অতিরিক্ত মোদি নির্ভরতাই ডোবাচ্ছে বিজেপিকে, কণাদ দাশগুপ্তর কলম

কণাদ দাশগুপ্ত

একনিষ্ঠ ও বুদ্ধিদীপ্ত উদ্যোগ যদি স্পষ্ট হয়, তাহলে ধর্মের মোড়কবন্দি রাজনীতিকে বার বার উপড়ে ফেলা সম্ভব৷ দিল্লি-নির্বাচনে অরবিন্দ কেজরিওয়াল রাজনৈতিক মহলকে মূলত এই বার্তাই দিয়েছেন৷ দেশের নব্য-হিন্দুত্বের স্বঘোষিত ‘পোস্টার-বয়’- দের তাঁদের ডেরায় বসেই খাঁচাবন্দি করতে কেজরি ব্যবহার করেছেন একটাই অস্ত্র, উন্নয়ন তথা পরিষেবা৷ কেজরি তাঁর এই অস্ত্রের কার্যকারিতা নিয়ে কতখানি কনফিডেন্ট ছিলেন তা বোঝা গিয়েছিলো গোটা নির্বাচন-পর্বে তাঁর অবিচলিত আত্মপ্রত্যয় দেখে৷ আর কেজরির এই প্রত্যয় বিনষ্ট করতে ভুলের পর ভুল করে গিয়েছে বিজেপি৷ ফলে কোনও অঙ্কই মেলাতে পারেননি নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহ৷ কর্মের রাজনীতি যে ধর্মের রাজনীতিকে সহজেই পরাস্ত করতে পারে, দেশের রাজনীতিকরা সেই শিক্ষা যত দ্রুত নেবেন, দেশের সামগ্রিক মঙ্গল তত দ্রুতই হবে৷

একবার দেখা যাক দিল্লিতে এইভাবে বিজেপি’র মুখ থুবড়ে পড়ার কারনসমূহ!

◾(এক) ভারতীয় জনতা পার্টি এখনও ধরতে পারছে না সমস্যা ঠিক কোথায়! ২০১৪ সালে বিজেপি গোটা দেশের সমর্থন আদায় করে নিতে সফল হয়েছিলো একমাত্র নরেন্দ্র মোদিকে সামনে রেখে৷ পরবর্তী সময়েও এই ‘মোদি-ম্যাজিক’ ব্যবহার করে একাধিক রাজ্যে চমকপ্রদ সাফল্যও পায় গেরুয়া- শিবির৷ কিন্তু পরের পর একাধিক রাজ্য থেকে পদ্ম-পতাকা গুটিয়ে ফেলার পর বিজেপির ভাবার সময় এসেছে,অতিরিক্ত ‘মোদি-নির্ভরতা’-ই এখন দলকে ডোবাচ্ছে কি’না !

আসলে, বর্তমান বিজেপি ক্রমেই এক দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে৷ শিরে সর্পাঘাতের পর তাগা বাঁধার জায়গা হাতড়ে চলেছে৷
গেরুয়া-বাহিনি এখনও এই ‘মোদি- নির্ভরতা’ বা ‘মোদি-ব্যবহার’- এর বাইরে গিয়ে অন্য কিছু সামনে এনে ভোটে যাওয়ার সাহস অর্জন করতে পারেনি৷ চোখে পড়ার মতো কোনও উন্নয়ন ৬ বছরেও হাতিয়ার করা যায়নি৷ বিকল্প বা স্টপ-গ্যাপ কোন মুখও হাতে নেই৷ বিজেপির ওই ‘মোদি’-নামক পাশুপাত-অস্ত্রের ধার ও ভার প্রাকৃতিক নিয়মেই যে হ্রাস পাচ্ছে, এটা কি বিজেপি বুঝতে পারছে? “মোদিজিকে প্রধানমন্ত্রী করার ভোট” আর “মোদিজির কথায় অন্য কাউকে ভোট” দেওয়া এক নয়৷ কিন্তু বিকল্প বা বদলি কোনও চরিত্রের চরম অভাব থাকায় বার বার এই ‘সব খোল’ চাবিটিই ব্যবহার করতে বাধ্য হয় বিজেপি৷ আর এই মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারে ওই মোদি-অস্ত্র কতখানি ভোঁতা হয়েছে তা ধরা পড়ছে বিভিন্ন রাজ্যের সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলিতে৷ বেশ কিছুদিন আগে থেকেই ‘Election Mascot’ হিসাবে নরেন্দ্র মোদি দলকে সাফল্য এনে দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন৷ দিল্লিতেও সেটাই হয়েছে৷

◾(দুই) যে কোনও রাজ্যের নির্বাচনের বেশির ভাগটাই নির্ভর করে সেই রাজ্যের নিজস্ব অ্যাজেণ্ডার উপর৷ মোদিজির ভাবমূর্তি দেশনায়কের৷ ভোটপ্রচারে তিনি যা বলেন, তার ৯০ শতাংশই জাতীয় স্তরের সাফল্য বা পরিকল্পনা-কেন্দ্রিক৷ রাজ্যের সমস্যা বা চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে ওনার ‘স্পেসিফিক’ কোনও বক্তব্য থাকেনা৷
গোল গোল কিছু প্রতিশ্রুতি দেন৷ “বিজেপির সরকার আনুন, কেন্দ্র আপনাদের উন্নয়ণে পাশে থাকবে”,
এই সব আশ্বাস একঘেয়ে হয়ে গিয়েছে৷ এই ফাঁক ভরাট করার মতো রাজ্য-স্তরের মুখ যে সব রাজ্যে নেই, সেখানেই মুখ থুবড়ে পড়েছে বিজেপি৷ কিন্তু ‘সংশোধন’ করার সুযোগও তো দলে নেই৷ যে রাজ্যে দলের মুখ নেই, সেখানে মোদির মুখই ভরসা, যেমন দিল্লিতে হয়েছে৷ অস্ত্রের ধার কমেছে বলে ইদানিং ওই ম্যাসকট ডাহা ফেল করছে৷ দিল্লিতেও তাই হয়েছে৷ দলে ভাঙন লাগার আশঙ্কায় কেজরি-র সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো ‘মুখ’ দিল্লিতে গত ৫ বছরে বিজেপি তৈরি করতে পারেনি৷ ফল যা হওয়ার তাই-ই হয়েছে৷ বাংলাতেও এই একই ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা প্রবল৷

◾(তিন) দিল্লিতে বিজেপি একসঙ্গে
Polarisation এবং Development, দু’টি ইস্যু নিয়ে ভোটে নেমেছিলো৷
দু’টো সম্পূর্ন আলাদা অ্যাজেণ্ডা৷ রাজ্যস্তরে একসঙ্গে এই দু’টি বল নিয়ে খেলা যায় না৷ দু’পা এগিয়েই ‘উন্নয়ন’ ইস্যুকে ঝেড়ে ফেলে ‘মেরুকরন’-কেই হাতিয়ার করে বিজেপি৷ এতেই বাজি মেরে দেয় আম আদমি পার্টি৷ উল্টোদিকে কেজরি একবগ্গা ছিলেন উন্নয়নের ইস্যুতে ৷ সাফল্য তো কেজরি পাবেনই৷

◾(চার)দিল্লিতে কেজরির অ্যাজেণ্ডাকে হারাতে চেষ্টা না করে, ‘ব্যক্তি’ কেজরিওয়ালকে হারাতে নেমেছিলো
বিজেপি৷ কেজরিকে ‘জঙ্গি’, ‘সন্ত্রাসবাদী’ পর্যন্ত বলা হয়েছে৷ গেরুয়া-শিবির ধরতেই পারেনি, এই মুহুর্তে গোটা দিল্লির সেরা “লোকাল-ব্র্যান্ড” এই কেজরি৷ তাঁর ধারে-কাছে কোনও দলের কেউ নেই৷ বিজেপি এই অজ্ঞানতাজনিত ব্লাণ্ডারের খেসারতও দিয়েছে৷

◾(পাঁচ) মোদির নামে দিল্লিতে ভোট প্রার্থনা করা বিজেপি’র আর এক ভুল৷ এই স্ট্র্যাটেজি ব্যুমেরাং হয়েছে৷ দিল্লিবাসী নিশ্চিত হয়েছে, মদনলাল খুরানা বা সাহিব সিং ভার্মার দিল্লিতে বিজেপি’র হাতে একজনও রাজ্যস্তরের নেতা নেই৷ এটা নগ্নভাবে সামনে এসেছে যে,কেজরিওয়ালের মতো স্বাধীনচেতা, উদ্যোগীর বিকল্প হিসাবে বিজেপি দিল্লিতে মোদি-শাহের কোনও পুতুলকে মুখ্যমন্ত্রী করতে চায়৷ এর উত্তর ভোটে দিয়ে দিয়েছেন দিল্লির ভোটাররা৷

◾(ছয়) চরম সাম্প্রদায়িক মন্তব্য করার জন্য অনুরাগ ঠাকুর এবং পরবেশ ভার্মার বিরুদ্ধে দলগত ব্যবস্থা নিয়ে ভোটারদের কাছে একটা বার্তা দেওয়া উচিত ছিলো৷ বিজেপি সে পথে না হেঁটে ভোটারদের আস্থা হারিয়েছে৷ দিল্লির প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সাহিব সিং ভার্মার পুত্র পরবেশ ভার্মা যে কেন্দ্রের সাংসদ, সেই পশ্চিম-দিল্লি লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত ১০টি বিধানসভা কেন্দ্রেই বিজেপি গো-হারা হেরেছে৷

◾(সাত) কেজরিওয়াল কতবড় নেতা ? অথচ তাঁকে হারাতে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, গোটা কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা, ১১জন মুখ্যমন্ত্রী, ২৫০ সাংসদ, গোটা দেশের বাছাই করা প্রায় ২৫ হাজার নানা সাইজের নেতাকে দিল্লিতে নামিয়ে বিজেপি নিজেই কেজরিকে মহীরুহ বানিয়ে দেয়৷ এই সিদ্ধান্ত পুরোটাই কেজরির পক্ষে গিয়েছে৷ দিল্লিবাসীর কাছে কেজরি বিনা পরিশ্রমে “লার্জার দ্যান লাইফ” ইমেজ পেয়ে যান৷ সেটা ভেদ করা আর সম্ভব হয়নি বিজেপির পক্ষে ৷ কেজরি কি এতখানি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক চরিত্র ? এ সব যে গেরুয়া-মস্তিষ্কের পরিকল্পনা, তাঁকে দলে রাখা আর উচিত কি’না, ভেবে দেখুক বিজেপি৷

◾(আট) দিল্লি বিজেপির সভাপতি মনোজ তেওয়ারি পাঞ্জাবি আর শিখদের কোনওদিন পছন্দ করেন না৷ এমন সব মন্তব্য অতীতে তিনি করেছেন, যাতে এই দুই সম্প্রদায়ের মানুষই অসন্তুষ্ট৷ এই মনোজ তেওয়ারি’ই পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে প্রকাশ্যে নিজেকে তুলে ধরেছিলেন৷ ওই দুই সম্প্রদায়ের মানুষ এটা নিতে পারেননি৷ অথচ পাঞ্জাবি আর শিখ সম্প্রদায়ভুক্তরাই দিল্লিতে বিজেপিকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন৷ মনোজের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জানাতে এরা দিক বদল করে আপ-শিবিরে চলে গিয়েছেন৷ বিজেপি ধরতেই পারেনি৷
◾(নয়) জেএন ইউ এবং জামিয়ায় বিদ্যার্থী পরিষদের হামলার ঘটনাযর পর ছাত্রসমাজ এবার বিজেপিকে সমর্থন করার কথা একবারের জন্যও ভাবেনি৷
◾(দশ) কেজরির তোলা দিল্লির নিরাপত্তা, বিজলি, জল, নির্মল বাতাস ইস্যু-র কাউন্টার করতে বিজেপি তোপ দাগে শাহিন বাগের দিকে৷ মেরুকরণের তাস খেলার চেষ্টা করে৷ এই তাস উত্তর প্রদেশে হয়তো সাফল্য পেতো৷ কিন্তু দিল্লিতে যে ব্যুমেরাং হচ্ছে, সেটা বুঝতেই পারেনি গেরুয়া শিবির৷

◾(এগারো) শাহিন বাগ- সংলগ্ন সরিতা-বিহার, কালিন্দী বিহার এলাকায় বিপুল জয় পেয়েছে আপ৷ বিজেপি প্রচারে বলেছিলো, শাহিন বাগকে মদত দিচ্ছে স্থানীয় ‘দেশবিরোধী’রা৷ ওই এলাকার বাসিন্দা সব সম্প্রদায়ের মানুষই আপ-কে জিতিয়ে এর ‘বদলা’ নিয়েছেন৷ বুঝিয়ে দিয়েছেন, বিজেপির প্রচারে তাদের আপত্তি আছে৷ এবং বুঝিয়েছেন, তাঁরা দেশভক্ত বলেই এবার বিজেপি’র হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে চান৷

কেজরিওয়ালের এই জয় মুখের কথা নয়। এই মুহুর্তে সংঘর্ষ-ত্রস্ত দেশের রাজধানীতে কেন্দ্র তথা দিল্লির সাংবিধানিক শাসককে পর্যুদস্ত করেই তিনি নিজের আসন অটুট রেখেছেন। আসলে কেজরি জনতার ‘প্রত্যাশার মান’ রাখতে পেরেছিলেন বলেই তৃতীয় বার এত বড় ব্যবধানে জয়ী হতে পেরেছেন। এটা সম্ভব হয়েছে একটাই কারণে, অরবিন্দ কেজরিওয়ালের শাসন- নৈপুণ্য। গত ৫ বৎসর ধরে তিনি সাফল্যের সঙ্গে প্রশাসনিক হাল ধরে রাখতে পেরেছিলেন কেন্দ্রের একাধিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও৷ আর সেই প্রশাসনিক সাফল্যই এ বারের নির্বাচনে বিজেপির সঙ্গে আম আদমি পার্টির এতখানি ফারাক গড়ে দিয়েছে৷

মোদি-সর্বস্ব বিজেপি এটা ধরতে ব্যর্থই হয়েছে ||

Previous articleএখন ঘরে বসেই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে পিএফ অ্যাকাউন্ট
Next articleইনফোসিস-প্রতিষ্ঠাতা নারায়ণমূর্তির জামাই ঋষি সুনক ব্রিটেনের নতুন অর্থমন্ত্রী