বাজেট আর নির্বাচনী ইস্তেহারের ফারাক কি কমছে? কণাদ দাশগুপ্তের কলম

কণাদ দাশগুপ্ত

প্রায় পৌনে তিনঘন্টা ধরে বাজেট পড়লেন নির্মলা সীতারমন৷ দেশবাসী শুনেছে৷ মিশ্র প্রতিক্রিয়াও ছড়িয়ে পড়েছে৷

বাজেটে যে সব কথা বলা হয়, দেখানো হয় আর যা বাস্তবত ঘটে, তার মধ্যেকার ফারাক ঘোচানো দরকার ছিলো, এবারও তা হয়নি। প্রশ্ন তোলাই যায়, বাজেট কি ক্রমশই বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে? বাজেটকে সামনে রেখে সরকারকে টাকা খরচ করতে হয় রাজনৈতিক কারনে, ভোট সংগ্রহের চেষ্টা করতে৷ এটা হয়েই থাকে৷ কিন্তু বিগত, ২০১৯-২০ অর্থবর্ষের বাজেটে দেওয়া প্রতিশ্রুতি কতখানি বাস্তবে প্রতিফলিত হলো, সেটাও তো দেখার বিষয়৷ আমরা কোনও অর্থবর্ষের বাজেট দেখার সময় মূলত সেই বছরের বাজেটেই মনোনিবেশ করি, দরবৃদ্ধির আশঙ্কার কথা আলোচনা করি৷ কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঠিক পূর্ববর্তী আর্থিক বছরের বাজেট নজরের বাইরে চলে যায়৷ কিন্তু সেই বাজেট একটু খতিয়ে দেখলেই স্পষ্ট বোঝা যায়, বাজেটে ঘোষিত বিভিন্ন সংখ্যার বিশ্বাসযোগ্যতা ক্রমশ কমছে। বাজেটে যে সংখ্যা এবং প্রতিশ্রুতি বা আশ্বাস দেওয়া হয়, আর যা বাস্তবত ঘটে, তার মধ্যেকার ফারাক নজরের বাইরে যাওয়া উচিত নয়।

দেশের অর্থনীতি যখন ক্রমশ ঝিমিয়ে পড়ছে, তখন বেড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধার সাহস সীতারমনের কতখানি হবে, তা নিয়ে প্রশ্নও ছিলো৷ অর্থনৈতিক গতি হারানোর সময়ে সময়ে দাঁড়িয়ে বাজেট পেশ করা খুব সহজ কাজ নয়। সেই কাজ সীতারমন
করেছেন বিলগ্নিকরনে সিলমোহর লাগিয়ে৷

২০২০-২১ সালের বাজেট পেশ করা হয়ে গিয়েছে৷
অর্থমন্ত্রী যদি এখন তাঁর পেশ করা প্রথম এবং দ্বিতীয় বাজেটের পরস্পরবিরোধী বিষয়গুলি খতিয়ে দেখেন, ধরতে পারবেন, কেন সাধারন মানুষ বাজেটের প্রতি বিশ্বাস এবং আস্থা হারাচ্ছে৷ সীতারমনের দ্বিতীয় বাজেট প্রাথমিকভাবে দেখে এটাই ধারনা হচ্ছে, বাজেটে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি বাড়ানোর সুযোগ সেভাবে সামনে আনা হয়নি৷ অন্য কিছু ক্ষেত্রে সরকার অতিরিক্ত খরচ করছে বলেই আর্থিক ঘাটতি বাড়ছে। স্পষ্ট হয়েছে, সরকারের প্রকৃত রাজস্বে ফারাক রয়েছে৷

সহজ বাংলায় বলা যায়, বাজেট হল কেন্দ্রীয় সরকারের পরবর্তী আর্থিক বর্ষের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা। কিন্তু বাস্তব হলো, সরকার কীভাবে টাকা খরচ করবে তার একটা হিসেব। সরকারকে টাকা খরচ করতে হয় রাজনৈতিক কারনে, ভোট সংগ্রহের চেষ্টা করতে৷ কেন্দ্র বা রাজ্য, যে কোনও একজন অর্থমন্ত্রীকে বাজেট প্রস্তুতির আগে বুঝতে হয় তাঁর সীমাবদ্ধতার কথা৷ তিনি কতদূর কী করতে পারেন, এবং কী করা উচিত সে কথা বোঝার পরই জল এবং দুধ আলাদা হয়ে যায় তাঁর কাছে৷ বিশ্বস্ত অর্থমন্ত্রী বুঝতে পারেন,  তাঁর হাতে কী কী রয়েছে এবং বাজেট তৈরির সময়ে তাঁকে কোন ধরনের সমস্যার মুখে পড়তে হবে। আর এইখানেই বাজেটে ঢুকে পড়ে অসত্য আশ্বাস, বাক্য এবং সংখ্যার জাগলারি৷ এবং কিছুদিনের মধ্যেই তিনি ধরা পড়ে যান৷ ধরা পড়ে চালাকি৷ তখনই স্পষ্ট হয়, এত ধরনের খাদ্যদ্রব্য থাকতেও বাজেটের আগে “হালুয়া- উৎসব” কেন হয়!

আরও পড়ুন-Budget 2020 : দেশে আরও বিমানবন্দর

এবার একটু নজর দেওয়া যাক ২০১৯-২০ আর্থিক বছরের বাজেটের দিকে৷ বাজেটে কেন্দ্রীয় সরকার যত প্রবল বেগে দুধ-মধুর জোয়ার আনার আশ্বাস দিয়েছিলো এবং আপনার পাতে সেই দুধ এবং মধু কতখানি এলো, তা ২০২০-২১ এর বাজেট দেখার পর এখন একবার মিলিয়ে নিন৷ বলা হয়েছিলো-

☑ ২০২৪ সালের মধ্যে ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে সমৃদ্ধ হবে ভারত।

☑ ২০১৯-২০ অর্থবর্ষের বাজেট মোট খরচ হবে ২৭,৮৬,৩৪৯ কোটি টাকা।

☑ ২০২০ অর্থবর্ষে GDP বৃদ্ধির হার হবে ১২ শতাংশ।

☑ ২০১৯-২০ সালে ভারতের অর্থনীতি হবে ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের৷

☑ ২০২০ অর্থবর্ষে বিলগ্নীকরণের লক্ষ্যমাত্রা হবে ১.০৫ লাখ কোটি।

☑ ৫ বছরে পরিকাঠামোগত ক্ষেত্রে খরচ হবে ১০০ লাখ কোটি টাকা।

☑ বিমা ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ।

☑ ব্যবসায়িক লেনদেনের জন্য বছরে ১ কোটি টাকা ব্যাঙ্ক থেকে তুললে ২ শতাংশ TDS কাটা হবে।

☑ অপ্রচলিত ক্ষেত্রের কর্মীদের জন্য প্রতি মাসে ৩ হাজার টাকা পেনশন।

☑ রেলওয়ের জন্য বরাদ্দ ৬৫,৮৩৭ কোটি টাকা।

☑ বাড়ির মালিকরা যে ঋণ নিয়েছেন তার সুদের ওপর অতিরিক্ত দেড় লাখ টাকা কর-ছাড়।

☑ তালিকাভুক্ত সংস্থাগুলিতে সর্বনিম্ন পাবলিক শেয়ারহোল্ডিং ২৫ থেকে বেড়ে ৩৫ শতাংশ।

☑ অর্থ মন্ত্রক বিনিয়োগের প্রস্তাব দেয় পরিকাঠামো, ডিজিটাল অর্থনীতি, ছোট বড় সংস্থায় কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ শুরুর জন্য বিভিন্ন প্রকল্প-সহ বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে৷

☑ ৩ কোটির মত খুচরো ব্যবসায়ী ও ছোট দোকানদার, যাঁরা বার্ষিক দেড় কোটির কম টাকা ব্যবসায় খাটান, তাঁদের জন্য পেনশন।

☑ ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে সমস্ত GST-নথিবদ্ধ MSME-কে সুদের হারে ২ শতাংশ ভর্তুকি দিতে বরাদ্দ ৩৫০ কোটি টাকা।

☑ প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনা, ইন্ডাস্ট্রিয়াল করিডোর, ডেডিকেটেট ফ্রেইট করিডোর, ভারতমালা ও সাগরমালা প্রকল্প, জল মার্গ বিকাশ ও উড়ান প্রকল্পে বিরাট বরাদ্দ করা হয়। বলা হয়েছিলো, ভারতমালা প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে রাজ্যগুলির রাস্তাঘাটের উন্নয়নে হাত দেওয়া হবে।

☑ ২০১৮-২০৩০ সময়সীমায় রেলওয়ের পরিকাঠামো উন্নয়নে ৫০ লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগ৷

☑ রেললাইন নির্মাণ ও কাজ শেষ করা, যাত্রী মালবাহী পরিষেবার উন্নয়নে সরকারি- বেসরকারি অংশীদারিত্বের প্রস্তাব।

মোটামুটি এই ছিলো ২০১৯-২০ আর্থিক বছরে নরেন্দ্র মোদি সরকারের বাজেট৷ এবার ২০২০-২১ অর্থবর্ষের বাজেট প্রস্তাব সামনে রেখে, তার সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা মিশিয়ে নিন, তাহলেই এই বাজেট বুঝে নিতে পারবেন৷

আরও পড়ুন-Budget 2020 : জিএসটি রিটার্ন সরল হচ্ছে!

Previous articleঢাকায় এই প্রথম পুরনিগমের ভোটগ্রহণ চলছে ইভিএমে
Next articleবাজেট পেশের শুরু থেকেই পড়ল সেনসেক্স, নিফটি