করোনাই এক সুতোয় বেঁধেছে কলকাতা আর কানাডাকে

মনামী পাল ভট্টাচার্য, কানাডার বাসিন্দা

করোনার প্রকোপে সারা পৃথিবী ত্রস্ত, নাজেহাল। এই মহামারি কেড়ে নিচ্ছে প্রাণ, গৃহবন্দি মানুষ। স্কুল, কলেজ, অফিস সব বন্ধ। জনজীবন প্রায় স্তব্ধ। একই অবস্থা কানাডায়। আমি থাকি অন্টারিও প্রদেশের একটা ছোট শহর কিচেনার-ওয়াটারলুতে। এখানে এখনও পর্যন্ত ৩৩ জন মানুষ করোনা আক্রান্ত। আরও ৩৬ জনের সংক্রমণের আশঙ্কা রয়েছে। অন্টারিও প্রদেশে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ১১২০। মারা গেছেন ১৮ জন।

সোশ্যাল ডিস্টেনসিং, সেলফ হাইজিন অভ্যাস করা, এসব তো আছেই, তার উপরে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য আরও অনেক রকম ব্যবস্থা নিচ্ছে কানাডা সরকার। কলকাতা থেকে এত দূরে এসে আজ প্রথম মনে হচ্ছে, করোনাই যেন কলকাতা আর কানাডাকে এক সুতোয় বেঁধে দিয়েছে।
এখানে অনেকেরই চাকরি চলে গিয়েছে। পরিস্থিতি ঠিক হওয়ার আগে নতুন করে কাজের সম্ভাবনা নেই। তাই সাধারণ মানুষের সহায়তা করার জন্য অনেক পদক্ষেপ করে সরকার। ছোট এবং মাঝারি মাপের ব্যবসায়ীদের থেকে ভর্তুকি প্রায় ৭৫% কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। সুদের হার অনেক কমিয়ে দিয়েছে ব্যাঙ্ক অফ কানাডা। শিশু সুরক্ষার জন্য ভর্তুকি অনেক বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যাদের এই পরিস্থিতিতেও কাজে বেরোতে হচ্ছে, তাদের সন্তানদের দেখার জন্যেও আলাদা সেন্টারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বড়ো গাড়ি কোম্পানিগুলি সরকারকে ভেন্টিলেটর বানিয়ে সাহায্য করছে। হকি খেলার সরঞ্জাম তৈরি করে এমন একটি বিখ্যাত সংস্থা বানিয়ে দিচ্ছে ফেস মাস্ক। সব ধরণের জরুরি পরিষেবা খোলা আছে। অলাভজনক সংস্থাগুলি হাজার হাজার মানুষকে খাবার দিয়ে, থাকার জায়গা করে দিচ্ছে। সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে অনেক মানুষ এগিয়ে আসছেন, সাহায্য করছেন।

আর এসবের মধ্যে কেমন ভাবে দিন কাটাচ্ছি আমরা? ২৪ ঘণ্টা বাড়িতে। বাইরে বেরোনোর কোনো প্রশ্নই নেই। হাঁটতে বেরোতেও ভয় লাগছে। মাঝে মাঝে তো দিন, বার গুলিয়ে যাচ্ছে। দিন পনেরোর মতো খাবার জোগাড় করে রেখে দেওয়া হচ্ছে। খাচ্ছিও মেপে মেপে। হঠাৎ অবস্থা বেশি খারাপ হয়ে গেলে, দোকান, বাজার সব বন্ধ হয়ে গেলে আমাদের যেন বিপাকে না পড়তে হয়। সবথেকে বেশি সমস্যায় পড়েছে বাড়ির ছোটরা। তারা তো এই পরিস্থিতির গুরুত্ব অতটা বুঝতে পারছে না। শুধু জেনেছে যে একটা সাংঘাতিক কিছু চলছে বাইরে, তাই আমাদের বাড়িতে থাকতে হবে। যা করতে হবে বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে থেকেই। অনলাইন স্টাডি চালু হয়ে গিয়েছে। আমার দুই মেয়ে নিজেদের মতো করে সময় কাটাচ্ছে। পড়ছে, খেলছে, বন্ধুদের সঙ্গে চলছে ভিডিও কল। কিন্তু মাঝে মধ্যেই জিজ্ঞেস করছে, কবে স্কুল খুলবে, কবে সাঁতারে যাব? টেনিস খেলব? আমাদের কাছে এটার একটাই উত্তর, জানি না।

সত্যি তো আমরা জানি না কবে সবকিছু আবার ঠিক হবে। শুধু অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারবো না আমরা।
তবে এই জরুরি অবস্থা অনেক ভালো কিছুও দিচ্ছে। দূষণ অনেক কমে গিয়েছে, বাতাসে ধুলোর আস্তরণ সরছে আস্তে আস্তে। এটা একটা খুব বড়ো ব্যাপার। আমরা বোধহয় অনেক যুগ বাদে, পরিবারের সান্নিধ্য ভোগ করছি। সারাদিনের ব্যস্ততা আর ছোটাছুটির মাঝে যে আবেগ আর ছোট ছোট মুহূর্তগুলোকে দাম দিতে আমরা ভুলে যাই, সেগুলো এখন দিতে পারছি, তাই ভালো লাগছে।  বলতে দ্বিধা নেই , মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে বটে , “এই বেশ ভালো আছি. কর্মকাজ নেই, আপিস কাছারি নেই”. আর এদেশে এতো বছর থাকার ফলে নিজেদের কাজ নিজেরা করে নেওয়ার অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। তাই, কলকাতা বা হাওড়ায় থাকা আমাদের আত্মীয়দের মতো “কাজের দিদি আসেনি” বলে সমস্যা হচ্ছে না।

জানি একদিন করোনার প্রকোপ স্তিমিত হয়ে যাবে। এই লড়াই জিতে যাব আমরা। আবার সব বন্ধ দরজা খুলে যাবে, মানুষ মানুষের সাথে খোলা মনে মিশতে পারবে। আবার ফিরে যাব রোজকার জীবনে। সেই দিনটাকে স্বাগত জানানোর অপেক্ষা চলছে। আর এর মাঝে এই যে একচিলতে অবসর যাপনের সুযোগ পাচ্ছি, এখন না হয় সেটাই উপভোগ করি।

Previous articleবিধি ভাঙ্গলে গ্রেফতার , সব্যসাচীকে বলেছে পুলিশ, ত্রাণ বিলি হবেই, জানালেন বিধায়ক
Next articleরাতভর সাইকেল চালিয়ে ৬০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে সকালে ডিউটি করছেন এই পুলিশকর্মী!