
এ সব কি বাস্তবোচিত ভাবনা-চিন্তার প্রকাশ ? না, স্রেফ রাজনৈতিক জেদের বহি:প্রকাশ ?

অর্থনৈতিক দিক থেকে যখন ক্রমশ কোমর ভাঙ্গছে দেশের, তখনই জানা যাচ্ছে, শুধুমাত্র অসমে NRC-র জন্য খরচ হয়েছে 1600 কোটি টাকা৷ এর মধ্যেই সম্ভবত ওই রাজ্যে NRC-র দায়িত্বে থাকা প্রতীক হাজেলা-র বিরুদ্ধে ওঠা আর্থিক দুর্নীতির টাকাও ধরা আছে৷
আর এর পর কেন্দ্রের হুমকি অনুযায়ী যদি দেশের 28টি রাজ্য এবং 9টি কেন্দ্রশাসিত এলাকায় এই NRC
করতে হয়, তবে মোট খরচ হবে 60 থেকে 65 হাজার কোটি টাকা। এই বিপুল পরিমাণ টাকা জলাঞ্জলি দেওয়ার বিলাসিতা করার আর্থিক সবলতা কি এ দেশের আছে ?

এসব যদি আলোচনা থেকে বাদও দিই, তাহলেও প্রশ্ন ওঠে, চোখ কপালে তোলা এই বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ করলেই যে অবৈধ অভিবাসী বা Immigrant- দের হাত থেকে দেশ ‘রক্ষা’ পাবে, এমন তো আদৌ নয়৷ অসমের NRC-র ভবিষ্যত কী? প্রকাশিত রিপোর্ট গ্রহন করা হচ্ছে, না খারিজ হচ্ছে ? কোনও স্তর থেকেই তো চূড়ান্ত কোনও বার্তা দেওয়া হচ্ছে না৷ অসমের ‘NRC- কেলেঙ্কারি’-র কথা তো প্রকাশ্যেই চলে এসেছে৷ যে কোনও রহস্যজনক কারনেই হোক, সেই প্রতীক হাজেলা নামক রত্নটিকে দেশের শীর্ষ আদালত অসম থেকে সরিয়ে দিয়েছে এবং তার পরেই অসমের NRC- কোঅর্ডিনেটর হাজেলার বিরুদ্ধে কয়েকশো কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ করেছে অসম পাবলিক ওয়ার্কস। অভিযোগের তির প্রতীক হাজেলার দিকে। সুপ্রিম কোর্টে মামলাও দায়ের হয়েছে। CBI-এর দুর্নীতিদমন শাখায় FIR দায়ের হয়েছে। প্রতীক হাজেলার বিরুদ্ধে FIR হলেও, আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে গোটা NRC দপ্তরের বিরুদ্ধেই।

NRC দফতরে বহু কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন খোদ অসমের অর্থমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা। হিমন্ত অন্য কোনও রাজনৈতিক দলের নেতা নন৷ মোদিজি বা অমিত শাহ যে দলের প্রতিনিধি, হিমন্তও সে দলেরই৷ হিমন্ত সাধারন বিজেপি কর্মীও নন, তিনি অসমের অর্থমন্ত্রী ৷

অসম-NRC রিপোর্টে 19 লক্ষ হিন্দুর নাম বাদ যাওয়ার পর এবং কর হিসাবে জনগনের দেওয়া 1600 কোটি টাকা ধ্বংস করার পর চৈতন্য হয়েছে বিশ্ব শর্মার৷ এখন সেই NRC- রিপোর্ট নিয়ে হিমন্ত বিশ্ব শর্মার প্রশ্ন তোলা এক ধরনের দ্বিচারিতা৷ 19 লক্ষ হিন্দুর নাম বাদ যাওয়ায় বিজেপি’র সাধের NRC এখন বিজেপি’র গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ ফাঁটা বাঁশে বিজেপির সবকিছু আটকে গিয়েছে৷ এখন বিজেপি’র তরফে জোর চেষ্টা চলছে, ওই রিপোর্ট খারিজ করার৷ সেকারনেই অন্য ইস্যুতে আসরে নেমেছেন হিমন্ত বিশ্ব শর্মা৷ এবং প্রমান করতে চলেছেন, অসমে NRC করতে গিয়ে কয়েকশো কোটি টাকার কেলেঙ্কারি হয়েছে৷ যাতে 1600 কোটি টাকা খরচ করে তৈরি করা এবং ব্যুমেরাং NRC -রিপোর্টটি বাতিল করে।

বৃহস্পতিবার ফের হিমন্ত বিশ্ব শর্মা CAG বা ক্যাগ রিপোর্টের কয়েকটি পাতা প্রকাশ করে বলেছেন, NRC দফতরে চালানো CAG সমীক্ষার রিপোর্ট তাঁর হাতে রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে NRC চলায় তা প্রকাশ করতে পারেননি। 2014 থেকে 2017 সাল পর্যন্ত চালানো ওই অডিট রিপোর্ট অন্তর্বর্তীকালীন। সেখানে বলা হয়েছে, 4 বছরে কেন্দ্রের কাছ থেকে NRC দফতর মোট 905 কোটি 72 লক্ষ টাকা পেলেও 806 কোটি 16 লক্ষ টাকার খরচ দেখানো হয়েছে। বাকি টাকার হিসেব দাখিল হয়নি।

NRC-র বরাত পাওয়া উইপ্রোকে আগাম 52 কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। ফলে প্রায় সাড়ে 9 কোটি টাকার সুদ নষ্ট হয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নাগরিক সেবাকেন্দ্র চালু করতে না পারলেও তাদের কাছ থেকে 2 কোটি 91 লক্ষ টাকার জরিমানা নেওয়া হয়নি। আগাম সমীক্ষার ভুলে 1500-র বদলে 2500টি সেবাকেন্দ্র তৈরি করতে হয়। ওর্যাকল সফটওয়্যার কেনা বাবদ 1 কোটি 27 লক্ষ টাকা খরচ দেখানো হলেও NRC-র সিস্টেমে ওই সফটওয়্যারের কোনও সন্ধানই মেলেনি। বাজারদরের চেয়ে বেশি দামে প্রিন্টারের কালি কেনায় 19 কোটি 43 লক্ষ টাকার ক্ষতি হয়েছে।

রিপোর্টে বলা হয়েছে, উইপ্রো যে নিউজেন ওমনিফ্লো সফটওয়্যার কেনা বাবদ 69 লক্ষ 94 হাজার টাকা নিয়েছে সেই সফটওয়্যারের মালিকানা এখনও নিউজেনের হাতেই রয়েছে। আইটি পরিকাঠামোর জন্য ল্যাপটপ, ক্যামেরা, স্ক্যানার, প্রিন্টার, ওয়েবক্যাম ইত্যাদি বাজারদরের চেয়ে বেশি দামে কেনা হয়েছে। সেগুলির চালান ও ক্যাশমেমোও জমা দেওয়া হয়নি। NRC-র বিভিন্ন সামগ্রী কেনায় বড় গরমিল ও টাকা নয়ছয়ের অভিযোগ তুলে NRC মামলার মূল আবেদনকারী অসম পাবলিক ওয়ার্কস ইতিমধ্যেই CBI-এর দুর্নীতি দমন শাখায় অভিযোগ দায়ের করেছে। অর্থাৎ পরিস্থিতি এখন এমনই যে বিজেপি’র পরম সাধের NRC নিয়ে CBI তদন্ত পর্যন্ত হতে চলেছে।

দেশে NRC-কনসেপ্টের প্রবক্তারা এর দায় এড়াতে পারেন না৷ তাই এখন প্রশ্ন উঠবেই, এই কেলেঙ্কারির দায় কে নেবে?

মাথায় রাখতে হবে, 1600 কোটি টাকার এই NRC- কেলেঙ্কারি শুধুমাত্র দেশের একটি মাত্র রাজ্য অসমে ঘটেছে।

কেন্দ্রীয় সরকার সমানে হুমকি দিয়ে চলেছে, গোটা দেশজুড়ে এই NRC হবে৷ সত্যিই যদি দেশের 28টি রাজ্য এবং 9টি কেন্দ্রশাসিত এলাকায় এই NRC হয়, তবে মোট খরচ হবে 60 থেকে 65 হাজার কোটি টাকা। এই টাকার সঠিক খরচের নিশ্চয়তা কে দেবেন? না’কি 60-65 হাজার কোটি টাকার দেশের বৃহত্তম কেলেঙ্কারি দেখা এবং শোনার জন্য দেশবাসীকে ‘সাগ্রহে’ অপেক্ষা করবেন ?
