অ্যাডামাসের পড়ুয়াদের অন্ধকার থেকে আলোর জীবনে উত্তরণের কথা শোনালেন নাইজেল আকারা

শার্ট আর জিন্সে ৬ ফুটের বেশি উচ্চতার সুঠাম শরীর , কোটরে ঢোকা চোখে গভীর জীবনদর্শন, কাঁধ পর্যন্ত অবিন্যস্ত লম্বা চুল পনিটেল করা , শান্ত অথচ আত্মবিশ্বাসী শরীরী ভাষা নিয়ে হাঁটা চলা তাঁর। তিনি অভিনেতা নাইজেল আকারা। অন্ধকার থেকে আলোর গল্প বলা একটা মানুষ। যিনি বলেন, অনেকের জীবনেই অন্ধকার আছে, সেটাকে লুকিয়ে রাখলে নিজেই কালো হয়ে যাব। সকলের মধ্যে নিজস্ব কোয়ালিটি আছে । সেটাকে ফোকাস করতে হবে ।বারবার ফেল করবে, কিন্তু লক্ষ্য থেকে সরবে না। বারবার চেষ্টা কর, সফল হবেই। বুধবার এভাবেই নিজের কথা বলে অ্যাডামাস ইউনিভার্সিটি, বারাসত-এ সোসিওলজি বিভাগের পড়ুয়াদের উদ্বুদ্ধ করলেন তিনি ।

সাহিত্যের পাতা নয়, বাস্তবের ধুলো বালি মাখা রাজপথেই তাঁর পদচারণা করেন নাইজেল আকারা। এই খ্রিষ্টান ছেলেটি আজ পথ হারানো বহু মানুষের বেঁচে থাকার পথপ্রদর্শক । বেশ কিছু এনজিও-র সঙ্গে যুক্ত।
নিজেই জানালেন, যৌনকর্মী থেকে নেশার অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া মানুষদের অনুপ্রেরণা দেওয়াটাই এখন তাঁর একমাত্র লক্ষ্য । দীর্ঘ ন’বছর সংশোধনাগারে কাটিয়ে এসেছেন নাইজেল। তাই তিনি অকপটে বলতে পারেন নিজের অতীত জীবনের কথা। বলেন, আমি একটা সময় বিভিন্ন মাদক সেবনে ডুবে গিয়েছিলাম। স্নাতকের ফাইনাল ইয়ারে আমি গ্রেফতার হই। এখন সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছি। ২০০৪-এ আমি যখন জেলে ছিলাম, কিছুতেই সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারছিলাম না। তিনি বলেন, অলকানন্দা রায়, নন্দিতা দাশ আমার কাছে মায়ের মতো। আমার নিজের মা চেয়েছিল আমি কলকাতা ছেড়ে চলে যাই। কিন্তু ওনারা দুজন আমার অভিনয় সত্তাটি প্রকাশ করার সুযোগ করে দেন।
‘মুক্তধারা’ তাঁর প্রথম বড় পর্দায় কাজ। শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও নন্দিতা দাশের হাতে গড়া নাইজেল আকারা এখন বহু মেয়ের স্বপ্নের পুরুষ, আবার বহু পুরুষের জীবনের আইকন! কিন্তু, লাজুক নাইজেল আজও তাঁর পা মাটিতেই রাখেন । তিনি যে সময় অপরাধ জগতের সাথে জড়িয়ে পড়েছিলেন, তখন তাঁর যে জীবনবোধ ছিল, তা আজ একেবারে বদলে গিয়েছেে । তিনি সংশোধনাগারে পুলিশের থার্ড ডিগ্রি পর্যন্ত সহ্য করেছেন। বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী অলকানন্দা রায় ‘বাল্মীকি প্রতিভা’-য় তাঁকে অভিনয়ের হাতে খড়ি দেন ।
তাই নাইজেল যখন বলেন, “জীবনে ১০০ শতাংশ কোনও কাজে মন দেওয়াটা আমাদের কাজ, বাকিটা জানা নেই। ” তবে ভিতর থেকে নিজেকে স্থির রাখাটা খুব জরুরি, মনে করেন তিনি। ‘মুক্তধারা’-র পরে ‘রাজকাহিনী’-তে তাঁকে দেখা গেছে। আবারও লিড রোলে দর্শকদের কাছে তিনি এসেছেন ‘গোত্র’ ছবিতে । তিনি পড়ুয়াদের প্রশ্নের জবাবে বললেন জীবনের কথা, জীবনের ‘আপস অ্যান্ড ডাউনস’ মোকাবিলার কথা।
তিনি বাইবেলের পাশাপাশি গীতাও পড়েছেন । মঞ্চে দাঁড়িয়ে ঝরঝরে সংস্কৃত উচ্চারণে ‘শনি মন্ত্র ‘ বলেন । তাঁর কথায়, এটা আর মিউজিক তাঁর মেডিটেশনের কাজ করে।
কখনও স্বপ্ন দেখেছিলেন এই রকম জীবনের? উত্তরে বলেন, “আমি তো স্বপ্নই দেখতাম না! খালি ভাবতাম, কখন পালাবো। কিন্তু যে দিন ছাড়া পেলাম, বলেছিলাম, নাটকের প্রয়োজনে আমি জেলেই থেকে যেতে পারি। কারণ আমার আত্মা তখন মুক্ত। শরীর কোথায় থাকবে, তা নিয়ে ভাবিনি ।” হল জুড়ে তখন প্রবল হাততালি।
বর্তমান প্রজন্মের জন্য তাঁর পরামর্শ, লোভ কোরো না। যা পেয়েছো তাই নিয়ে খুশি থাকো।
আবার হাততালির ঝড়। কখনও বা উত্তর শুনে প্রবল হাসি।


তোলাবাজি থেকে খুন, কী অভিযোগ ছিল না তাঁর বিরুদ্ধে? কিন্তু সেটাই তো শেষ নয়। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের প্রাক্তন ছাত্র নাইজেল আকারার
অপরাধপ্রবণতা থেকে ভালবাসায় উত্তরণের এই গল্পে তবু একটি প্রশ্ন থেকে যায়। নাইজেলের কাজকর্মে যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত, তাঁরা কি ক্ষমা করতে পারবেন তাঁকে? করা সম্ভব? নাইজেল নিজেই জানিয়েছেন , না, তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে আমি তাঁদের অনেকের সঙ্গেই যখন দেখা হয়েছে, বলেছি, আমাকে ক্ষমা করুন। আমি যদি এখন কোনও ভাবে সাহায্য করতে পারি, বলবেন। এখন তিনি সিকিউরিটি এজেন্সি চালান, পেস্ট কন্ট্রোলের ব্যবসা করেন। অথচ একটা সময় তাকে কেউ একটা কাজ দেয়নি। অপরাধ ছিল, নিজের সিভিতে তিনি লিখেছিলেন যে তিনি একজন জেল ফেরত আসামী । হতাশায় ডুবে গিয়েও সত্যের পথ থেকে তিনি সরে আসেন নি।
এখন তাঁর পরিচয় অভিনেতা । এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি স্পষ্ট জানিয়েছেন, টলিউডে অনেক বড় মাপের অভিজ্ঞ অভিনেতা আছেন । আমি তাদের ধারেকাছেও যাইনা। তবে কেউ কেউ শত্রু মনে করেন। আমি কিন্তু কারও শত্রু নই।


অ্যাডামাস ইউনিভার্সিটির ভিসি মধুসূদন চক্রবর্তী, সোসিওলজি বিভাগের ডিন ত্রিদিব চক্রবর্তী ও বিশিষ্টরা নাইজেলের কথায় মুগ্ধ । কেননা নাইজেল এখন অন্যকে স্বপ্ন দেখান, তিনি এখন স্বপ্নের ফেরিওয়ালা ।

Previous article‘দিল্লির পুলিশ কমিশনারকে বরখাস্ত করুন’, প্রধানমন্ত্রীকে প্রশান্ত কিশোর
Next articleরাজ্যসভায় তৃণমূলের পিকে, ঋতব্রত?