‘Un-popular হয়ে পড়লে লুকোচুরি খেলতেই হবে, কণাদ দাশগুপ্তের কলম

কণাদ দাশগুপ্ত

কতখানি ‘আন-পপুলার’ হয়ে পড়লে এভাবে লুকোচুরি খেলতে খেলতে দেশের একটি রাজ্য সফরে আসতে হয়, আজ কি উনি বুঝতে পারছেন ?

ফুটোহীন নিরাপত্তা বলয়ে থাকা, ঘোরা, ভাষন দেওয়া খুব সহজ৷ পাড়ার রামু-ও তা পারবে৷ কিন্তু জনতার প্রতিনিধি হয়েও জনতার মুখোমুখি হতে ভয় পেলে, বুঝতে হবে চিড় ধরেছে
আত্মবিশ্বাসেই৷ এ ধরনের পদে বসার অন্যতম প্রধান অলিখিত শর্ত,
থাকতে হবে একটা অন্যরকম আত্মবিশ্বাস৷ ইদানীং দেখা যাচ্ছে ওনার
সেই আত্মবিশ্বাসে অভাব হচ্ছে৷ আর অভাব হচ্ছে বলেই তা মেটাতে দরকার হচ্ছে ‘আইওয়াশ’৷ দরকার হচ্ছে লুকোচুরি খেলা৷ ফৌজি ঘেরাটোপও মজবুত করতে হচ্ছে৷ এবং সবাই সব ধরে ফেলছে৷

তাহলে এই বাংলা সফরে কতখানি মান বাড়ছে তাঁর ? পদমর্যাদাই বা বজায় থাকছে কতদূর?

সামগ্রিক পরিস্থিতি একবার ফিরে দেখুন৷ দু-তিনদিন আগে দেশের প্রধানমন্ত্রীকে দেশেরই একটি রাজ্য সফর বাতিল করতে হয়েছে বিক্ষোভের ভয়ে৷
আর একটি রাজ্য সফরে সেই বিক্ষোভের ভয়েই ২২ ঘন্টা ধরে টানা চলবে লুকোচুরি খেলা৷ এর পরেও ওনার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না ?

মাথাগুনতিতে সংসদে বৃহত্তম দল বিজেপি৷ সেই দলের নেতা হিসেবে দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসেছেন তিনি৷ আর দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর প্রথমবার তাঁর বাংলা-সফর৷ তাঁকে স্বাগত জানাতে জনমানসে কোনও স্বতস্ফূর্ততা নেই৷ আসা, হাসা, হাত নাড়ানো, কথা বলা, খাওয়া, ঘুম- সবটাই ফৌজ-নিয়ন্ত্রিত, রোবোটিক৷ VVIP- কর্মসূচিতে অবশ্যই বাধা-নিষেধ থাকবে৷ এরাজ্য অসংখ্য VVIP-র আসা-যাওয়া দেখেছে৷ কিন্তু বিপুল জন-সমর্থন নিয়ে ক্ষমতার শীর্ষ পদ অলঙ্কৃত করার ৭-৮ মাসের মধ্যেই যাকে এভাবে জনবিচ্ছিন্ন হতে হয়, তিনি আর যাই হোন, “জনতার নেতা” হন না৷

এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর বিরোধিতাও তো কম হয়না৷ তাঁর সব সিদ্ধান্তই যে মানুষ দু-হাত তুলে নাচতে নাচতে মেনে নেন, এমনও নয়৷ বিতর্কিত সিদ্ধান্ত মাঝে মধ্যে তিনিও নেন৷ বাংলার সব মানুষই যে তাঁর অন্ধ ভক্ত, তাও নয়৷ কিন্তু প্রতি মুহুর্তে তিনি আছেন জনতার সঙ্গেই৷ বিধি মেনে কিছু নিরাপত্তা অফিসার থাকতে হয় মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে, তাই তাঁরা আছেন৷ মুখ্যমন্ত্রীর নিরাপত্তায় অতি-সক্রিয়তা কখনই দেখা যায়নি৷ এর একমাত্র কারন, তাঁর আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরেনা৷ যে মানুষের সমর্থনে অথবা বিরোধিতায় তিনি ক্ষমতায় এসেছেন, সেই মানুষকে তিনি দূরে সরাননি৷ জননেতা বা জননেত্রীর সংজ্ঞা তো এমনই৷

দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হয়ে এই প্রথম তাঁর রাজ্য সফর৷ অথচ তাঁকে অভিনন্দন বা স্বাগত জানানোর মানুষ নেই৷ মানুষকে ভিড়তেই দেওয়া হচ্ছেনা৷ প্রোটোকল মানা কিছু ফুল-মালাই আজ তাঁর সঙ্গী৷ নিঃসন্দেহে দুর্ভাগ্যজনক ৷ তিনি তো এ দেশের প্রধানমন্ত্রী, কোনও বিদেশি রাষ্ট্রনায়ক বা সেনাপ্রধান নন৷ তাহলে, তাঁকে এভাবে জনবিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে কেন? তিনিই বা তা মেনে নিচ্ছেন কেন? যাত্রাপথে কেউ যদি গণতান্ত্রিক রীতি মেনে তাঁর বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়, কালো পতাকা দেখায়, তাতেই তাঁর সতীত্ব বিনষ্ট হবে? এতই ঠুনকো, মেকি সেসব ? প্রকাশ্যে তাঁর বিরুদ্ধে স্লোগান না হয় কালাশনিকভ দেখিয়ে আটকানো যায়, কিন্তু পথে-প্রান্তরে, হাটে- বাজারে, অফিস- কাছারিতে, স্কুল-কলেজে, সংবাদমাধ্যমে ইদানীং যে সব বিশেষণে তিনি ভূষিত হচ্ছেন, তা থামাবে কোন SPG? কোন অজিত ডোভাল?

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে জনগনের নাগালের বাইরে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত, সম্পূর্নভাবেই আত্মঘাতী৷ শুধুই জরুরি অবস্থার সময়ে ইন্দিরা গান্ধীই নন, দেশ-বিদেশের যখন যে রাষ্ট্রনায়ক এ পথে হেঁটেছেন, তার পরিনাম সুখকর হয়নি৷
তাছাড়া, প্রধানমন্ত্রীর দলের রাজ্য নেতারা কি মনে করেন, দেশে প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তি এতটাই তলানিতে ঠেকেছে যে, বাংলার মানুষ তাঁকে দেখলেই মারবে? কল্পকাহিনীকেও হার মানাবে সেই ভাবনা৷

মোদ্দাকথা, নিরাপত্তার এই বাড়াবাড়ি কানাগলিতে ঢুকিয়ে দিচ্ছে নরেন্দ্র মোদিকে৷ সংসদীয় গণতন্ত্রের রীতিনীতি মেনে প্রধানমন্ত্রী হওয়া কাউকে কালো পতাকা দেখানো বা বিরুদ্ধে স্লোগান দেওয়া বিরোধী রাজনীতির অঙ্গ৷ সেই বিরোধিতা যদি আইন ভাঙ্গে, তখন তার মোকাবিলায় দেশে নির্দিষ্ট আইন তো আছেই৷
সে পথে না হেঁটে, নিরাপত্তার অছিলায় আজ যারা প্রধানমন্ত্রীকে
কানাগলিতে পাঠাচ্ছেন, তারা ওনার কতখানি শুভাকাঙ্খী, সে প্রশ্ন উঠবেই৷ এবং প্রধানমন্ত্রীকেও ভাবতে হবে, এমন কোনঠাসা অবস্থায় তিনি কেন পড়লেন!
দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ CAA, NRC, NPR- এর বিরোধী, তা প্রমানিত৷ প্রশাসনিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে, মুখোশ আঁটা লোকজন পাঠিয়ে এসবের প্রতিবাদে সরব যারা হচ্ছেন বা হয়েছেন, তাদের সাময়িক থামানো অবশ্যই সম্ভব৷ তা হচ্ছেও৷

কিন্তু উল্টোদিকেও তো “সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া”-ও হচ্ছে৷ সেই
প্রতিক্রিয়ারই ফসল- কখনও সফর বাতিল করতে হচ্ছে, কখনও বা দেশের এক অঙ্গরাজ্যের নাগরিকদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে হচ্ছে৷

ওনার অনুগামীরা আদর করে ট্যাগ-লাইন বানিয়েছেন, “মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়”৷ অথচ বাস্তব বলছে, দেশের মানুষের মুখোমুখি হওয়াই তাঁর পক্ষে এখন “না-মুমকিন”!

ওই ট্যাগ-লাইনটার পিছনে এভাবে বাঁশ গোঁজাটা কি সত্যিই এতখানি দরকার ছিলো ?

Previous articleপরিবেশ বাঁচাতে ধুলিস্যাৎ আবাসন
Next articleকথায় সুরে সিএএ-এর প্রতিবাদ মুখ্যমন্ত্রীর