হিন্দিভাষী দল বিজেপি হারলো হিন্দিভাষী ঝাড়খণ্ডেও, কণাদ দাশগুপ্তর কলম

কণাদ দাশগুপ্ত

দেশের আর পাঁচটা রাজ্যে হেরে যাওয়ার সঙ্গে ঝাড়খণ্ডে বিজেপির হেরে যাওয়ার ফারাক আকাশ-পাতাল৷ বিজেপির তথাকথিত স্বঘোষিত “বুদ্ধিজীবী বা থিঙ্ক ট্যাঙ্ক” বাহিনী এটা ধরতেই পারছেন না৷ বিপদটা যে বিপজ্জনক সীমানা ছুঁয়ে ফেলেছে ঝাড়খণ্ডের ফলপ্রকাশের পর তা ধরা পড়েছে৷

বিজেপি মূলত হিন্দিভাষী দল‌৷ এ কথা গেরুয়া- বাহিনী ইদানিং পছন্দ করছে না৷ তাতে কিছু যায় আসে না৷ বাস্তব এটাই৷ ঝাড়খণ্ড হিন্দিভাষী রাজ্য৷ তো, একটি হিন্দিভাষী রাজ্য হিন্দিভাষী দল‌টিকে হুক করে সীমানার বাইরে কেন পাঠালো, পদ্ম-শিবির তা ভেবে দেখার সময় পেয়েছে ? হিন্দিভাষী রাজ্যেই বিজেপিকে শূন্য হাতে ফেরানো হলো, গেরুয়া শিবিরের পক্ষে এটা নিশ্চিতভাবেই অশনি সংকেত৷ বিজেপি’র USP-র বনিয়াদেই হাতুড়ির ঘা পড়েছে৷ সৌধের স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন তো উঠবেই৷

2019 সালের লোকসভা নির্বাচনের ফল বিজেপি- বিরোধীদের প্রায় ঘরে তুলে দিয়েছিলো। আর তার ছ’মাসের মধ্যেই বোঝা গিয়েছিলো রাজনীতিতে স্থায়ী বলে কোনও শব্দ নেই৷ পরিবর্তনের হাওয়ায়
একের পর এক রাজ্যে উড়ে গেলো বিজেপি৷ বিজেপির শীর্ষস্তরের নির্দেশে মহারাষ্ট্রে কাকভোরে শপথ নিয়েছিলেন বেচারা ফড়নবিশ৷ ‘বাতিল’ রাজনীতিক শরদ পাওয়ারের চালে চাণক্যদের হাতে উঠলো ফুটো বাটি৷ প্রমান হলো, রাজনীতিতে সব খেলা পিছনের বন্ধ ঘরে বসে হয় না৷
মহারাষ্ট্রে পর ঝাড়খন্ড৷ ঝাড়খন্ডেও ক্ষমতা ধরে রাখতে পারলেন না মোদি-শাহ৷ মজার বিষয়, এই রাজ্যে পরাজিত হওয়ার পর যাবতীয় দায় সদ্য প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী রঘুবর দাসের ঘাড়ে চাপিয়ে, শীর্ষনেতারা “স্বচ্ছ” থাকার প্রাণান্তকর খেলায় নেমে পড়েছেন৷
ঝাড়খণ্ডে হারের জন্য রঘুবর দাসকেই দুষছে গোটা গেরুয়া শিবির৷ হেরে যাওয়ার পর বিজেপির চৈতন্য হয়েছে
রঘুবর দাস নাকি অযোগ্য, অদক্ষ, অপদার্থ ছিলেন৷ এসব ভণ্ডামি অর্থহীন, স্রেফ কমিক-রিলিফ৷ ওই রাজ্যে বিজেপি জিতে গেলে তো এসব কথা উঠতো না৷ তখন তো এই “অযোগ্য, অদক্ষ” রঘুবর দাসকেই অভিনন্দন জানাতেন মোদি-শাহ৷ এই রঘুবরকেই ঢাক-ঢোল পিটিয়ে মুখ্যমন্ত্রী করতেন মোদি-শাহ৷ রঘুবরের মাইনাস-পয়েন্ট হিসেবে
এখন যে সব কথা বিজেপি দলের তরফে এবং ওই দলের অর্ধশিক্ষিত স্বঘোষিত বুদ্ধিজীবীদের মুখে উঠে আসছে, সে সব বিবেচনায় আনা হতো? অন্য কাউকে মুখ্যমন্ত্রী করতেও পারতেন না, কারন এই রঘুবরকে প্রজেক্ট করেই তো বিজেপি ভোটে গিয়েছিলো৷ এক নেতা অযোগ্য জেনেও তাঁর বিকল্প কেন গোটা ঝাড়খণ্ডে খুঁজে পেলেন না মোদি-শাহ? অসৎ-অদক্ষ একজনের হাতে একটা রাজ্যের ভার তুলে দিতে দু’বারও ভাবলেন না টিম-মোদি৷ এই সিদ্ধান্ত কি “BJP – The Party with a Difference”-এর বহু প্রচারিত ‘ট্যাগ-লাইন’- এর সঙ্গে মানানসই ? কী বলবেন বিজেপি’র তথাকথিত ‘থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক’- বাহিনী ?
এবার আসা যাক রঘুবর দাসের বিরুদ্ধে আনা
বিজেপি’র অভিযোগের দিকে৷ বিজেপি’র অভিযোগ, দাম্ভিক
রঘুবর অর্জুন মুন্ডার মতো জনপ্রিয় আদিবাসী নেতাকে সাইড করেছে, বিজেপি-র শরিক আজসু নেতা সুদেশ মাহাতোকে পাত্তা দেয়নি, দলের ছোট- বড় কোনও নেতার সঙ্গেই সদ্ভাব নেই, প্রশাসন পরিচালনায় অদক্ষ, শুধু আশ্বাস আর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ইত্যাদির মাশুলই দিতে হলো বিজেপিকে৷ এই সব কারনই নাকি ভোটে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। প্রাথমিক ময়না তদন্তে এমনই নাকি বুঝেছে বিজেপি৷ হাস্যকর সব অজুহাত৷ আজ যে সব অভিযোগ রঘুবর দাসের বিরুদ্ধে আনা হচ্ছে, এক এক করে ধরে ধরে তার সব ক’টি অভিযোগই তো নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহের বিরুদ্ধে প্রবলভাবে আছে৷ দম্ভ, দলের বরিষ্ঠ নেতাদের পাত্তা না দেওয়া, কিছু নেতাকে একঘরে করে দেওয়া, খামখেয়ালি আচরণ, জোটধর্ম বজায় না রাখা, ইত্যাদি সব দোষে অভিযুক্ত নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহ৷ এ সব কারনে যদি দলকে হারতে হয়, তাহলে, আগাম সতর্ক হয়ে এই দুই নেতাকে বর্জন করার আওয়াজ উঠছে না কেন বিজেপির অন্দর থেকে ? এ সব তো ভণ্ডামি ৷ জাতীয়স্তরে বিজেপি’র এবং বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকারের (আরও স্পষ্টভাবে বললে মোদি-শাহের সরকারের৷ বাকিদের এক আনাও দাম নেই৷ পদ শূন্য রাখা যায় না, তাই কিছু লোকজনকে সামিল করা হয়েছে) ধারাবাহিক কিছু ভুল পদক্ষেপ আজ মানুষের মন থেকে বিজেপিকে উৎখাত করে দিচ্ছে৷ এটা বিজেপির প্রকৃত নেতা-কর্মী অবশ্যই বুঝতে পারছেন৷ এই তালিকায় অবশ্যই ‘দৃষ্টিহীন’-রা নেই৷ আর নেই Sycophant-রা৷ মানুষ কোনওকালেই বোকা ছিলেন না৷ দফায় দফায় সাধারন মানুষই কংগ্রেসের বিকল্প হিসাবে
মোরারজি দেশাই, চৌধুরি চরণ সিং, বিশ্বনাথপ্রতাপ সিং, চন্দ্রশেখর, অটল বিহারী বাজপেয়ী, এইচডি দেবগৌড়া, ইন্দ্রকুমার গুজরাল, ফের অটল বিহারী বাজপেয়ী, নরেন্দ্র মোদি এবং ফের নরেন্দ্র মোদিকে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে এনেছেন৷ সাধারন মানুষ যে সবকিছুই বোঝোন, সেটা রাজনীতিকরাই বোঝেন না৷ তাঁরা ভাবেন, “আমাদের কথাই গীতা, বাইবেল, কোরান৷ আমরা যা বলবো, বোঝাবো, সেটাই পাবলিক খাবে”৷ বিষয়টা এতো সহজ এবং সস্তা হলে,এ দেশে ভোটের দরকারই হতো না৷ রঘুবর দাস নামে বিজেপির এক নগন্য নেতার ঘাড়ে দোষ না চাপিয়ে ঝাড়খণ্ডে পরাজয়ের দায় নতমস্তকে নিজেদের কাঁধে নেওয়া উচিত মোদি-শাহের৷ দেশজুড়ে অস্থির পরিস্থিতি ডেকে আনছেন তো এনারাই৷ নগর পুড়লে দেবালয়ও এড়ায় না‌৷ কেন্দ্রের খামখেয়ালি, অপরিনত, জেদি, দাম্ভিক সিদ্ধান্তের খেসারত বিজেপিকেই তাই দিতে হচ্ছে৷ সে কারনেই গত ডিসেম্বরে 19 রাজ্যে ক্ষমতায় থাকা বিজেপি এই ডিসেম্বরে 12-13তে নেমেছে৷ এই 12-13-র মধ্যে আছে উত্তর-পূর্বের ছোট ছোট রাজ্যগুলি৷ এগুলো আছে বলে সংখ্যাটা দু’ডিজিটে গিয়েছে৷

দায় এড়িয়ে লাভ নেই৷ শুধুমাত্র বসুন্ধরা সিন্ধিয়া, রমন সিং, শিবরাজ সিং চৌহান, ফড়নবিশ বা রঘুবর দাসের দোষেই বিজেপি একের পর রাজ্য থেকে উৎখাত হয়ে যাচ্ছে, এমন ধারনা হলে, তা হবে ভাবের ঘরে ডাকাতি করার সামিল৷ বিজেপির শীর্ষস্তর কিন্তু এই ‘চুরির’ কাজটাই কলার তুলে করে চলেছে৷

বিজেপি টাটকা হাতছাড়া করেছে ঝাড়খণ্ড৷ পরবর্তী ‘স্টেশন’ দিল্লি এবং বিহার৷
2014 সালে কেন্দ্রের ক্ষমতায় বিজেপি এলেও, দিল্লির ক্ষমতা দখল করতে পারেনি। এবারও বিজেপি একের পর এক রাজ্যে হারছে৷ সেই পরিস্থিতিতে দিল্লির ক্ষমতায় থাকা অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে সরিয়ে দেওয়া কতটা সহজ হবে, বিজেপি এখন ভাবুক৷
বিহার নিয়েও বিজেপির অন্দরে খুশির হাওয়া নেই৷ সাম্প্রতিক একাধিক উপনির্বাচনে RJD এবং কংগ্রেসের জোট NDA-জোটকে হারিয়ে অনেক আসনে জয়লাভ করেছে৷ অন্যদিকে নীতিশ কুমারও আর কতদিন ‘একদিকে’ থাকবেন, সেটাও দেখার৷ সব মিলিয়ে বিহার জয়ও বিজেপির কাছে সহজ নয়৷
বিজেপিকে আজ বুঝতে হবে, একের পর এক রাজ্যে বিজেপি যেভাবে হারতে শুরু করেছে বাংলায় তার প্রভাব পড়বেই৷ বাংলার ভোট একুশে হওয়ার কথা৷ বিজেপি এইভাবে হারার রেকর্ড ধরে রাখলে বাংলার মানুষ ফের তৃণমূলের পক্ষেই রায় দেবে। বিজেপির ঘুরে দাঁড়াতে আরও পাঁচ বছর৷

তবে অন্যান্য ‘হেরো’ রাজ্যের ময়না তদন্ত মোদি-শাহ পরে করবেন, আগে দেখুন ‘ব্র্যান্ডেড’ হিন্দিভাষী দল হয়েও হিন্দিভাষী রাজ্য ঝাড়খণ্ড থেকে কেন বিজেপিকে পাততাড়ি গোটাতে হলো৷ “নিরপেক্ষ” তদন্ত হলে দায়ি হিসেবে
রিপোর্টে জ্বল জ্বল করবে নরেন্দ্র মোদি আর অমিত শাহের নামই৷ সেই ‘দোষ’-এর সাজা মোদি-শাহকে দলের কে দেবেন ?

Previous articleঝাড়খন্ড বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থীরা কেমন ফল করেছেন
Next articleব্রেকফাস্ট নিউজ