ফিরে পায় সওদাগর- ছেলে।এরপরই সওদাগর স্থির করলেন এখানেই হবে মন্দির। স্থান-মাহাত্ম্যকে সম্মান দিয়ে এখানকার শ্মশানে সাধনা করতে শুরু করেন সওদাগর। স্বপ্নাদেশে শ্মশানেই তারামায়ের এক শিলামূর্তির হদিশ পান তিনি। পরে এখানে মন্দির করেন মল্লারপুরের জমিদার। তারাপীঠের মন্দির সৃষ্টির অন্যতম এক লোকশ্রুতি এমনই।

বীরভূমের এই তীর্থ তারাপীঠ-তীর্থ আজ আন্তর্জাতিক
জনপ্রিয়তার কেন্দ্রভূমি। অথচ রহস্যের পর রহস্য আবৃত করে রেখেছে এই শক্তিপীঠকে।

ঠিক কবে এই শাক্তপীঠ তারাপীঠ আবিষ্কৃত হয়, তা আজও সঠিক জানা যায় না। সুস্পষ্ট নয় তারা মায়ের এই ‘cult’ সংক্রান্ত ইতিহাস। প্রচলিত আছে হরেক কাহিনি। অতিপ্রাচীন দেবীশিলা মা উগ্রতারা, বশিষ্ঠদেবের পরম্পরা, এবং অবশ্যই দিব্যপুরুষ বামাচরণ চট্টোপাধ্যায় বা বামাক্ষ্যাপাকে ঘিরে এখানে চালু আছে রয়েছে অসংখ্য কিংবদন্তি। বলার সময় বক্তা, মনের মাধুরী মিশিয়ে অনেক সময়ই বাড়িয়ে বলেন। অনেকে আবার তথ্য না-জানার কারনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেন বিচিত্র কিছু গল্প বলে। রহস্যাবৃত সেই তারাপীঠের কিছু বিশেষত্ব অবশ্যই আছে। দেখা যাক কী সেই রহস্য !

■ তারাপীঠের প্রধান এবং নিশ্চিত গুরুত্বের একমাত্র কারন এই মহাপীঠের ভৌগোলিক অবস্থান। তারাপীঠ দ্বারকা নদের তীরে অবস্থিত। দ্বারকা নদ মূলত উত্তরবাহিনী জলধারা। এই উত্তরবাহিনী জলস্রোত সদাসর্বদা কুলকুণ্ডলিনীর ঊর্ধ্বগতির প্রতীক। তাই এই স্থানমাহাত্ম্যের আধ্যাত্মিক তাৎপর্য বিপুল।

■ তারাপীঠ মহাঋষি বশিষ্ঠের সাধনপীঠ হিসেব প্রসিদ্ধ। পৌরাণিক বা ঐতিহাসিকভাবে এই বশিষ্ঠমুনি কে, তা নিয়ে অজস্র প্রশ্ন রয়েছে। তিনি কি মহাকাব্য-পুরাণে উল্লিখিত বশিষ্ঠ? পুরাণবিদের ব্যাখ্যা, বশিষ্ঠ নির্দিষ্ট কোনও সাধক নন, বশিষ্ঠ একটি সাধক-পরম্পরা। এই পরম্পরার বা ঘরানার কোনও মহা-সাধক তারাপীঠে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন।

■ মহাপীঠ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এটা অনস্বীকার্য তারাপীঠ প্রকৃতপক্ষেই এক ‘সিদ্ধপীঠ’। সেই পুরাণকাল থেকে এখানে বহু সাধক এসেছেন তপস্যা করার জন্য। এবং তাঁদের সিদ্ধিলাভেই ধন্য হয়েছে এই পীঠ। তাই এই পীঠের মহিমা ও গুরুত্ব অন্য যে কোনও শক্তিপীঠের থেকে আলাদা।

■ বহুল প্রচারিত হলেও বাস্তব এটাই, তারাপীঠ 51 পীঠের অন্তর্বর্তী নয়। ‘মহাপীঠপুরাণ’-এ উল্লিখিত পীঠস্থান-তলিকায় তারাপীঠের উল্লেখ নেই। জনমানসে অবশ্য প্রথম থেকেই প্রচলিত যে, সতীর “তৃতীয় নয়ন” এখানে পড়েছিল। কিন্তু কোনও পুরাণ- গ্রন্থেই এর কোনও সমর্থন পাওয়া যায় না।

■ এই ‘তৃতীয় নয়ন’-এর কাহিনিকে প্রতীকী হিসাবে ধরে নিলে একথাই স্পষ্ট হয়, মহাতীর্থ তারাপীঠ এক মহাশক্তির কেন্দ্র। কালে কালে মানুষের বিশ্বাস আর কিছু পৌরাণিক কাহিনি একত্রিত হয়ে তারাপীঠ মন্দিরের মহিমাকে স্বর্গীয় মাত্রা দান করেছে।

■ দেবী তারা-র উল্লেখ আছে মূলত রয়েছে বজ্রযানী বৌদ্ধ ধর্মে।ওদিকে আবার দশমহাবিদ্যা স্তোত্রেও তিনি আছেন। ‘তারারহস্য’ বা অন্য কিছু তন্ত্র গ্রন্থে বলা আছে “তারা-cult” অতি প্রাচীন। বজ্রযান গড়ে উঠেছিল মহাযানবাদ এবং লোকধর্মের মিশ্রণে। সেখানে দেবী তারার অবস্থান অসম্ভব গুরত্বপূর্ণ স্থানে।

■ তারাপীঠ মন্দিরে মায়ের শিলারূপ ঢাকা থাকে একটি রৌপ্য আচ্ছাদনে। আর সেই আচ্ছাদনকেই মাতৃরূপের প্রতীক হিসাবে ধরা হয়। এই মূর্তিই তারামূর্তি হিসেবে পূজিতা হন।

■ তারাপীঠ মন্দিরের স্থাপত্য খুবই সাধারণ। সাদামাটা চালা ডিজাইনের মন্দির। কিন্তু মন্দিরের এই স্থাপত্যে বাংলার নিজস্ব স্থাপত্যশৈলীর ছাপ স্পষ্ট। এই শৈলী একমাত্র বাংলাতেই দেখা যায় এবং এই নির্মান-শৈলী
বাংলার আদি ঐতিহ্যকেই সন্মানিত করে।

■ তারাপীঠের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ বামাচরণ চট্টোপাধ্যায় তথা বামাক্ষ্যাপা। তন্ত্রধর্মে বামাক্ষ্যাপার স্থান প্রশ্নাতীত উচ্চতায়। এই বামদেবকে ঘিরে একদিকে আবর্তিত হয়েছে বাংলার তন্ত্রচর্চার বিশালাকায় এক অধ্যায়, অন্যদিকে এই বামাক্ষ্যাপা অসংখ্য কিংবদন্তির
কেন্দ্রবিন্দু হয়ে রয়েছেন যুগ যুগ ধরে।

■ তারাপীঠ মহাশ্মশান আজও বহু তান্ত্রিকের বিচরণক্ষেত্র। তন্ত্রে উল্লিখিত শ্মশানক্রিয়া সম্পন্ন করতে গোটা দেশ থেকে শাক্ত সাধকরা নিয়মিত এখানে আসেন।

Previous articleদেশাত্মবোধের এই ইতিহাস দেখুন, পড়ুন…
Next articleচিদাম্বরমের INX মামলা কী, একনজরে দেখুন