রাজনৈতিক সুবিধাবাদের শিকার সুভাষচন্দ্র, কনাদ দাশগুপ্তর কলম

কণাদ দাশগুপ্ত

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে সুবিধামতো নিজেদের রাজনৈতিক সুবিধাবাদ চরিতার্থ করার হাতিয়ারে পরিণত করার খেলা এ দেশে নতুন নয়৷ জাতীয় কংগ্রেসের বিরুদ্ধে মুচমুচে যে সব অভিযোগ বহমান, তার অন্যতম প্রধান,
স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতাজির অবদানকে উপযুক্ত স্বীকৃতি দেয়নি কংগ্রেস। যে সব রাজনৈতিক দল এ সব কথা বলে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে, তাদের কাছে জানতে ইচ্ছা করে, শুধু কংগ্রেস কেন, স্বাধীনতার পর যত সংখ্যক রাজনৈতিক দল বিভিন্ন রাজ্যে বা কেন্দ্রে শাসন করেছে, তারা কেউই কি নেতাজির সংগ্রামকে মর্যাদা দিয়েছে? নেতাজিকে মর্যাদা দেওয়ার সংজ্ঞা কী? বছরে দু-চারদিন তাঁর ছবিতে মালা দেওয়া আর বাংলায় নির্বাচনী প্রচারে এসে “রোবিন্দরনাথ, সুভাষচন্দর বসুজি”-র নাম বক্তৃতায় বলা?

বামপন্থীরা নেতাজি সম্পর্কে ঠিক কোন ধারনা পোষন করতো, তা ইতিহাসে লেখা আছে৷ বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ভারতের স্বাধীনতার জন্য অক্ষশক্তির সঙ্গে হাত মেলানোর জন্য নেতাজি কমিউনিস্ট পার্টির রোষে পড়েছিলেন৷ তোজোর কুকুর থেকে কুইসলিং, নানা তকমা দিয়েছিল কমিউনিস্টরা৷ কিন্তু নয়ের দশকে এসে সিপিএম অতীতের এই ভুল সংশোধন করে নেয়৷ প্রকাশ্যে স্বীকার করে , নেতাজির মূল্যায়নে ভুল হয়েছিল তাদের৷ জ্যোতি বসুও স্বীকার করে নিয়েছিলেন এই ভুলের কথা৷ সিপিএমের সাধারন সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি তো দলের ‘সব গাছ ছাড়িয়ে এক পায়ে দাঁড়িয়ে’ নেতাজির মাহাত্ম্য তুলে ধরতে লেনিনের উক্তি পর্যন্ত ব্যবহার করেছিলেন৷
ইয়েচুরি বলেছিলেন, “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে শত্রুর শত্রু আমার মিত্র এই পথ গ্রহণ করেছিলেন নেতাজি৷ সেই পথ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে৷ কিন্ত্ত নেতাজির দেশপ্রেম প্রশ্নাতীত৷ তাঁর দেশপ্রেম নিয়ে কেউ আঙুল তুলতে পারবে না৷ এই দেশপ্রেমের কারণে চাকরির হাতছানি ছেড়ে দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তিনি৷” জার্মান কমিউনিস্ট নেত্রী রোজা লুক্সেমবুর্গ সম্পর্কে লেনিন যে মন্তব্য করেছিলেন, সেই মন্তব্যও এ প্রসঙ্গে উদ্ধৃত করেছেন ইয়েচুরি৷

রোজা লুক্সেমবুর্গ সম্পর্কে লেনিন কী বলেছিলেন?
কমিউনিস্ট পার্টির লাইন নিয়ে লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিকদের সঙ্গে মতবিরোধ ছিল রোজা’র৷ কিন্ত্ত লেনিন রোজা’র মতামতের গুরুত্ব অস্বীকার করেননি৷ মুরগি ও ঈগল পাখির মধ্যে তুলনা করে ( তুলনা এই কারনেই, মুরগি উড়তে পারলেও ঈগল যে উচ্চতায় যেতে পারে মুরগি তা পারে না ) এই কমিউনিস্ট নেত্রীকে ঈগল হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন লেনিন৷

ইয়েচুরি সাহেবের নেতাজি প্রসঙ্গে মূল্যায়ন, “লেনিন যে ভাবে লুক্সেমবুর্গকে ঈগল বলেছিলেন , নেতাজিও ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামের সেই ঈগল৷”
ঈগলেই শেষ নয়, দেশের স্বাধীনতার জন্য সুভাষের ওই উদ্যোগকে গ্রিক পুরাণের চরিত্র ইকারুসের সঙ্গেও তুলনা করেছিলেন ইয়েচুরি সাহেব৷

কে এই ইকারুস?

পুরাণে দাইদালাসের পুত্র ইকারুস মোম -পালকের ডানা পরে বাবার সঙ্গে ক্রিট থেকে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন৷ বাবার হুঁশিয়ারিতে কান না দেওয়ার ফলে সূর্যের খুব কাছাকাছি চলে যান তিনি৷ তাপে পুড়ে যায় তাঁর দুই ডানা৷ তাঁর প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলেও, মুক্তির জন্য এই অভিযানকে কুর্নিশ করে গ্রিক পুরাণ৷

সেই প্রসঙ্গ তুলে ধরেই ইয়েচুরির মন্তব্য, “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে নেতাজি দেশের স্বাধীনতার জন্য যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন , তা ইকারুসের সঙ্গে তুলনীয়৷ সূর্যের দিকে উড়ে যাওয়ার ফলে ইকারুসের দুই ডানা পুড়ে গিয়েছিল৷ কিন্ত্ত ইকারুস হিম্মত দেখিয়েছিলেন৷ নেতাজিও হিম্মত দেখিয়েছিলেন৷” কমিউনিস্টরা সাম্প্রতিক কালে নেতাজির এই ‘হিম্মত ’কে কুর্ণিশ জানালেও বহু বছর এ দেশের কমিউনিস্টরা নেতাজিকে ধুইয়ে দিয়েছিলেন অজস্র কুকথা বলে৷

ওদিকে, এই সময়কালে যে বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন, সেই বিজেপি’র মাতৃপ্রতিম আরএসএস ও হিন্দু মহাসভা নেতাজি সম্পর্কে কোন মেরুতে অবস্থান নিয়েছিল, তাও এমন কোনও গোপনীয় বিষয় নয়৷ আজকের সময়েও বিজেপি’র দৈনন্দিন কর্ম এবং কর্ম-তৎপরতায় যে সংস্কৃতি প্রতিফলিত হয়, তার সঙ্গে নেতাজির আদর্শের আদৌ কোনও মিল আছে কি? নতুন করে অবতারণা করা নিষ্প্রয়োজন যে বিজেপির রাজনীতির মূল বক্তব্যই হল ‘ধর্মের ভিত্তিতে দেশ গঠন’৷ ওই দলের সদস্য-সমর্থকরা এই নীতিকে গীতা- উপনিষদের মর্যাদা দেন৷ ঠিকই করেন৷ কোনও দলের সঙ্গে যুক্ত থাকলে, সেই দলের নীতি আদর্শ মানতেই হবে৷

কিন্তু ঠিক এই বিষয়ে
নেতাজির বক্তব্য ঠিক কী ছিল? একবার উঁকি মারা যাক৷
দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বলছেন, ‘‘ধর্মকে সম্পূর্ণরূপে রাজনীতি থেকে বাদ দেওয়া উচিত। ধর্ম ব্যক্তি বিশেষের বিষয় হওয়া উচিত, …ধর্মীয় কিংবা অতীন্দ্রিয় বিষয়ের দ্বারা রাজনীতি পরিচালিত হওয়া উচিত নয়।’’(ক্রসরোডস)

নেতাজির টুপির আদল অনুকরণ করে তাঁকে মালা দেওয়া, বক্তৃতায় তাঁর জয়গান গাওয়া বা সোশ্যাল মিডিয়া উপচে দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করার অর্থই কি নেতাজিকে উপযুক্ত মর্যাদা দেওয়া ? এ কাজ তো কংগ্রেস ঘড়ি ধরে করে আসছে কয়েক দশক ধরে৷ তাহলে কংগ্রেসের সমালোচনা কেন হয় ? নিশ্চয়ই সমালোচনাযোগ্য কারন আছে৷

নেতাজিকে উপযুক্ত মর্যাদা দিতে হলে তাঁর এই বক্তব্যকে সর্বপ্রথমেই শিরোধার্য করতে হয়। মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে নেতাজির জয়গান গাইলেই কি তাঁকে শ্রদ্ধা জানানো হয়? জানা নেই৷ নেতাজি এসব কথা বলেছিলেন নিজের বোধবুদ্ধি এবং যে আদর্শ তিনি প্রতিষ্ঠিত করতে আগ্রহী ছিলেন, তার ভিত্তিতে৷ মোদিজি সেই আদর্শ মান্য করেই রাজনৈতিক আঙ্গিনায় বিচরন করছেন কি ? না, ওনার পক্ষে তা সম্ভব নয়৷ মেনে চলার চেষ্টা করলে, তিনি তাঁর দলের প্রতি বিশ্বস্ত থাকবেন না৷ দলের নীতিআদর্শের প্রতি নিবেদিতপ্রান কেউই নেতাজির এই সব বক্তব্যের প্রচারক হতে পারেন না, শাসনক্ষমতা হাতে থাকলেও, দেশ বা রাজ্যকে এই পথে হাঁটিয়ে নিয়ে যেতে পারেন না৷

নেতাজি তো আরও বলছেন, ‘‘…হিন্দু ও মুসলমানের স্বার্থ পৃথক– এর চেয়ে মিথ্যা বাক্য আর কিছু হতে পারে না। বন্যা, দুর্ভিক্ষ, মড়ক ইত্যাদি বিপর্যয় কাউকে রেহাই দেয় না। …হিন্দুরা ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে ‘হিন্দু রাজ’-এর ধ্বনি শোনা যায়, এগুলি সর্বৈব অলস চিন্তা।’’
এই কথা যার মুখনিসৃত,
প্রকৃত বিজেপি, আরএসএস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ কখনও অন্তর থেকে সেই বক্তাকে
সম্মান জানাতে পারে? নিজের দল বা সংগঠনের নীতি-আদর্শের প্রতি দায়বদ্ধ থাকলে, সে কাজ করা তো উচিতও নয়৷

তা সত্ত্বেও এই শ্রেণির লোকজনের নেতাজির প্রতি ‘সম্মান’ প্রদর্শন দেখলে ধারনা হতে বাধ্য, হয় এনাদের এই ‘সম্মান’ প্রদর্শন রাজনৈতিক স্বার্থযুক্ত কৌশল, অথবা ওনারা নিজের দলের নীতি-আদর্শের প্রতিই আর বিশ্বস্ত নন৷

এসব কথার এক আনা বললেই তো ইদানিং গেরুয়া-আইটি সেল হৈ হৈ করে নেমে পড়ছে খিস্তি দিতে, সোশ্যাল মিডিয়ায় তথাকথিত ভেকধারী বুদ্ধিজীবীদের ভাষার সঙ্গে রকের ভাষার মিল পাওয়া যাচ্ছে৷ তবুও মানতে হবে এসব কথা যিনি বলেছেন, সেই নেতাজিকে সত্যিই এনারা ‘শ্রদ্ধা’ করেন? নেতাজির অনুকরন করে টুপি মাথায় দিলেই কি নেতাজি-অনুরাগী হওয়া সম্ভব? মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।

‘স্বাধীনতা’ সম্পর্কে নেতাজির স্পষ্ট ধারণা ঠিক কী ছিলো, তাও এমন কিছু ‘হিডেন অ্যাজেণ্ডা’ নয়৷ একটু বই-টই পড়লেই জানা যায়৷
স্বাধীনতা প্রসঙ্গে নেতাজি বলেছিলেন, ‘‘গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়গত খণ্ড চিন্তা নয়, সমগ্র জাতিকে জড়িয়েই চিন্তা করতে ও অনুভব করতে আমাদের শিখতে হবে। সামাজিক ও আর্থিক ক্ষেত্রের যে সত্যটি সম্বন্ধে আমাদের নিরক্ষর দেশবাসীর চোখ আমাদেরই খুলে দিতে হবে, তা হল— ধর্ম, জাত ও ভাষার পার্থক্য থাকলেও আর্থিক সমস্যা ও অভাব অভিযোগগুলি আমাদের সকলেরই এক। …দারিদ্র ও বেকারি, অশিক্ষা ও রোগগ্রস্ততা, কর ও ঋণের বোঝা সব সমস্যাই হিন্দু ও মুসলমান-সহ অন্যান্য সম্প্রদায়ের জনগণকে একই ভাবে আঘাত করে এবং এগুলির সমাধানও সর্বাগ্রে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের উপর নির্ভর করে।’’ (ক্রসরোডস)৷

নেতাজির এই মনোভাবের সঙ্গে যারা আদৌ সহমত নন, যাদের কর্মধারার মধ্যে নেতাজি-বিরোধিতাই স্পষ্ট হয়, তাঁরাও যখন নেতাজি-ভক্তিতে গদগদ হয়ে নিজেদের ‘উজাড়’ করে দেন, তখন একটু সন্দেহ হয় বৈকি !

আজাদ হিন্দ সরকারের ৭৫ বর্ষপূর্তিতে লালকেল্লায় বছরে দ্বিতীয় বার জাতীয় পতাকা উত্তোলন এবং নেতাজির টুপির আদল অনুকরণ করে দেশবাসীর সামনে আবারও এক ফিল্মি চমক হাজির করার ঘটনা এত চট করে কেউই ভোলেনি। চমকের মোড়কে সত্যের অপলাপ করার গুনী শিল্পীরা এমনই হয়৷

Previous articleমালখানার অস্ত্র পাচার করে দিল সাব ইন্সপেক্টরই!
Next articleবিরাটের দলে পন্থের ফেরা ক্রমশ কঠিন হচ্ছে