এখনই ঘুরে না দাঁড়ালে ইহুদিদের মত ভ্রাম্যমাণ জাতিতে পরিণত হবে বাঙালি

রেজাউল করিম

(বিশিষ্ট চিকিৎসক)

বাঙালি বুদ্ধিজীবী বলে এখন আর কিছুই নেই।

দেশের যে কোনও বিপর্যয়ে, মনুষ্যত্বের যে কোন অবমাননায় কিংবা মূল্যবোধের অবক্ষয়ে বাঙালি মনীষার যে ক্রুদ্ধ, মননশীল, যুক্তিবাদ শতধারায় বিকশিত হয়ে আছড়ে পড়তো, তা এখন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। এ সেদিনের কথা শুধু নয়, যেদিন আঁচড় কেটে বাঙালিকে দ্বিখণ্ডিত করা হয়েছিল, তার বহু বহু আগে থেকেই বাঙালি আলাদা। তার চিন্তায়, মননে, সহনশীলতায়, রণনৈপুন্যে, ভাববাদে, জীবনযাত্রায়! 1947- এ বাংলার ভাগ যারা চেয়েছিল, তারা এখন দেশের মসনদে। একদল উন্মাদ বলেছিল, দেশ ভাগ না হলেও বাংলাকে ভাগ করতে হবে। হিন্দু আর মুসলমান সাম্প্রদায়িক শক্তি একত্রে বাংলাকে সেদিন ভাগ করেছিল। যে 17টি জনপদ নিয়ে বাঙালি যাত্রা শুরু করেছিল, তার অনেক কিছুই আজ তাঁর হাতছাড়া। সাম্রাজ্য ভেঙে যায়, রাষ্ট্রশক্তি আসে যায়, কিন্তু জাতি তার নিজস্বতা বাঁচিয়ে রাখে। বাঙালির জিনে যে বৈচিত্র্য, তা তার মতামতের মতই বিচিত্র, আদি চের- জনগোষ্ঠীর মধ্যে যেমন আদি অষ্ট্রেলেশিয় জিন আছে, মেলানিড জিন আছে, ব্রাকিড জিন আছে, তেমন বৈচিত্র্য সারা পৃথিবীর কাছে অনন্য ও বিশিষ্ট! তার প্রতিফলন বাঙালির জীবনচর্যায়! আর্য রাষ্ট্রশক্তি বাঙালিকে পদানত করলেও তাই তার বিভিন্নতা স্তব্ধ করতে পারে নি, তার রক্তস্রোতে সেই অনন্যতা আঁকা হয়ে আছে।

আজ হিমন্ত বিশ্বশর্মা, কৈলাস বিজয়বর্গীয়রা বাঙালির যে সর্বনাশ করার উদ্যোগ নিয়েছে, তাও হঠাৎ গজিয়ে ওঠা কোন আপদ নয়। বাঙালি যে উচ্চবর্ণের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়, তা শুধু ঐতিহাসিক বিশ্রুত তথ্য নয়, তত্ত্বকথার রূপ নিয়ে তা পুরানেও জায়গা করে নিয়েছে। বাঙালিকে খতম করার জন্য ব্রাত্য প্রদেশে এসেছে ধর্মের ধ্বজাধারীরা। কর্ণাটি ব্রাহ্মণের হাতে, তুর্কি মুসলমানের হাতে, মোঘলের হাতে বাঙালি কচুকাটা হয়েছে। বাঙালির দ্রাবিড়ীয় চের- রক্ত উচ্চবর্ণের ধ্বজাধারী ধর্মের দালালদের হাতে আক্রমণের ইতিহাস তাই নতুন নয়। শশাঙ্ক যা করেছেন, বক্তিয়ার যা করেছেন, তার মধ্যে গুণগত কোন ফারাক ছিল না। Rise of Islam and Bengal frontier-এ ইটন সাহেব বিস্তৃত লিখেছেন, কিভাবে ব্রাত্য বাঙালি ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে দূরে থাকতো। তথাকথিত যুযুধান ধর্মের ধ্বজাধারীরা বাঙালিদের শায়েস্তা করতে কিভাবে ধর্মের ব্যবধান ভুলে যেত! বঙ্গালে তাই ছিল উচ্চবর্ণের জমিদার, নবাব, রায়, রায়ান, মজুমদার, চৌধুরি। মল্ল, কৈবর্ত, ঢালি, ডোম, নমশূদ্র-রা না ছিল ক্ষমতায়, না ছিল অর্থে বিত্তে বলীয়ান। এই ইতিহাস যদি মনে রাখতে না চান শরৎবাবুর লেখা পড়ুন। নিম্নবর্গের জমিদারের হেনস্থার গল্পও তো তিনি লিখেছেন।

অসমে আজকের বিপদ তাই নতুন কোন আপদ নয়। এই 19 লক্ষ গৃহহীন হয়েছেন, দেশহীন হয়েছেন সরকারি কলমের খোঁচায়। কলম ছাড়া একের পর এক গণহত্যা হয়েছে, যেখানে বাঙালিকে জবাই করা হয়েছে। মুসলমান আশরাফ সম্প্রদায়ের হাতে হিন্দু বাঙালি নির্যাতিত হয়ে দেশছাড়া হয়ে ভারতে আশ্রয় খুঁজেছে। এই দেশের ঠিকাদার গগৈ বা শাহরা নয় যে কলমের খোঁচা দিয়ে দেশছাড়া করবে! পদ্মাপার থেকে বিতাড়িত বাঙালিকে ভিটেমাটি ছাড়া করার সময় ও বাঙালি চুপ করে থেকেছে। নতুন দেশেও দরিদ্র বাঙালি উচ্চবর্ণের মানুষের হাতে নির্যাতিত হয়েছে। নির্যাতনকারী ধর্ম পাল্টে তখন মুসলমান হয়েছে, কিন্তু অর্থ ও ক্ষমতার বিচারে তাদের গুণগত মান বদলায় নি। তারা যথাস্থানে থেকেছে, বদলেছে শুধু নির্যাতিত! ‘বাঙালনামা’য় তার বিবরণ লেখা আছে। নোয়াখালিতে যা হয়েছিল, কলকাতা’য় যা হয়েছিল, নেলি’তে যা হয়েছিল আর আজ কাগজে কলমে যা হলো, তার মধ্যে পার্থক্য খুঁজতে যাওয়া তাই বাতুলতা।
এখনো সময় আছে, ধর্ম-বর্ণের নিরিখে নয়, বাঙালির অবমাননায় যদি উদ্বেল না হই, যদি মনুষ্যত্বের এত বড় বিপর্যয়ে চুপ করে থাকি, তাহলে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়েও আমাদের স্থান হবে না। অসমের বাঙালির অপমান শতগুণ বৃদ্ধি হয়ে সমতট, রাঢ়, গৌড়, সুহ্ম বা তাম্রলিপ্তের বাঙালীর ঘরে হানা দেবে। কেউ ছাড় পাবেন না। কামরূপ গিয়েছে, বঙ্গ গিয়েছে, হারিকেল গিয়েছে, পৌণ্ড্র, বারেন্দ্র, বাখরগঞ্জ, বিক্রমপুর, রুহ্ম সব গিয়েছে। এখন ঘুরে না দাঁড়ালে বাঙালি ইহুদিদের মত সারা পৃথিবীর ভ্রাম্যমাণ জাতিতে পরিণত হবে।

দেশহীন, নামহীন, সংস্কৃতিহীন, সম্পদহীন এক যাযাবর হবে বাঙালি!

Previous articleসেদিনের বীর আজ বান্ধবীর আঁচলে !! কুণাল ঘোষের কলম
Next articleরোমিলা থাপারকে জানাতে হবে তিনি কী কী কাজ করেছেন!