নায়িকার ছেঁড়া পোশাকেই নাটকের নির্মাণ-বিনির্মাণ, কুণাল ঘোষের কলম।

কুণাল ঘোষ

আজকের লুপ্ত ও রুদ্ধ প্রতাপ মঞ্চের সাইনবোর্ডহীন বাড়িটা দেখে বোঝা যাবে না, একসময় সেটি জন্ম দিয়েছে এক বিপ্লবকে; সাফল্যের নতুন সংজ্ঞা দিয়েছে মঞ্চের নাটককে এবং পরিসমাপ্তিতে রেখে গেছে অনিঃশেষ যন্ত্রণার উপেক্ষিত অনুভূতি।

ছেলেবেলায় টাকি বয়েজ স্কুল থেকে হেঁটে ফেরার পথে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর দেখতাম প্রতাপে প্রবলপ্রতাপে চলছে “বারবধূ।” সব হলে নাটক, সিনেমা বদলায়, এখানে বদল নেই।

আর বদল যখন এলো, তা এল ধ্বংসের নেশায়।

বারবধূ নেই। প্রতাপও নেই।

কেন নেই, সেই উপেক্ষিত ইতিহাসটি নতুন করে মঞ্চে হাজির করেছেন পাইকপাড়া ইন্দ্ররঙ্গ, ব্রাত্য বসুর অভিভাবকত্বে, “অদ্য শেষ রজনী” নাটকে। আমার আগে দেখা হয় নি। চৌষট্টিতম অভিনয়টি দেখার সৌভাগ্য হল।

এটি নাটক? নাকি সময়ের দলিল? কিংবা নাট্যজগতের ময়নাতদন্ত?

রক্তমাংসের নাট্যসংগঠক ও অভিনেতা আজকের বিস্মৃত অসীম চক্রবর্তী এই নাটকে অমিয়। একসময় ব্রেখট বা আর্থার মিলারের সঙ্গে পরিচয় করানো অসীম তাঁর চতুর্মুখ দলটিকে নিয়ে মঞ্চে এনেছিলেন সুবোধ ঘোষের “বারবধূ।” গ্রুপ থিয়েটারের ঘরানা ভেঙে নতুন আঙ্গিকে, যেখানে শিল্প ও সৃষ্টির সঙ্গে সমান লক্ষ্য, থিয়েটার ব্যবসা করবে। শুধু নেশা নয়, পেশাও হবে। থিয়েটার থেকেই চলবে এত কর্মীর সংসার।

“বারবধূ” সর্বকালীন রেকর্ড। জনপ্রিয়তায় ও বিতর্কে।
বিতর্ক, কারণ তকমা লেগে যায় অশ্লীলতার। অন্তরঙ্গ মুহূর্তগুলি যথেষ্ট আবেগে সাহসের সঙ্গে উপস্থাপনা। একবার একটি দৃশ্যে কিছুটা আবেগের অতিরিক্ত প্রকাশে নায়িকার পোশাকের একটি অংশ ছিঁড়ে যায়; পরে অসীম অভিনেত্রী কেতকী দত্তর সঙ্গে কথা বলে সেই মুহূর্তটিকে রোজকার অভিনয়ে ঢুকিয়ে নেন। বিজ্ঞাপনে বলেন “ব্লো হট” নাটক।

ফলাফল দুরকম: হাউস ফুল এবং সমালোচনা।

একদিকে থিয়েটারের সব রেকর্ড ভাঙা জনপ্রিয়তা।
অন্যদিকে ছি ছি রব।

অথচ নাটকটি অশ্লীল ছিল না। ছিল অসাধারণ গল্প আর সেটা ফুটিয়ে তোলা অভিনয়। কিন্তু দশচক্রে ভগবানও ভূত হন!

সেসময় হাতিবাগানপাড়ার যৌনতাসর্বস্ব কিছু স্থূল নাটকের কারবারিরা শঙ্কিত হলেন। গ্রুপ থিয়েটারের সনাতনী পতাকাবাহী একাংশ ঈর্ষান্বিত হলেন। নাটক যারা দেখলেন, এমনকি উত্তমকুমারও, বললেন অসাধারণ। আর নাটক না দেখেও নীতিকথার আড়ালে অনেকে নাটক বন্ধ করতে বললেন, যেমন তৎকালীন তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। চূড়ান্ত প্রতিকূলতার মধ্যে ধাক্কা খেতে খেতে চুরমার হয়ে গেলেন অসীম। আঁতেলরা বুঝেও বুঝলেন না, সাহসী দৃশ্য একটি মুখোশমাত্র; তার তীব্রতা থেকেই জন্ম নিয়ে একটা চরিত্রের চোখের জল।

সেই অসীমের প্রতিনিধিত্ব করে আজকের অমিয় মঞ্চে প্রশ্ন তুলছেন,” উদ্ভাবনী শক্তির কি কোনও দাম নেই ? সবটাই ঘিরে রাখবে মিডিওক্রেসি?”

অসীম কিংবা অমিয় ভাবাচ্ছেন,” অভিনেতা চরিত্রকে গ্রাস করে, নাকি চরিত্র অভিনেতাকে?” কিংবা,” থিয়েটারকে তোমরা বাঁধবে নিয়মে?”

শুধু শ্লীল-অশ্লীল ন্যায়নীতির সংঘাত নয়; অভিনেতা-অভিনেত্রীর ব্যক্তিগত সমীকরণ কতটা গাঢ় হলে পরের পর শো সফল জুটিতে করা যায়, কিংবা পরপর শো করতে করতে জুটির সমীকরণ কীভাবে চিরত্রের মোড়ক ভেঙে রক্তমাংসের জীবনে ঢুকে পড়ে, তাও দুর্দান্তভাবে ফুটিয়ে তুলেছে আজকের এই নাটক।

অমিয় বলছেন,” আমি সব স্কিল রিহার্সালে দেখাই না।”
এই সূত্রেই নাটকীয়তার দিকে এগিয়ে চলে অভিনয়।

উপন্যাস শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। নাটক উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়। পরিমার্জনা ও নির্দেশনা ব্রাত্য বসু।

অমিয়র ভূমিকায় অনির্বাণ ভট্টাচার্য অসাধারণ। গোটা সময়টা মঞ্চে দাপিয়ে বেড়ালেন। কতরকম শেড। কতগুলো চরিত্র। কখনও আসল অমিয়। কখনও নাটকের প্রসাদ রায় , কিংবা বৃহন্নলা রক্তপিপাসু সম্রাট কিংবা কর্মচ্যুত সেলসম্যান। অনির্বাণ যে কত শক্তপোক্ত অভিনেতা, সেটা মঞ্চেই প্রমাণিত। এত অল্পসময়ে এতবার নিজেকে ভাঙচুর করে আরেকটা মানুষকে বার করে আনা, কম কথা নয়।

অভিনেত্রী রজনীর ভূমিকায় দেবযানী চট্টোপাধ্যায় আর অমিয়র স্ত্রী মালার ভূমিকায় অঙ্কিতা মাজির কাজটাও সহজ ছিল না। তাঁরা যথাযথ। দেবযানী নাটকের মধ্যে নাটকে লতার অংশে অনবদ্য। অমিয়, মালা, রজনীর সম্পর্কজনিত জটিল রসায়ন এমন দক্ষতায় এঁরা ফুটিয়ে তুললেন, প্রশংসার দাবি রাখে। নাট্যসমালোচক অভিনেতাটি চমৎকার। মঞ্চসজ্জায় একটি আস্ত ট্রামের উপস্থিতি সুন্দর; প্রতাপ মঞ্চের প্রতিনিধিত্ব করেছে বলাই ভালো।

পাইকপাড়া ইন্দ্ররঙ্গের কর্ণধার ইন্দ্রজিত চক্রবর্তী ও তাঁর দলের সদস্যদের অভিনন্দন এমন একটি প্রয়োজনীয় ও সাহসী উপস্থাপনা মঞ্চস্থ করার জন্য। চরিত্র ও নীতিনৈতিকতার বিতর্ক নিয়ে জলঘোলা নতুন নয়; তাকে এড়িয়ে না গিয়ে সামনে এনে ফেলাটা দরকার ছিল। নির্মাণ ও বিনির্মাণের অনিবার্য ধারাবিবরণী।

এবং অসীম চক্রবর্তী। যাঁর শিরা, ধমনীর প্রতিটি রক্তবিন্দুতে ছিল থিয়েটার। পরের পর পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন। শেষে “বারবধূ” তাঁকে সাফল্য দিয়েছে ; আবার সমালোচনা, বিরোধিতা, চক্রান্তে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। প্রসাদ রায়কে আত্মস্থ করার মত বিষপান করে তিনি নিজের জীবন নিয়েও ঝুঁকির খেলা খেলেছেন। এবং সবকিছু থেমে গেছে মাঝপথে, অতীতের গর্ভে।

“অদ্য শেষ রজনী” চলতে থাকুক।
নাটকের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা সেদিনের নাটক আর চিরন্তন জীবনকে নিয়ে আজকের আরেক নাটক এই প্রজন্মকে দেখিয়ে দিক উপেক্ষিত ইতিহাসকে।
শততম রজনীর আগাম শুভেচ্ছা।

( বৃহস্পতিবার মহাজাতি সদনে নাটকটি দেখলাম। ইউকো ব্যাঙ্ক স্টাফ ক্লাবের নাট্যোৎসবে আমন্ত্রিত শো। সৌজন্যে: ইন্দ্রজিত ও পৃথ্বীশ)।

Previous articleNRC ও CAA–‌র বিরুদ্ধে আজ শিলিগুড়ির রাজপথে মমতার মহামিছিল
Next articleকাল ময়দানে দুই ভাইয়ের লড়াই, জিতবেন কে!