শোভনের ভাবমূর্তি ধাপার মাঠে ফেলছেন সখী, কণাদ দাশগুপ্তর কলম

কণাদ দাশগুপ্ত

সুকুমার রায় সেই কবেই বলে গিয়েছেন যে আলু আর আলুবোখরা সমান নয়। চাল কিনতে এসে কেউই চালতার খোঁজ করেনা। কিন্তু এই সহজ কথাটা মানতেই চাইছেন না বৈশাখী এবং শোভন।

বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের বদ্ধমূল ধারনা, রাজনৈতিক আঙ্গিনায় সে শোভন চট্টোপাধ্যায়ের মতোই অভিজ্ঞ, দক্ষ। বিষয়টা ওই সখীর ভাবনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলে ক্ষতি ছিলো না। কিন্তু তা হয়নি। তিনি দাবি করার চেষ্টা চালিয়েই যাচ্ছেন। বৈশাখীর দাবি, বিজেপিতে শোভনের সঙ্গে একাসনে বসার রাজনৈতিক যোগ্যতা তাঁর আছে। তিনিই বা কম কিসে ! এটা হয়তো ঠিক, একাধিক গুণের কারনে অনেক কিছুতেই তিনি শোভনকে দশ গোল দিতে পারেন, কিন্তু রাজনীতিতে তো একেবারেই নয়। কিন্তু ওনার চিৎ হয়ে শোওয়ার ইচ্ছা হলে, কে-ই বা কী করবে!

আর এখানেই তৈরি হয়েছে উটকো সমস্যা।
তাই, বৈশাখীর আচরণে যারপরনাই বিরক্ত বঙ্গ-বিজেপি। এবং বিরক্তি এই মুহূর্তে এতটাই যে শোভন-সখী বৈশাখী নিজেই দল ছাড়লে স্বস্তির শ্বাস নেবে রাজ্য বিজেপি। তাহলে আর বিকল্প কিছু ভাবতে হয়না। শুধু তাই-ই নয়, বিজেপির অভ্যন্তরে পরিস্থিতি এমনই, বৈশাখী যদি দল ছাড়ার সময় সঙ্গে করে শোভনকেও নিয়ে যান, তাতেও বিজেপির আপত্তি নেই। কতখানি করুন অবস্থা 1985 সাল থেকে টানা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি থাকা এক হেভিওয়েট নেতার।

‘সখী’ বৈশাখীকে সঙ্গে নিয়ে গত 14 আগস্ট বিজেপিতে যোগদান করেছিলেন শোভন চট্টোপাধ্যায়। আর প্রথমদিন থেকেই বৈশাখী একের পর এক সমস্যা তৈরি করে চলেছেন বিজেপিতে। কী কী সেই সমস্যা?

● প্রথম সমস্যা, বৈশাখীর দাবি, অভিজ্ঞ এবং দক্ষ রাজনীতিবিদ শোভনের সমমর্যাদায় তাঁকেও দলে গ্রহন করতে হবে।

● সখী তার পরের সমস্যা তৈরি করলেন তৃণমূল বিধায়ক দেবশ্রী রায়ের বিজেপিতে যোগদান করা নিয়ে। বৈশাখী সেদিন শোভনের ‘মুখপাত্রী’ হয়ে জানালেন, দেবশ্রী বিজেপিতে যোগ দিলে ‘শোভনদা’ আর বিজেপিতে থাকবেনা। কবে এবং কখন বললেন একথা! বিজেপিতে ঘটা করে যোগ দেওয়ার এক ঘন্টার মধ্যেই।

● তৃতীয় সমস্যা, দলে যোগ দিয়ে কলকাতায় ফেরার পর বঙ্গ-বিজেপি শোভনকে সংবর্ধনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সন্দেহ নেই, তৃণমূলকে বাড়তি ঝাঁকুনি দিতেই বিজেপির এই পদক্ষেপ। এখানেও গোঁ ধরলেন বৈশাখী। তাঁকেও সম-মর্যাদায় সংবর্ধনা দিতে হবে। প্রশ্ন তুললেন, এই অনুষ্ঠানে তাঁর নাম কেন রাখা হয়নি ?

● চতুর্থ এবং আপাতত সর্বশেষ সমস্যা, বৈশাখীর দাবি, বিজেপিতে শোভনকে যদি দায়িত্বশীল এবং মর্যাদাপূর্ণ পদ দেওয়া হয়, তাহলে তাঁকেও সম-মর্যাদার দলীয় পদ দিতে হবে।

বারে বারে শোভন-সখী ভুলে গিয়েছেন, আলু আর আলুবোখরা সমান নয়। চাল কিনতে এসে কেউই চালতার খোঁজ করেনা। বঙ্গ- রাজনীতির আঙ্গিনায় কোনওকালেই এই মহিলাকে শক্তিশালী দূরবীণেও নজরে আসেনি, সেই মহিলা কোন লজ্জায় শোভন চট্টোপাধ্যায়ের মতো এক অভিজ্ঞ ও দক্ষ সংগঠকের সমান মর্যাদা দাবি করেন ?
বৈশাখীকে শোভনের সমমর্যাদার পদ দেওয়াতে আপত্তি রয়েছে বিজেপির। খুবই স্বাভাবিক ও সঙ্গত আপত্তি। সূত্রের খবর, শোভনকে কলকাতা ও দক্ষিণ 24 পরগনায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়ার কথা ভাবছে বঙ্গ- বিজেপি। কিন্তু সম-পদমর্যাদা চাইছেন বৈশাখীও। নারাজ বিজেপি নেতৃত্ব। তাদের বক্তব্য, রাজনীতিতে বৈশাখী একেবারেই আনকোরা। তাঁর মতো রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ
অধ্যাপিকা বিজেপিতে একাধিক আছেন। তাহলে তো সবাইকেই পদ দিতে হয়। রাস্তায় নেমে দলের পক্ষে ঝড় তুলে আজ রাজনৈতিক স্বীকৃতি পেয়েছেন এক সময় রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা না থাকা লকেট চট্টোপাধ্যায়। পথে নেমে কাজ করছেন প্রাক্তন IPS ভারতী ঘোষ। এই বৈশাখী আগে তেমন কিছু করে দেখান। তারপর তো দলীয় স্বীকৃতি! এতেই নাকি গোঁসা হয়েছে সখী- বৈশাখীর। সেই মান ভাঙ্গাতে যথারীতি সক্রিয় শোভন। বিজেপি স্পষ্ট বুঝিয়েছে, দু’জনকে সমান পদ দেওয়া অসম্ভব। রাজ্য সভাপতি আরও একধাপ এগিয়ে জানিয়েছেন, “দল কীভাবে চলবে, কাকে দলে নেওয়া হবে, এ বিষয়ে দলের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। দলে থাকতে হলে দলের সিদ্ধান্ত মানতে হবে”। দিলীপবাবু যেটা মুখ ফুটে বলেননি, তা হলো, “দলের সিদ্ধান্ত পছন্দ নাহলে দরজা খোলা আছে, বেরিয়ে যেতে পারেন”। শোনা যাচ্ছে, ‘ফিলার’ মারফত শোভনের সঙ্গে তৃণমূলের কথা চালাচালি শুরু হয়েছে। কথার বৃত্ত সম্পূর্ণ হলে মাথা মুড়িয়ে শোভন চট্টোপাধ্যায় না’কি ‘উজ্জ্বল ভাবমূর্তি’ ফিরতে পারেন তৃণমূলে।
মোদ্দা কথা, বৈশাখীর আচরণে বিরক্ত রাজ্য বিজেপি। দল জানিয়ে দিয়েছে, বৈশাখীর দাবি এবং আপত্তি কিছুই মানা হবে না। দেবশ্রী রায়কে বিজেপিতে স্বাগত জানানো হবে। দল যা পদ দেবে, সেটাই নিতে হবে।
রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন উঠেছে, তৃণমূলে থাকার সময় শোভন জোর গলায় বলেছিলেন, সখী-বৈশাখীর অপমান নিজের বুক পেতে রুখবেন। এখন শোভন কেন সরব হয়ে একই কথা বলছেন না সখীর স্বার্থে? কেন বলছেন না, ‘বিজেপিতে বৈশাখীর অপমান সহ্য করবেন না তিনি’। রাজ্য বিজেপি মনে করছে,হ বৈশাখী সস্তা চাপের খেলা খেলতে চাইছে। বৈশাখীর স্থির ধারনা, এখনই যদি শোভন বিজেপি থেকে ইস্তফা দেয়, তাহলে মুখ পুড়বে গেরুয়া-ব্রিগেডের। সেই মুখ পোড়ানো আটকাতে বৈশাখীকে উঁচু পদ দিতে বাধ্য বিজেপির। তারই সুযোগ তুলতে চাইছেন বৈশাখী, এবং তাতে পোঁ ধরেছেন শোভন। আর দূর থেকে তৃণমূল হাসছে আর বলছে, ‘দ্যাখ কেমন লাগে!”

আসলে দুঁদে রাজনীতিক শোভন চট্টোপাধ্যায় ধরতেই পারছেন না এই সখী তাঁর রাজনৈতিক কেরিয়ার ও ভাবমূর্তি ধাপার মাঠে নিয়ে ফেলতে সক্রিয়। শোভনকে এখন বেছে নিতে হবে রাজনৈতিক জগতে সসম্মানে ফিরে আসা, না’কি ‘বন্ধুত্বের মর্যাদা’ রক্ষা করতে গিয়ে রাজনীতির আঙ্গিনা থেকে পাকাপাকিভাবে বিদায় নেওয়া, কোনটা তিনি চাইছেন। বিজেপি তো দূরস্থান, বৈশাখীর দাবি মানা বোধহয় বিপ্লবী বাংলা কংগ্রেস বা মার্কসবাদী ফরওয়ার্ড ব্লকেও সম্ভব নয়।

শোভন চট্টোপাধ্যায়কে এ সব কে বোঝাবে !

Previous articleরবিবাসরীয় ডার্বি দেখবে স্প্যানিশ ডুয়েল, পরিসংখ্যান বলছে এগিয়ে মশাল বাহিনী
Next articleব্রেকফাস্ট নিউজ