এই রায় কি সর্বস্তরে মান্যতা পাবে ? কণাদ দাশগুপ্তর কলম

কণাদ দাশগুপ্ত

সম্প্রীতির কবি, “সাঁরে যাহাসে আচ্ছা”-র কবি ইকবালের জন্মদিন আজ 9 নভেম্বর। আজই অযোধ্যার রামমন্দির মামলার রায় ঘোষণা করেছে সুপ্রিম কোর্ট। রায়ে বলা হয়েছে

■ বিতর্কিত 2.77 একর জমির মালিকানা ‘রামলালা বিরজমান’-এর।
■ সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডকে বিকল্প 5 একর জমি দিতে হবে অন্যত্র।
■ আগামী 3 মাসের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারকে ট্রাস্ট গঠন করে মন্দির নির্মাণের ব্যবস্থা করতে হবে।

এই রায়ের ফলে কয়েক শো বছরের বিতর্কের অবসান হওয়ার আশা করছে সব মহলই। তবে কোনও আদালতই কোনও মামলার রায়ে বিবদমান সব পক্ষকে সন্তুষ্ট করতে পারেনা। এখানেও সম্ভবত পারবেনা। তবে সব পক্ষ সওয়ালে অংশ নিয়ে নিজেদের কথা বলতে পেরেছে। আদালত তা শুনেছে এবং সে সব বিবেচনায় রেখেই রায় ঘোষণা করেছে। এদিকে সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডের আইনজীবী এই রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, “আদালতের নির্দেশে বোর্ড যে 5 একর জমি পাবে, সেখানে দেশের বৃহত্তম এবং ঝাঁ চকচকে মসজিদ নির্মাণ করবে”। এখনও মুসলিম ধর্মীয় সংগঠনগুলির প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি। সে সব প্রকাশ্যে আসার পর বোঝা যাবে, এই রায় কতখানি সর্বজনগ্রাহ্য হতে পারলো।

একইসঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে,
এই রায় কি দেশের আবহমান সম্প্রীতি রক্ষা করতে পারবে? বিবদমান পক্ষগুলি কি এই রায়কে মান্যতা দেবে ? কোটি টাকার প্রশ্ন এসব। আসলে, পুরো মামলাটি বিশ্বাস ও ভাবাবেগের ওপর দাঁড়িয়ে ছিলো৷ প্রমাণের খুব বেশি বালাই ছিলো না৷ তবে, আদালত সব পক্ষের কথা শুনেছে৷ 17 নভেম্বর প্রধান বিচারপতি অবসর নিচ্ছেন৷ তার আগেই তাঁকে চূড়ান্ত রায় দিতেই হতো।

সুপ্রিম কোর্ট ঘোষিত এই রায়ে মন্দির-মসজিদ বিতর্কের অবসান হওয়ার কথা। প্রায় 500 বছরের বিতর্ক বোধহয় মিটে যাওয়ার কথা।এই মামলার রায়দানের ফলে আইন-শৃঙ্খলা ও শান্তি বজায় রাখা কেন্দ্রের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ হতে চলেছে৷ অযোধ্যার সাধারণ মানুষ মন্দির-মসজিদ বিতর্কে দাঙ্গা, হানাহানি চায় না৷ তারা শান্তিপূর্ণ সমাধান চায়৷ এটা মেনে নেওয়াই ভালো, 1992 সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সময় যা ঘটেছে তা বহিরাগতদের তৎপরতায় ঘটানো হয়েছে৷ চূড়ান্ত রায় দেওয়ার সময় এই বিষয়টি গুরুত্ব দিয়েই ভেবেছেন বিচারপতিরা৷ তবে আপাতত যা জানা গিয়েছে, তাতে এই বিতর্কের কথা উল্লেখ করা হয়নি। অনেকে অবশ্য বলেছিলো, বিতর্কিত জমির দাবিদার 3 পক্ষ যখন জমি ভাগাভাগি করতে রাজি নয়, তখন ওই জমি অধিগ্রহন করে জনগণের স্বার্থে হাসপাতাল গড়ে তোলা হোক৷ তবে তা আবাস্তব বলেই আদালত সে পথে হাঁটেনি।
রামের জন্মস্থান নাকি বাবরি মসজিদ গড়া হবে, সেই বিতর্কের সমাধান করার সময় আদালতকে অনেকগুলি স্পর্শকাতর বিষয় মাথায় রাখতে হয়েছে৷ আদালত গুরুত্ব দিয়েছে পুরাতত্ত্ব বিভাগের খননকার্যের রিপোর্টকে। এই রিপোর্টে বলা হয়েছে, খননের পর যা মিলেছে, তাতে মুসলিম স্থাপত্যের চিহ্ন নেই। গোটা বিষয়টি আইনি ইস্যুর থেকেও সরাসরি রাজনৈতিক ইস্যু ছিলো৷ বিজেপির চেয়ে অনেক বেশি সক্রিয় ছিলো বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মতো কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি। ফৈজাবাদ ও অযোধ্যার স্থানীয় মানুষ কেউই দাঙ্গা হাঙ্গামা করে বিতর্কের সমাধান কখনই চায়নি, আজও চায় না৷ মন্দির- মসজিদ বিতর্ক ভারতের হিন্দু ও মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়৷ পরিস্থিতি বুঝে গত 14 অক্টোবর থেকে আগামী 10 ডিসেম্বর পর্যন্ত অযোধ্যায় 144 ধারা জারি রয়েছে৷ আরও কিছু বিধিনিষেধ জারি করেছে শীর্ষ আদালত৷ অনুমতি ছাড়া বিতর্কিত এলাকায় ড্রোন ওড়ানো নিষিদ্ধ৷ নৌকা চালানো, আতশবাজি তৈরি এবং বিক্রি না করা ইত্যাদি৷
আসলে পুরো মামলাটি বিশ্বাস ও ভাবাবেগের ওপর দাঁড়িয়ে ছিলো। 500 বছর ধরে বিতর্ক চলছে৷ মহাকাব্য রামায়ণে বলা হয়েছে অযোধ্যা রামজন্মভূমি৷ মোগল যুগে সেখানে মসজিদ তৈরি হয়৷ তারপর প্রায় সাড়ে 300 বছর ধরে মন্দির না মসজিদ তাই নিয়ে টানাপোড়েন চলেছে৷ তবে, আইনি লড়াই শুরু হয় ভারতে ব্রিটিশ শাসন শুরু হওয়ার পর৷ এরপর কেটে গেছে 134 বছর৷ 1885 সালে বিতর্কিত জমির বাইরে শামিয়ানা টাঙিয়ে রামলালার মূর্তি স্থাপনের আবেদন জানান মহন্ত রঘুবীর দাস৷ আর্জি খারিজ করে দেয় ব্রিটিশ আদালত৷ 1959 সালে বিতর্কিত জমির মালিকানা দাবি করে নির্মোহী আখড়া৷ 1950 সালে বিতর্কিত জমিতে রামলালার পুজোর অনুমতি চেয়ে মামলা হয় ফৈজাবাদ আদালতে৷ 1981 সালে জমির মালিকানা দাবি করে আদালতে মামলা করে সেন্ট্রাল সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড৷ 1986 সালে পুজোর জন্য বিতর্কিত কাঠামোর দরজা খুলে দিতে নির্দেশ দেয় ফৈজাবাদ আদালত৷ আবার 1989 সালে বিতর্কিত জমিতে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার নির্দেশ দেয় এলাহাবাদ উচ্চ আদালত৷
এই পর্যন্ত চলছিল আইনি লড়াই৷ তারপর যা ঘটেছে তা ভারতের ইতিহাসে কলঙ্কিত অধ্যায় বলে অনেকে দাবি করেন৷ 1992 সালের 6 ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ভেঙে দেওয়া হয়।
1993 সালে দেশের সংসদে আইন পাস করে অযোধ্যার ওই বিতর্কিত জমির দখল নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার৷ 2010 সালে এক মামলার রায়ে এলাহাবাদ হাইকোর্ট জানায়, জমিটি তিনভাগ করা হোক৷ দাবিদার রাম লালা, সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড এবং নির্মোহী আখাড়ার মধ্যে সমান ভাগে ভাগ করা হোক৷ সেই রায়ের বিরোধিতা করে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানায় মামলাকারী তিনটি পক্ষই৷ তারপর সুপ্রিম কোর্ট 2011 সালে হাইকোর্টের রায়ে স্থগিতাদেশ দেয়৷
এরপরেও ঘটনা থেমে থাকেনি৷ 2017 সালে 7 আগস্ট মামলার শুনানির জন্য 3 বিচারপতির বেঞ্চ গঠন করে সুপ্রিম কোর্ট৷ 5 ডিসেম্বর তৎকালীন প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র, বিচারপতি অশোক ভূষণ এবং বিচারপতি এস আব্দুল নাজিরের বেঞ্চে নতুন করে মামলার শুনানি শুরু হয়৷ 2018 সালের 29 আগস্ট নতুন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের নেতৃত্বে ফের নতুন করে তিন সদস্যের বেঞ্চ গঠত হয়৷ 2019 সালের 8 জানুয়ারি প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের নেতৃত্বে নতুন করে পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ তৈরি হয়৷ গত 6 আগস্ট থেকে প্রতিদিন অযোধ্যা মামলার শুনানি চলেছে৷ এই মামলার প্রধান বিবেচ্য বিষয় ছিলো, অযোধ্যার বিতর্কিত জমিটি কার হাতে যাবে?

শেষ পর্যন্ত এই মামলার রায় তো ঘোষিত হলো, এখন প্রশ্ন, এই রায় সর্বস্তরে কি মান্যতা পাবে ? নাকি ফের শুরু হবে নতুন কোনও বিতর্ক, মামলা, রাজনীতি?

Previous articleসুপ্রিম রায়: অযোধ্যার বিতর্কিত জমি রামলালার
Next articleসুপ্রিম কোর্টে জয় শ্রীরাম ধ্বনিতে উত্তেজনা